হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মুনশী আবদুল মাননান : গত শনিবার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাবের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন: ‘ওনার প্রস্তাব উনি দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতিকে বলুক। এটা রাষ্ট্রপতি ভালো বুঝবেন, উনি কী পদক্ষেপ নেবেন। রাষ্ট্রপতি যে পদক্ষেপ নেবেন সেটাই হবে। এখানে আমাদের কিছু বলার নেই।’ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে থাকা বার্তার সারকথাটি হতে পারে এমন: বিএনপি তার চেয়ারপারসনের দেয়া প্রস্তাবাবলী প্রেসিডেন্টের কাছে পেশ করতে পারে। প্রেসিডেন্ট তার বুঝ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন বা নিতে পারেন। আর প্রেসিডেন্ট যে পদক্ষেপ নেবেন, সেটাই হবে। এ ব্যাপারে সরকার বা আওয়ামী লীগের বলার কিছু নেই। তিনি তার এ বক্তব্যটি আরো স্পষ্ট করেছেন জাতীয় সংসদের সমাপনী বক্তৃতায়। সেখানে তিনি বলেছেনÑ “নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রেসিডেন্ট উদ্যোগ নিয়েছেন। বিএনপি তাদের প্রস্তাব দিয়েছে। তারা তাদের কথা বলেছে। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে প্রেসিডেন্ট আলোচনা করবেন। আলোচনার মাধমে নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। তিনি যে ভাবে চাইবেন, নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। আমরা সেটা মেনে নেব।”
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ইতিবাচক। কিছু দিন ধরে বিরোধী রাজনৈতিক ও অন্যান্য মহল থেকে বলা হচ্ছে, যেহেতু প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগের সাংবিধানিক এখতিয়ার প্রেসিডেন্টের হাতে ন্যস্ত সুতরাং প্রেসিডেন্ট দল নিরপেক্ষ, শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। এ ব্যাপারে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটি সংলাপ বা আলোচনার আয়োজন করতে পারেন এবং সেই আলোচনার ভিত্তিতে তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিতে পারেন। আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলে এ সংক্রান্ত বিরোধ-বিতর্কের মীমাংসা হয়ে যাবে। যারা এরকম ধারণা পোষণ করেন বা এরকম বক্তব্য দিয়েছেন তারাও জানেন, একক ও স্বাধীনভাবে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগদানের ক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আছে। প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগের ক্ষেত্রেই কেবল প্রেসিডেন্টের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা আছে। অন্য সকল সাংবিধানিক পদে নিয়োগদান তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করবেন, এমন বিধানই সংবিধানে বিদ্যমান। নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী হবে। কিন্তু যেহেতু নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা ও ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও প্রশ্ন রয়েছে, সেক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট স্বীয় পদাধিকার ও রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে নিজ প্রভাব কাজে লাগিয়ে একটা গ্রহণযোগ্য ও মীমাংসার জায়গায় পৌঁছাতে সবচেয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন।
প্রেসিডেন্টের কাছে এই যখন প্রত্যাশা তখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও প্রেসিডেন্টের এ ধরনের উদ্যোগ বা পদক্ষেপ সমর্থন করেছেন। বিএনপির তরফে নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে প্রস্তাব দেয়ার পর এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা জোরদার হয়েছে। বিএনপিও তার প্রস্তাবাবলী প্রেসিডেন্টের কাছে প্রদান করার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করার ১৩ দিনের মাথায় প্রস্তাবসহ একটি আবেদন বঙ্গভবনে পৌঁছে দিয়েছে গত মঙ্গলবার। বিএনপির প্রতিনিধি দল বঙ্গভবনে গিয়ে প্রেসিডেন্টের সহকারী সামরিক সচিবের কাছে প্রস্তাব ও আবেদনপত্র হস্তান্তর করেছে। প্রতিনিধি দলের পক্ষে আশা প্রকাশ করা হয়েছে, মহামান্য প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রীয় অভিভাবক হিসেবে দেশের মানুষের যে আকাক্সক্ষাÑ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন কমিশন, তা গঠনের ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেয়ার জন্য ইতিমধ্যেই আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছেন। ওই দিন বিএনপির প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে এলেই বিএনপিকে আলোচনার আমন্ত্রণ জানানো হবে। প্রেসিডেন্টের প্রেসসচিব জানিয়েছেন, বিজয় দিবসের পর প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেবেন। প্রেসিডেন্টের কাছে বিএনপির প্রস্তাব পেশ ও আলোচনার অনুরোধ যে কোনো বিবেচনায় ইতিবাচক। অন্যদিকে বঙ্গভবনে বিএনপি প্রতিনিধি দলকে যেভাবে গ্রহণ করা হয়েছে, যে রূপ সৌজন্যে প্রস্তাবাবলী নেয়া হয়েছে ও কথাবার্তা বলা হয়েছে, তাও অত্যন্ত ইতিবাচক। সবচেয়ে বড় কথা, প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করার যে সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগ নিয়েছেন সেটা খুবই আশাব্যঞ্জক। রাজনৈতিক দলসহ নাগরিক সমাজের আশা ও অভিমতের প্রতি প্রেসিডেন্ট যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তার জন্য তাকে আমরা আন্তরিকভাবে সাধুবাদ জানাই।
একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন শুধু রাজনৈতিক দাবি নয়, এটি এখন একটি জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন অপরিহার্য পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত যত নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে তার মধ্যে তিনটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওই তিনটি নির্বাচন কমিশন গঠন করেছিল। দেখা গেছে, ওই তিন নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরাজিত দলের তরফে কিছু ছোটখাটো অভিযোগ তোলা হলেও অনেকে মনে করেন, অভিযোগ ছিল রাজনৈতিক।
এ ছাড়া বাকি যেসব নির্বাচন হয়েছে তার একটিও অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে গণ্য হয়নি। এর কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, ওইসব নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট দক্ষ, যোগ্য, শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ ছিল না। দলীয় সরকার ওইসব নির্বাচন কমিশন গঠন করায় নির্বাচন কমিশনগুলো ছিল ক্ষমতাসীনদের প্রভাবাধীন, দুর্বল ও পক্ষপাতদুষ্ট। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, দলীয় সরকারের গঠন করা নির্বাচন কমিশনের পরিচালিত নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণে প্রথমে আন্দোলন ও পরে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন ও সংবিধানভুক্ত করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ায় এই ব্যবস্থার স্থায়িত্ব প্রত্যাশিত হলেও বর্তমান ক্ষমতাসীনদের পূর্ববর্তী সরকার এ ব্যবস্থা বাতিল করে আগের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনে। সে মোতাবেক বর্তমান নির্বাচন কমিশন ওই সরকারের দ্বারা গঠিত হয়। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনসহ এ যাবৎ অনুষ্ঠিত যাবতীয় নির্বাচন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব নির্বাচন কেমন হয়েছে, তা কারো অজানা নেই। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচন দেশে-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সেটি অভিনব ভোটারবিহীন, অনিয়ম-দুর্নীতিপূর্ণ, একতরফা ও জবরদস্তিমূলক নির্বাচন হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ওই নির্বাচন নিয়ে এত আলোচনা হয়েছে যে, এখন যা কিছুই বলা হোক, তা পুনরাবৃত্তি হবে মাত্র। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর দাবি ছিল, দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন ও তার অধীনে নির্বাচন এবং স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন। সরকার তারই দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি নাকচ করে দেয় এবং কার্যত সরকার বা সরকারি দলের অনুগত ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করে। তবে লোক দেখানোর জন্য একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয় এবং সার্চ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করেন। সার্চ কমিটি এবং সার্চ কমিটির সুপারিশকৃত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত নির্বাচন কমিশন- কোনোটাই যে ক্ষমতাসীনদের প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ ছিল না, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে সকল নির্বাচনেই তা প্রমাণিত হয়েছে। এও ফের প্রমাণিত হয়েছে, দলীয় সরকারের অধীনে এবং তার দ্বারা গঠিত নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে না বা হতে পারে না। অবাধে, স্বচ্ছতার সঙ্গে ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে তাই দাবি ও আলোচনার অবধি নেই। তবে বিরোধী দলগুলো আগের চেয়ে এখন কিছুটা নমনীয়। তারা নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা আর খুব জোরের সঙ্গে বলছে না। সম্ভবত তারা সংবিধানে বর্ণিত বিধান মোতাবেকই নির্বাচনে রাজি। সেক্ষেত্রে তারা সরকার যাতে নির্বাচনে কোনোরূপ প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, তার একটা নিশ্চয়তা চাইছে। তারা স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনকেই এখন অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বিএনপির ১৩ দফার প্রস্তাব প্রেসিডেন্টের কাছে পেশ ও আলোচনার প্রস্তাব থেকে এটা ধারণা করা যেতে পারে। বিএনপির প্রস্তাবের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের মনোভাব ও বক্তব্য শুরুতে ইতিবাচক বলে মনে হয়নি। কেউ কেউ এ প্রস্তাব শুধু অগ্রাহ্যই করেননি, তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্যও করেছেন। কেউ কেউ বিএনপির সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনাও নাকচ করে দিয়েছেন। পর্যবেক্ষক মহল অবশ্য মনে করে, বিএনপির প্রস্তাব হুবহু গ্রহণ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। প্রস্তাবের মধ্যে যেমন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টও আছে। তার আলোকে আলোচনা হতে পারে। আলোচনার শুরুটা হতে পারে ওই প্রস্তাবগুলো ধরেই। বিএনপির মনোভাবও অনেকটা এ রকমই। তার মতে, এই প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনার দ্বারোদ্ঘাটন হতে পারে।
