Inqilab Logo

সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

চাঞ্চল্যকর মামলা তদন্তে গলদ চট্টগ্রামে ২ বছরে ১৪২টির অধিকতর তদন্তের নির্দেশ

| প্রকাশের সময় : ৭ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : বন্দর নগরীর ষোলশহর ২নং গেইট এলাকায় কলেজ ছাত্র কামরুল হাসান ও পোশাক শ্রমিক ফোরকানকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যার পর লাশ দু’টি নির্মাণাধীন একটি বাড়ির সেফটি ট্যাঙ্কে ফেলে দেয়া হয়। ওই ট্যাঙ্কের পাশে একটি বড় বাঁশের মাথায় ঝুলিয়ে দেয়া হয় ওই দুই যুবকের রক্তমাখা শার্ট। শার্ট দেখে স্বজনেরা সেখানে লাশের সন্ধান পান। ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ পুলিশ লাশ দু’টি উদ্ধার করে। এ জোড়া খুনের ঘটনায় কলেজ ছাত্র কামরুলের বাবা আব্দুল হাকিম বাদী হয়ে ৯ জনের নাম উল্লেখ করে খুলশি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ তদন্ত শেষে পুলিশ এই মামলায় চার্জশিট দাখিল করে। চার্জশিটে ‘ঠিকানা’ পাওয়া যায়নি এমন অজুহাতে এজাহার নামীয় দুই আসামিকে বাদ দেয়া হয়।
আবার এজাহারে থাকা ভুট্টো ওরফে রাসেল (২০) নামে এক আসামির বদলে নূর আলম ওরফে ভুট্টো (৪০) নামে নিরপরাধ এক রিকশা চালককে আসামি করা হয়।
বাদীপক্ষের নারাজির পর আদালত আলোচিত মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশে অধিকতর তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই কর্মকর্তারা চার্জশিট থেকে বাদ দেয়া এজাহার নামীয় দুই আসামিকে ধরে আনেন। পাকড়াও করেন আসলও ভুট্টোকেও। আর এর মধ্যে জোড়া খুনের অপবাদ নিয়ে আড়াই বছরের বেশি সময় কারাগারে থাকতে হয় হতভাগ্য রিকশা চালককে। তার স্ত্রীর অভিযোগ বায়েজিদ থানার এক সোর্সকে চাঁদা না দেয়ায় তার স্বামীকে জোড়া খুনের আসামি বানিয়ে দেয় পুলিশ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীর অনুপস্থিতিতে পথে বসেন ভুট্টোর পরিবারের সদস্যরা।
ষোলশহরের ওই জোড়াখুন মামলার মতো চট্টগ্রামে আলোচিত অসংখ্য মামলা তদন্তে পুলিশের বিরুদ্ধে জালিয়াতি, দুর্নীতি ও গাফিলতির অভিযোগ বাড়ছে। নানা গলদ, অসঙ্গতি আর ক্রটি রেখেই দেয়া হচ্ছে অভিযোগপত্র। গত দুই বছরে এরকম ১৪২টি মামলার অভিযোগপত্রে ক্রটি পেয়েছে আদালত। তাই এখন এসব মামলার অধিকতর বা পুনঃতদন্ত চলছে আদালতের নির্দেশে। এমন দায়সারা তদন্তের জন্য রাজনৈতিক চাপ, সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তাদের অসততা, পেশাদারীত্বের অভাব এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যথাযথ তদারকির অভাবকে দায়ী করছেন আইনজীবীরা।
আইনজীবীদের মতে, মামলা তদন্তে ত্রæটির কারণে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হচ্ছে না। প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। আবার দফায় দফায় তদন্তের ফলে বিচার নিষ্পত্তিতে বেশি সময় লাগছে। বিচারপ্রার্থী এবং অভিযুক্তরাও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। একটি মামলার তদন্ত শেষ হতেই বছরের পর বছর পার হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমছে। আদালতের পিপি ও আইনজীবীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বেশির ভাগ মামলায় পুলিশ আসামিদের ঠিকানা পাওয়া যায়নি এমন অজুহাতে তাদের অভিযোগ থেকে বাদ দিচ্ছে। আর এজাহারে নাম নেই এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও চার্জশিট দেয়া হচ্ছে।
