Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আস্থা ফেরানোর চেষ্টায় দুদক

সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নজরদারিতে : দুই শতাধিক ব্যক্তির তালিকা প্রস্তুুত : নিজস্ব আর্মড ইউনিট গঠন ও হাজতখানা নির্মাণের উদ্যোগ

| প্রকাশের সময় : ৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:১০ এএম

মালেক মল্লিক : ‘নখ-দন্তহীন বাঘ’, ‘তলপিবাহক’-এসব সমালোচনা ঝেড়ে ফেলে আস্থা ফেরানোর প্রচেষ্টায় এখন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতোমধ্যে সংস্থাটি বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বরাবরের মতো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি নজরদারি বৃদ্ধি করেছে। পরমুখাপেক্ষিতা কাটিয়ে দুর্নীতিবাজকে গ্রেফতার, হাজতে রাখার জন্য নিজস্ব আর্মড ইউনিট গঠন করবে। তদন্তগতি ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য সময়ও বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে দুদক। এসব উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সাবেক আইনমন্ত্রীসহ বিশেষজ্ঞগণ।
দুদক প্রতিষ্ঠার পর অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি, সাবেক সচিবসহ চারজন দুদকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে দুই/একজন ছাড়া কেউ সাধারণ জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। একজন সেনা কর্মকতা চেয়ারম্যানের দায়িত্বে এসে অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ নীতি আরোপ করে ব্যাপক আলোচনায় জন্ম দেয়। পরবর্তীতে চেয়ারম্যানগণ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দায়মুক্তির ‘ধবধবা সাদা ফকফকা’ সনদ দেয় বলেও অভিযোগ উঠে। এরপর ২০০৯ সালে দুদককে দন্তহীন বাঘও বলে মন্তব্যও করেন একজন চেয়ারম্যান। সবশেষ চলতি বছর মার্চে সাবেক সচিব ইকবাল মাহমুদকে সংস্থটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি উদ্ধারে কর্মতৎপরতা শুরু হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে চালাতে থাকে সাঁড়াশি অভিযান। বৃদ্ধি পায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নজরদারি, সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের গ্রেফতারের সুযোগ পায় দুদক কর্মকর্তারা। এছাড়াও নেয়া হয় পঞ্চবার্ষিকী মহাপরিকল্পনা। হাজতখানা ও ব্যারাক নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের এসব উদ্যোগে স্বাগত জানিয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তাদের মতে, প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তির উজ্জ্বল করার দায়িত্ব চেয়ারম্যানের। এসব পরিকল্লনা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সহায়ক হবে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, দুদকের বর্তমান চেয়ারম্যানের উদ্যোগগুলো বেশ সুন্দর উদ্যোগ। সকলকে সাধুবাদ জানানো উচিত। তার নেয়া উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে একদিকে যেমন দুর্নীতি কমবে অন্যদিকে দেশের সুনাম বৃদ্ধি পাবে।
তিনি আরো বলেন, এসব বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশের সাধারণ মানুষের দুদকের প্রতি আস্থা বাড়বে। দুদক সক্রিয় থাকলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার করা সম্ভব হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমান কমিশনের কতগুলো উদ্যোগ দেখে ইতিবাচক মনে হচ্ছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে সাধারণ মানুষের কাছে দুদকের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।
তিনি আরো বলেন, গ্রেফতার অভিযান চালুু থাকবে তবে এটা নিশ্চিত করতে হবে যাতে সাধারণ নাগরিক হয়রানি না হয়। একই সঙ্গে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অতি বাড়াবাড়িও করা যাবে না। এটা করলেই হরয়ানি বাড়বে।
