Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিক্ষার মান কাঙ্ক্ষিত নয়

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজে উচ্চশিক্ষা

| প্রকাশের সময় : ৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ফারুক হোসাইন : দেশে উচ্চ শিক্ষার প্রসার ঘটলেও মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজ থেকে পাস করা স্নাতকদের শিক্ষার মান কাক্সিক্ষত নয় বলে স্বীকার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে যুগোপযোগী ও বাস্তবসম্মত কারিকুলাম প্রণয়ন, আধুনিক গবেষণাগার, ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা, লিখিত ও মৌখিকভাবে নিজস্ব চিন্তা উপস্থাপন এবং তথ্য-প্রযুক্তির দক্ষতা অর্জনের জন্য কারিকুলামে প্রয়োজনীয় উপাদান সংযোজন করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরামর্শ দিয়েছে কমিশন। ইউজিসি থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে কতিপয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোর শিক্ষার মান এবং এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা স্নাতকদের যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ইউজিসি’র তথ্য অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোর্স শিক্ষকের মাধ্যমে প্রশ্ন প্রণয়ন ও খাতা মূল্যায়ন, বই ও জার্নালে ব্যয় সঙ্কুচিত করা, লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরিতে ব্যয় না করা, শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা কম হওয়া, ট্রাস্টি বোর্ড, সিন্ডিকেট, অর্থ কমিটির সভা নিয়মিত না হওয়া, জবাবদিহিতা না থাকায় শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত হচ্ছে না। অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজগুলোতে পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য শিক্ষকের অভাবে শিক্ষার গুণগতমান উন্নত হচ্ছে না বলে চিহ্নিত করেছে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রের এই নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটি। আর এজন্য উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও রাষ্ট্র মানসম্পন্ন মানবসম্পদ পাচ্ছে না বলে মনে করা হচ্ছে। কমিশন বলছে, শিক্ষার গুণগতমান সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এক পর্যায়ে আনতে হলে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের স্বল্পতা দূরীকরণের পাশাপাশি সকল বিশ্ববিদ্যালয়র জন্য স্টান্ডার্ড কোর্স গাইডলাইন, স্টান্ডার্ড শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের নীতিমাল প্রবর্তন বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত।  
ইউজিসি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে দেশের উচ্চশিক্ষার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, কতিপয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজ থেকে পাস করা স্নাতকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটলেও শিক্ষার প্রত্যাশিত মান নিশ্চিত সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে যুগোপযোগী ও বাস্তবসম্মত কারিকুলাম প্রণয়ন, আধুনিক গবেষণাগার, ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা, লিখিত ও মৌখিকভাবে নিজস্ব চিন্তা উপস্থাপন এবং তথ্য-প্রযুক্তির দক্ষতা অর্জনের জন্য কারিকুলামে প্রয়োজনীয় উপাদান সংযোজন করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরামর্শ দিয়েছে। এ বিষয়ে মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর মোঃ আব্দুল মান্নান বলেন, অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করছে আবার কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমরা গুণগত মানের শিক্ষা পদ্ধতি নিশ্চিত করতে নির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়েছি।
পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের অর্জিত ডিগ্রির মান নির্দেশে মুখ্য ভূমিকা রাখে বলে ইউজিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে পরীক্ষা পদ্ধতির পার্থক্য থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কমিশন। কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। পুরনো (সরকারি) বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুই পরীক্ষক পদ্ধতি চালু রয়েছে। এই পদ্ধতিতে কোর্স শিক্ষক ব্যতীত একজন বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিশেষজ্ঞ) শিক্ষক পৃথকভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে থাকেন। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কি পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ ও খাতা মূল্যায়ন করা হয় তা জানেই না মঞ্জুরি কমিশন। তাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোর্স শিক্ষকই একমাত্র প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে থাকেন। এই পদ্ধতি নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে ইউজিসি। বরং বাইরের একজন বিশেষজ্ঞ দ্বারা প্রশ্নপত্রের মান এবং মূল্যায়নের যথার্থতা যাচাই করা আবশ্যক বলেও উল্লেখ করা হয়।
