Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামে হুজি আস্তানা থেকে পাঁচ জঙ্গি গ্রেফতার : অস্ত্র গ্রেনেড বিস্ফোরক উদ্ধার

প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে নেতাদের উদ্ধারের পরিকল্পনা!

| প্রকাশের সময় : ৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রাম মহানগরীর কর্নেল হাট এলাকায় একটি বাড়ি ঘিরে কয়েক ঘণ্টা অভিযানের পর গতকাল (বৃহস্পতিবার) অস্ত্র, গুলি, হ্যান্ড গ্রেনেড ও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধার করেছে র‌্যাব। ওই বাড়ি থেকে তিনজনসহ দুই দফায় আটক করা হয়েছে পাঁচজনকে।
এলিট বাহিনী র‌্যাব কর্মকর্তাদের দাবি গ্রেফতারকৃত পাঁচজন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি) সদস্য। তাদের টার্গেট ছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো স্থাপনায় নাশকতা চালিয়ে অস্ত্রশস্ত্র লুট করা।
কারাগার থেকে আদালতে আনা-নেয়ার পথে তাদের নেতাদের কেড়ে নিতে প্রিজন ভ্যানে ভয়ঙ্কর হামলার পরিকল্পনা ছিল বলেও জানান র‌্যাবের কর্মকর্তারা। র‌্যাব কর্মকর্তাদের দাবি তারা চট্টগ্রামে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা নিয়ে সংগঠিত হচ্ছিল এমন তথ্য আগে থেকে ছিল।
গ্রেফতারকৃতরা হলো, হাফেজ আবুজর গিফারি, নূরে আলম, ইফতেশাম আহমেদ, তাজুল ইসলাম ও নাজিম উদ্দিন। এদের মধ্যে প্রথম তিনজনকে কর্নেল হাটের ওই বাড়ি থেকে আটক করা হয়। তার আগে তাজুল ইসলাম ও নাজিম উদ্দিনকে আটক করা হয় একে খান গেইট এলাকা থেকে।
র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের পরিচালক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, চট্টগ্রামে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গিরা সংগঠিত হচ্ছে খবর পাওয়ার পর র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করে। এর ধারাবাহিকতায় বুধবার রাতে নগরীর এ কে খান এলাকা থেকে দুই জনকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কর্নেল হাটের ওই বাড়িতে অভিযান শুরু হয়।
নগরীর সিটি গেইটের অদূরে মুকিম তালুকদার বাড়ি এলাকায় নির্মাণাধীন দোতলা বাড়িতে জঙ্গিরা অবস্থান করছে নিশ্চিত হয়েই বাড়িটি ঘিরে ফেলে র‌্যাব। ওই বাড়ির আশপাশের এলাকায় প্রায় দেড় শতাধিক র‌্যাব সদস্য অবস্থান নিয়ে পুরো এলাকা কর্ডন করে ফেলে। এসময় পুরো এলাকায় এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
লোকজন ভয়ে বাসা-বাড়িতে অবস্থান করে। ততক্ষণে ঢাকা থেকে র‌্যাবের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খানের নেতৃত্বে একটি টিম অভিযানে যোগ দেয়।
র‌্যাব কর্মকর্তারা বাড়ি থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসতে বলে। র‌্যাবের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে ওই বাড়ির বাসিন্দা জঙ্গিরা ভেতরে অবস্থান করে। এক পর্যায়ে তারা দোতলায় আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় র‌্যাব সদস্যরা দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে তিনজনকে পাকড়াও করে। সে বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় অস্ত্র, গুলি, হাত গ্রেনেডসহ বোমা তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম।
অভিযান শেষে বেলা ১১টায় র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, দুই দফায় আটক ওই পাঁচজন হুজির সদস্য। দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকলেও তারা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, প্রথম দফায় আটক তাজুল ও নাজিমের কাছ থেকে দুটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছিল। আর ওই আস্তানায় সাতটি ম্যাগজিন, শতাধিক গুলি, ১২টি হাতে তৈরি গ্রেনেড (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম পাওয়া যায়।