এর আগে গত ২১ নভেম্বর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে সংস্থাটির চেয়ারম্যান বলেছিলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জনগণের আস্থা অর্জনে দুর্নীতি দমন কমিশন ব্যর্থ হচ্ছে। আমরা জনগণের আস্থা ফেরানোর জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। হতে পারে অনেক ক্ষেত্রে সকলের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি।  সামনে আস্থা বাড়িয়ে সকলের প্রত্যাশা পূরণ করব।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য ইনকিলাবকে বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে সাড়াশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নজরদারি, এছাড়াও নেয়া হয়েছে পঞ্চবার্ষিকী মহাপরিকল্পনা। আগামী ১৫ ডিসেম্বর মহাপরিকল্পপনা উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’ বিলুপ্ত করে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর দুদক প্রতিষ্ঠা করেন। ইতোমধ্যে এক যুগের বেশি সময় পার করেছে দুদক। প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ সময় প্রতিষ্ঠানটির তেমন কার্যক্রম ছিল না। তৎকালে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুলতান হোসেন খান। তার মেয়াদ ৪ বছর পূরণের আগেই সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কমিশন পুনর্গঠন করা হয়। এসময় দুদকের কার্যক্রমে অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ আরোপের অভিযোগ উঠে। প্রতিহিংসা আর স্বজনপ্রীতির নজির স্থাপন করার অভিযোগ উঠে। ২০০৯ সালে সাবেক সচিব গোলাম রহমানের নেতৃত্বে তৃতীয়বারের মতো দুদক পুনর্গঠন করা হয়। তিনিই ৫ বছর দায়িত্ব পালন করেন। আস্থা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে গিয়েছিলেন তিনি। এরপর প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন দুদকের কমিশনার মো. বদিউজ্জামান। এ সময় আবার বেশিমাত্রায় ক্ষমতাসীন সরকারের আজ্ঞাবাহ হয়ে পড়েন।
অনিয়মের বিরুদ্ধে দুদকের অভিযান
নভেম্বর পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দফতরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, জনপ্রতিনিধিসহ ৫ শতাধিক জনকে গ্রেফতার করেছে দুদক। শুধুমাত্র ব্যাংক কর্মকর্তা ও ঋণ জালিয়াতির প্রায় দেড় শত হোতা গ্রেফতার হয়। এর মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ী ১৫০, ব্যাংক কর্মকর্তা ৭৩, জনপ্রতিনিধি ২৬, চিকিৎসক ২১, ভূমি কর্মকর্তা ১২, সরকারি কর্মকর্তা ১৬। আরও রয়েছেন রাজউক কর্মকর্তা-কর্মচারী ৭, ওয়াসার কর্মকর্তা ৪, সড়ক ও জনপথের কর্মকর্তা ৪ এবং অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ৩ জন। এ ছাড়াও সামনের এক মাসের মধ্যেই গ্রেফতার করতে প্রস্তুুত করা হচ্ছে আরও দুই শতাধিক ব্যক্তির তালিকা। দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে ৫২ ব্যাংকার, ১৯ ব্যবসায়ীসহ ১৮৯ ব্যক্তির ওপর। সরকারের ১০ টাকার চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগে খাদ্য পরিদর্শক, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারসহ  প্রায় ২০ জনের বেশি কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে দুদক। ১০ টাকা কেজির চাল উত্তোলন, খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির আওতায় ওএমএস ডিলারদের নিকট হতে অবৈধ আর্থিক সুবিধার অভিযোগ পরিপ্রেক্ষিতে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। সবশেষ গত মঙ্গলবার ওয়াসার একজন  প্রকৌশলী ও ২ ব্যবসায়ী গ্রেফতার সংস্থাটি।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নজরদারি
গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে পাঁচটি প্রাতিষ্ঠানিক দল গঠন করেছে দুদক। সংস্থার পাঁচ পরিচালক দলগুলোর নেতৃত্ব দেবেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
হাজতখানা ও ব্যারাক নির্মাণ  
দুদক নিজস্ব কোনো প্রিজন ভ্যান নেই। হাতকড়াও নেই। এসব লাঘবে দুদক নিজস্ব আর্মড ইউনিট গঠন করবে। এছাড়াও সার্বক্ষণিক অস্ত্র রাখার নেই কোনো ব্যবস্থা। আগামীতে আসামি গ্রেফতার, রিমান্ড ও তদন্তের অন্যান্য কার্যক্রমে দুদক কার্যালয় নিজস্ব হাজতখানা ও ব্যারাক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ১৫৩ ধারায় তল্লাশি ও আলামত জব্দ করার ক্ষমতাও দেয়া হচ্ছে। ৬০ দিন থেকে বাড়িয়ে ১২০ দিনের মধ্যে অনুসন্ধানের সময়সীমা নির্ধারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গত ২৩ অক্টোবর দুদকের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে প্রেসিডেন্ট বরাবর প্রতিবেদন জমা দেন। এতে কমিশন প্রথমবারের মতো সরকারি সেবা, সরকারি নিয়োগ, সরকারি ক্রয় কার্যাদি, সরকারি নির্মাণ/মেরামত সংস্কার, কার্যপদ্ধতি সংস্কার, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিবিধ সংক্রান্ত ৩২টি সুপারিশ পেশ করা হয়। অটোমেশিন চালু হলে নিজের পরিচায় গোপন রেখে যে কোনো ব্যক্তি অভিযোগ দুদকে দিতে পারবে। এছাড়া অপরাধীর একটি তালিকা তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে কমিশন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুদক

৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