২০১৩ সালে ২৫ অক্টোবর নগরীর ইস্পাহানি মোড়ে পুলিশের সাথে সংর্ঘষের ঘটনায় একটি মামলা করে পুলিশ। সে সময় ৩০ জনকে আটক করে দফায় দফায় রিমান্ডে নেয়া হয়। তবে ঠিকানা পাওয়া যায়নি এমন অজুহাতে ৬ জনকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
তাতে আপত্তি দেন সরকারি কৌসুলি। তিনি জানান, ঠিকানা পাওয়া যায়নি বলে পুলিশ যাদের বাদ দিয়েছে, তারা ওই মামলার পর উচ্চ আদালত এবং চট্টগ্রামে আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়েছেন। আদালতেই তাদের ঠিকানা আছে।
এই মামলার মতো গত একবছরে নগরীর বিভিন্ন থানা থেকে দেওয়া ৪০টি অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে আপত্তি দেন মহানগর পিপি। এর বাইরে ২০১৪ থেকে চলতি মাস পর্যন্ত ১৪২টি মামলার অভিযোগপত্রে ত্রæটি থাকায় অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন বিভিন্ন আদালত। যার মধ্যে ১১৯টি মামলা দেয়া হয়েছে পিবিআই, সিআইডি, ডিবিসহ বিশেষায়িত সংস্থাকে।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলিরা বলছেন, পুলিশ যে অভিযোগপত্র বা তদন্ত প্রতিবেদন দিচ্ছে তার বেশির ভাগ দায়সারা। যা অভিযোগ প্রমাণে যথেষ্ট নয়। আদালতে দাখিলের আগে এমন ভুলত্রæটি বা অসঙ্গতি নজরে এলে পিপিরা তা ফেরত পাঠাচ্ছেন। আবার অনেক মামলার অভিযোগপত্র পিপিদের চোখ এড়িয়ে আদালতে চলে যাচ্ছে। কিছু মামলা বাদীর নারাজির প্রেক্ষিতে অধিকতর তদন্তে যাচ্ছে। কোনো কোনো মামলা আদালত উদ্যোগী হয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য ফেরত দিচ্ছেন বলে জানান আইনজীবীরা।
আইনজীবীরা বলছেন, পুলিশে এখন লোকবল ও প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। প্রতিটি থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) পাশাপাশি একজন করে পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) দেয়া হয়েছে। তাদের মূল কাজ হলো থানার মামলা তদন্ত কার্যক্রম তদারক করা। কোনো মামলার বিশেষ করে আলোচিত কোনো মামলার তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দেয়ার আগে থানার ওসি, সংশ্লিষ্ট জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) ও উপ-কমিশনারদের (ডিসি) মতামত নেয়ার বিধান আছে। সবশেষে সংশ্লিষ্ট আদালতের পিপিদের মতামত নিয়েই আদালতে চার্জশিট দেয়া হয়। এতকিছুর পরও মামলার চার্জশিটে ব্যাপক ভুলত্রæটি ধরা পড়াকে অস্বাভাবিক বলছেন সিনিয়র আইনজীবীরা।
এ প্রসঙ্গে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও চট্টগ্রামের সাবেক পিপি কফিল উদ্দিন চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, সঠিক তদন্তের উপর নির্ভর করে ন্যায়বিচার। মামলা তদন্তে যদি গলদ থাকে তাহলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় না, প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। সরকার ও রাজনৈতিক চাপ, সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ নানা কারণে পুলিশ কর্মকর্তারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ দায়িত্বপালন করতে পারেন না বলেই আলোচিত মামলার তদন্তে গলদ থেকে যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। এর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের অসততা, পেশাদারিত্বের অভাব এবং অযোগ্যতাও দায়ী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