মান নিশ্চিত করতে মাস্টার্স সীমিত করার পরামর্শ : মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে শুধু মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য এটি সীমিত রাখার পরামর্শ দিয়েছে ইউজিসি। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, চার বছর মেয়াদি স্নাতক ডিগ্রিকে প্রান্তিক ডিগ্রি হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষা-কার্যক্রম কেবলমাত্র বাছাইকৃত মেধাবী স্নাতকদের জন্য উন্মুক্ত রাখাই কাম্য। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এই নীতি অনুসরণ না করায় হতাশা প্রকাশ করে ইউজিসি বলছে, এর ফলেই মাস্টার্স পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার কাক্সিক্ষত গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না এবং সত্যিকারের মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চমানের শিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেক সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় কলেজসমূহে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা এবং যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক না থাকা সত্ত্বেও মাস্টার্স ডিগ্রি প্রোগ্রাম চালু করেছে। ফলে এই মাস্টার্স পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষাদান সম্ভব হচ্ছে না। এই পর্যায়ের ডিগ্রি কেবলমাত্র উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা সমন্বিত প্রতিষ্ঠানে মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য সীমিত রাখার লক্ষ্যে সকল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক্ষের নিকট আহ্বান জানিয়েছে কমিশন। এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ যথাযথভাবে অনুসরণ করা হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণা নিশ্চিত করে বিরাজমান অরাজকতা ও সংশ্লিষ্ট শ্রেণির উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূরীভূত করা সম্ভব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে আরও শক্তিশালী এবং প্রয়োজনীয় লোকবল বৃদ্ধি করে কার্যকর উচ্চশিক্ষা চালু রাখার কথাও জানিয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫ সালের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, উচ্চতর পদগুলোতে পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিলে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার গুণগত মান বর্তমানের চেয়ে আরও উন্নত করা সম্ভব হবে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে অসন্তোষ : শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আদর্শ অনুপাত হিসেবে ১ অনুপাত ৩০ সংখ্যাটি নির্ধারণ করা হয়েছে। রিপোর্টে ৮৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্বিকভাবে এই অনুপাত সন্তোষজনক হলেও কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মঞ্জুরি কমিশন। প্রতিবেদনে দেখা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত সার্বিকভাবে ১ অনুপাত ২৩। তবে ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ এবং তা কাক্সিক্ষত মানের ছিল না বলে মন্তব্য করেছে ইউজিসি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে সিটি ইউনিভার্সিটিতে। এই ইউনিভার্সিটির শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১ অনুপাত ৭৫ (একজন শিক্ষকের বিপরীতে ছাত্র সংখ্যা)। তারপরেই আছে বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম ১ অনুপাত ৫০ জন। এরপর পর্যায়ক্রমে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি ১ অনুপাত ৪৫, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি ১ অনুপাত ৪২, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি ১ অনুপাত ৪১, এশিয়ান উইনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ১ অনুপাত ৩৯, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ১ অনুপাত ৩৫ এবং ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি ১ অনুপাত ৩৪ জন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত বেশি সে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সঙ্কটের বিষয়টি তত বেশি ফুটে ওঠে বলে জানিয়েছে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। যেহেতু শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার বিষয়টি শিক্ষকদের উপর নির্ভর করে সেহেতু শিক্ষক সংখ্যা কম হলে মান নিয়েও প্রশ্ন দেখা দেয়। একইভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বই, জার্নাল ও অডিওভিজুয়াল এর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও তা প্রত্যাশিত সংখ্যায় নয় বলে মন্তব্য করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বোর্ড অব ট্রাস্টি, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল ও অর্থ কমিটির সভা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় শিক্ষার মান নিশ্চিত করা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত হচ্ছে না বলেও ইউজিসি’র পক্ষ থেকে বলা হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