মুফতি মাহমুদ খান বলেন, হুজি সদস্যরা চট্টগ্রামে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে বলে র‌্যাবের কাছে তথ্য ছিল। ওই তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব এ কে খান গেইট এলাকা থেকে তাজুল ইসলাম ও নাজিম উদ্দিন নামে দুজনকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে।
তাদের জিজ্ঞাসাবাদে উত্তর কাট্টলি মুকিত তালুকদার বাড়ি এলাকায় এই আস্তানার কথা জানতে পারেন তারা। সেখানে অভিযান চালিয়ে হাফেজ আবুজর গিফারি, নূরে আলম ও ইফতেশাম আহমেদ নামে তিনজনকে আটক করা হয়। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে হুজি নেতা মুফতি মাঈনুল ইসলামকে যখন আটক করা হয় তখন ঢাকায় তাদের প্রধান সমন্বয়ক তাজুল ইসলামের নাম আসে। সে-ই এখন চট্টগ্রামে হুজিকে সংগঠিত করার চেষ্টায় আছে।
কারাগারে থাকা হুজি নেতা মুফতি হান্নান ও রউফের সঙ্গে নাজিম উদ্দিনের ঘনিষ্ঠতা ছিল বলেও জানান তিনি। র‌্যাব বলছে, আবুজর গিফারি কুষ্টিয়ায় সংগঠনের সমন্বয়ক। নূরে আলম ও এহতেশাম দীর্ঘদিন ধরে হুজির সঙ্গে যুক্ত। তাদের কয়েকজনের বিষয়ে র‌্যাবের কাছে তথ্য ছিল।
স্থানীয়রা জানান, ওই বাড়ির মালিকের নাম মনসুর আহমেদ। তিনি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কর্মচারী। আটক যুবকরা কিছুদিন আগে ওই বাসা ভাড়া নেয়। তাদের গভীর রাতে বাসায় ঢুকতে দেখা যেত।
স্থানীয় কাউন্সিলর অধ্যাপক নিসার উদ্দিন মঞ্জু বাড়ির মালিকের বরাত দিয়ে বলেন, তারা বাসা ভাড়া নেয়ার আগে নিজেদের গার্মেন্টস কর্মী বলে পরিচয় দেয়। পহেলা ডিসেম্বর থেকে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে আসবে বলে জানায়।
নুরুল আলম নুরু নামের একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, সকাল ৬টার দিকে র‌্যাব এসে স্থানীয়দের জঙ্গি আস্তানার কথা জানায়। র‌্যাব কর্মকর্তারা লোকজনকে বাসাবাড়িতে থাকতে বলেন। পরে ওই বাড়ির দরজায় গিয়ে নারীদের বেরিয়ে আসতে এবং পুরুষদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টা দরজায় আঘাত করার পরও তারা সাড়া না দেয়ায় র‌্যাব দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। তবে ওই বাসায় কোনো নারী বা শিশু ছিল না।
মুফতি মাহমুদ বলেন, তারা যখন বেরিয়ে আসতে বলছিলেন, তখনই বাড়ির ভেতরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পরে ভেতরে ঢুকে দেখা গেছে, বেশ কিছু ইলেক্ট্রেনিক ডিভাইস তারা পুড়িয়ে ফেলেছে। অভিযান শেষে ওই বাড়িতে ঢুকে উগ্র মতবাদের কিছু বই, ছাই, বেয়ারিং বল, তার, ছুরি ও চাপাতি দেখতে পান সাংবাদিকরা।
র‌্যাব কর্মকর্তা মুফতি মাহমুদ বলেন, অন্য জঙ্গি সংগঠনের নেতাদের গ্রেফতারের কারণে হুজি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল। এই পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে সংগঠিত করে নাশকতার মাধ্যমে সংগঠনের সদস্যদের উজ্জীবিত করাই ছিল হুজির উদ্দেশ্য।
এর অংশ হিসেবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুট এবং প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে নিজেদের নেতাদের উদ্ধারের পরিকল্পনা ছিল বলে গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার কথাও জানান এই র‌্যাব কর্মকর্তা।
এদিকে ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসেও একই এলাকায় একটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পেয়েছিল র‌্যাব। ওই বাড়ি থেকে পাকড়াও করা হয়েছিল জেএমবির চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমান্ডার জাবেদ ইকলাব মোহাম্মদকে। ওই জঙ্গি আস্তানা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল বিপুল অস্ত্র, গুলি ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম। আটকের পর জঙ্গিরা স্বীকার করেছিল, সেখান থেকে ওই বছরের ২৯ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় এক পুলিশ কনস্টেবল, সাবেক এক ফুটবলারও হামলাকারী জঙ্গি হোসেন মাহমুদ ওরফে হোসেন আলী মারা যান।
বিগত ২০০৫ সালে চট্টগ্রামে তিন দফা বোমা হামলা করে জেএমবি। এরপর কয়েক দফায় তারা চট্টগ্রামে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। সর্বশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নগরীর সদরঘাটে এক ব্যবসায়ীর ৫ লাখ টাকা ছিনতাই করতে গিয়ে নিজেদের ছোড়া গ্রেনেডে মারা যায় দুই জেএমবি জঙ্গি।
পরে নগরীর কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগর থেকে তাদের একটি আস্তানার সন্ধান পায় ডিবি। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় বিপুল হাত গ্রেনেড ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম। ওই রাতেই অভিযানে নিজের গ্রেনেড বিস্ফোরণে মারা যায় জেএমবির শীর্ষ নেতা জাবেদ।
নাশকতার দ্বিতীয় টার্গেট কুষ্টিয়া
এদিকে আটককৃতদের বিষয়ে র‌্যাব আরও কিছু তথ্য দিয়েছে। রাতে র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আটক মোঃ নাজিম উদ্দিন (৩৮) পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তিনি কারাগারে বন্দি মুফতি হান্নান ও মুফতি আব্দুর রউফের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। নাজিম উদ্দিন হুজি’র আর্থিক বিষয়ে যাবতীয় লেনদেন এবং চাঁদা সংগ্রহ করতেন। ১৯৯৮ সালে মুফতি আব্দুর রউফ এবং মুফতি হান্নানের সাথে নাশকতার পরিকল্পনাসহ জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য চট্টগ্রামের একটি স্থানে মিলিত হয়েছিলেন। নাজিম উচ্চ শিক্ষিত এবং তথ্য-প্রযুক্তিতে যথেষ্ট পারদর্শী।
হাফেজ মোঃ আবু জর গিফারী (২২)  সম্পর্কে বলা হয়, তিনি হুজিবি’র কুষ্টিয়ার সমন্বয়ক।  ২০১০ সাল থেকে জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। কুষ্টিয়াতে তার বাসায় বিভিন্ন সময় ইতিপূর্বে গ্রেফতারকৃত তথাকথিত একিউআইএসএর প্রধান সমন্বয়ক মাওলানা মাইনুল ইসলামসহ হুজি’র অন্যান্য নেতাদের গোপন বৈঠক হয় এবং বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রামের গভীর অরণ্যে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে বলে জানা যায়।
মোঃ নুরে আলম ইসলাম (২২) নীলফামারীতে কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তিনি মুফতি মাইনুল ইসলাম কর্তৃক পরিচালিত “৩১৩ বদরের সৈনিক” নামক জঙ্গি গ্রুপের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং মুফতি মাইনুল ইসলাম সদলবলে র‌্যাব কর্তৃক গ্রেফতারের পর কিছুদিন নিস্ক্রিয় থাকার পর পুনরায় জঙ্গি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ শুরু করেন।
শেখ ইবতিসাম আহমেদ ওরফে সামী (২৩) একসময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের কর্মী ছিল। তিনি ২০১৩ সাল থেকে হুজি’র জঙ্গি সংগঠনের সাথে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। তিনি মূলত হুজি সদস্যদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন নামে গ্রুপ তৈরি করতেন এবং হুজির সঙ্গে সকল সক্রিয় সদস্যদের সঙ্গে সংগঠনের বিভিন্ন নির্দেশনা শীর্ষ স্থানীয় নেতার নির্দেশে সবার কাছে পৌঁছে দিতেন।
র‌্যাব জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেছে চট্টগ্রামে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনায় জঙ্গি আক্রমণ করে অস্ত্র লুট করা এবং পরবর্তীতে জঙ্গি অভিযান পরিচালনা করা তাদের পরিকল্পনা ছিল। আর দ্বিতীয় টার্গেট হিসেবে তারা কুষ্টিয়া জেলা শহরকে বেছে নেয়। ইতিমধ্যে ঐ অঞ্চলের রেকি পর্ব তারা সম্পন্ন করেছে বলে জানা যায়। এছাড়া তারা কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হামলা করার পরিকল্পনাও করেছিল। তাদের আর একটি পরিকল্পনা ছিল প্রিজন ভ্যানে আক্রমণ করে জেলখানায় অবস্থানরত হুজিবি’র শীর্ষ, কেন্দ্রীয় নেতাদের মুক্ত করা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