সরকারও সম্ভবত নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে এখন আলোচনার পক্ষপাতী। সেটা লোক দেখানোর জন্য কিনা, সে কথা এ মুহূর্তেই বলা যাবে না। এ জন্য সময় লাগবে। সেটা বলা যাবে আলোচনার পূর্বাপর দেখে এবং তার ফলাফলের ভিত্তিতে। এ ব্যাপারে অতীতের অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোঃ জিল্লুর রহমান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ও মতবিনিময় করেছিলেন। তাতে কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি বাছাই কমিটির মাধ্যমে আসা ব্যক্তিদের থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দান করেন। দেখা যাচ্ছে, বাছাইকৃত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত এই নির্বাচন কমিশন ইতিহাসের সবচেয়ে ধীকৃত-নিন্দিত-সমালোচিত নির্বাচন কমিশন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আইনমন্ত্রী আভাস দিয়েছেন, আগের মতো এবারও বাছাই কমিটি হবে। অর্থাৎ তার মাধ্যমে বাছাইকৃত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ করা হবে। আগের নজির থেকেই বোঝা যায়, বাছাই কমিটি কোনো কাজে আসেনি। এ ধরনের বাছাই কমিটি আগামীতেও কাজে আসবে না। বাছাই কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সরকারের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ রেখে নিরপেক্ষ বাছাই কমিটি গঠন করা সম্ভব নয়। আর বাছাই কমিটি যদি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ না হয় তাহলে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করাও সম্ভব নয়। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ব্যতিরেকে যেহেতু প্রেসিডেন্টের পক্ষে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়া সম্ভব নয়, কাজেই সেখানেও প্রভাব রাখার সুযোগ রয়েছে। এ কারণে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সংবিধানে বর্ণিত নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন ও সেই আইনের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন এবং আইনটি প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে।
এটা ঠিক, অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষমতাসীন সরকারই নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন করে। সেসব দেশেও নির্বাচন কমিশন গঠন করেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু কখনই কোনো দেশে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে, নির্বাচনের স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। না ওঠার কারণ, নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের প্রভাব বিস্তারের কিংবা এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো সুযোগ ও সম্ভাবনাকে ওইসব দেশে রহিত করা হয়েছে। তাছাড়া দেশগুলোতে নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি অত্যন্ত শক্ত। ভারতের নজির থেকেই বোঝা যায়, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও শক্তিশালী হলে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব। আমাদের দেশেও নির্বাচনকালীন আলাদা কোনো সরকার গঠন না করেও কাক্সিক্ষত নির্বাচন করা যায়, যদি নির্বাচন কমিশন স্বাধীন নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী হয়। বিদ্যমান প্রেক্ষিতে সকল দল-মহলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে সেরকম নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব হতে পারে। এ জন্যই আলোচনা বা সংলাপ জরুরি। প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন ও জাতীয় সংসদে যে কথা বলেছেন, তাতে মনে করা যেতে পারে, তিনি আলোচনা, সমঝোতা চান। এর আগে তিনি বলেছিলেন, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন তিনি দেখতে চান না। প্রশ্নহীন, বিতর্কহীন নির্বাচন নিশ্চিত করতে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নেই। আমরা আশা করতে চাই, প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার যে উদ্যোগ নিয়েছেন সেই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে এ ব্যাপারে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা ও ঐকমত্যের ভিত্তি রচিত হবে, যা কাক্সিক্ষত নির্বাচন কমিশন গঠন ও আগামীতে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানকে সম্ভবপর করে তুলবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।