Inqilab Logo

রোববার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

রায়পুরে দখল ও দূষণে মৃতপ্রায় ডাকাতিয়া নদী

রায়পুর (লক্ষ্ণীপুর) উপজেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৪:২৪ পিএম

লক্ষ্ণীপুর জেলার রায়পুর উপজেলায় প্রবহমান এক সময়ের খরস্রোতা ডাকাতিয়া নদী এখন নাব্যতা হারিয়ে মরা খালে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। নদীর বিভিন্ন অংশ দখল করে স্থাপনা নির্মাণ, ময়লা আবর্জনা ফেলে পানির প্রবাহ বন্ধ করা, তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া এবং বিপুল পরিমাণ কচুরীপানা জন্মে নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এক সময়ের যৌবনবতী ডাকাতিয়া নদী এখন মৃতপ্রায়। নদীর দখল হয়ে যাওয়া অংশ উদ্ধার, আবর্জনা ফেলা বন্ধ করা, প্রয়োজনে তলদেশ খনন ও কচুরীপানা পরিস্কার করাসহ প্রয়োজনীয় সংস্কারের কোন উদ্যোগ না থাকায় একদিকে প্রভাবশালীরা নদীর পাড় দখল করে গড়ে তুলছেন দোকানপাট ও ঘরবাড়িসহ নানাবিধ স্থাপনা অন্যদিকে স্থানে স্থানে নির্বিচারে নদীতে ফেলা হচ্ছে নানারকম ময়লা আবর্জনা। পানিপ্রবাহ প্রায় বন্ধ থাকায় ময়লা আবর্জনা পঁচে দূষিত হচ্ছে পানি ও পরিবেশ, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র। আবার নদীর সিংহভাগই এখন কচুরিপানার দখলে। ফলে যে ডাকাতিয়া এক সময় নৌ চলাচলের জন্য বিখ্যাত ছিল সে ডাকাতিয়ায় নৌযান চলতে দেখতে পাওয়াটাই এখন বিরল সৌভাগ্যের ব্যাপার। ঢাকা ও চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন শহর ও নৌ বন্দর হতে মালামাল পরিবহনের জন্য এক সময় পুরো রায়পুরবাসী এই নদী পথের উপর নির্ভরশীল থাকলেও এখন এই নির্ভরতা নেমে এসেছে প্রায় শূণ্যের কোঠায়। ফলে এক সময়ের মহা গুরুত্বপূর্ণ ডাকাতিয়া নদীর গুরুত্ব এখন নেই বললেই চলে।


জানা যায়, ডাকাতিয়া নদী বাংলাদেশ ও ভারতের একটি আন্ত:সীমান্ত নদী। এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের লক্ষ্ণীপুর, চাঁদপুর ও কুমিল্লা জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪১ কিলোমিটার ও গড় প্রস্থ ৬৭ মিটার। এ নদীর গতিপথ সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃক নদীটির প্রদত্ত পরিচিতি নং : দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের নদী নং- ০৭। লোকমুখে জানাযায় এক সময় ডাকাতিয়া নদী তীব্র খরস্রোতা নদী ছিল। মেঘনার এই শাখানদীতে মেঘনার উত্তাল রুপ ফুটে উঠত। স্রোতের তীব্রতায় প্রায়শই নদীর দু’পাড়ে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হত। নদীগর্ভে হারিয়ে যেত ঘর বাড়ি আর ফসলের মাঠ। নদীর স্রোতের তীব্রতায় প্রায়ই ঘটত নৌ-দূর্ঘটনা, সলিল সমাধি ঘটত বহু মানুষের। ডাকাতের মতো সর্বগ্রাসী হওয়ায় মানুষ এ নদীর নাম দেয় ‘ডাকাতিয়া নদী’।

এক সময় ডাকাতিয়া নদী ছিল ল²ীপুরের রায়পুর, চাঁদপুর ও দক্ষিণ কুমিল্লার বেশ কয়েকটি উপজেলার মানুষের কাছে আশির্বাদ। এটি ছিল তাদের ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা ও মালামাল আনা-নেয়ার প্রধান মাধ্যম। একসময় এই নদীপথ ব্যবহার করে ভোলা, বরিশাল, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, নারায়নগঞ্জ, নরসিংদী ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মালামাল পরিবহন করা হতো। একস্থান হতে অন্যস্থানে যাতায়াতের জন্যও মানুষ ব্যবহার করতেন ডাকাতিয়া নদীপথ। ডাকাতিয়ায় চলাচল করত বড় বড় যাত্রীবাহী লঞ্চ, মালবাহী নৌকা ও ট্রলার। শুষ্ক মওসুমে নদীতীরের কৃষকরা ফসল আবাদের জন্য পেতেন ডাকাতিয়ার পানি। নদীতে ছিল দেশীয় মাছের প্রাচুর্য। এমনিভাবে ডাকাতিয়া ছিল এ অঞ্চলের বহু মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস। এক সময় রায়পুর, চাঁদপুর ও কুমিল্লার মানুষের নিকট এ নদী আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচিত হলেও কালের পরিক্রমায় এখন তা যেন এক পরিত্যক্ত জলাধার।

মূলতঃ ডাতিয়া নদীকে ঘিরেই রায়পুরের কৃষি ও কৃষিভিত্তিক ব্যবসা বাণিজ্যের বিকাশ। আজকের রায়পুর যে সকল কারণে বিখ্যাত তার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ডাকাতিয়া নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল এশিয়ার বৃহত্তম ‘রায়পুর মৎস প্রজনন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’। প্রতি বছর ডাকাতিয়ায় অবমুক্ত করা হত লক্ষ লক্ষ রেনু পোনা, যা মুক্ত জলাশয়ে বেড়ে উঠে নদীতীরের মানুষের মাছের চাহিদা পূরণ করত। ডাতিয়ায় মাছ শিকার করে জীবন নির্বাহ করতেন শত শত জেলে পরিবার। কিন্তু মৃতপ্রায় ডাকাতিয়ায় মাছের উৎপাদন না থাকায় এখন জেলেরা পেশা পরিবর্তনের সংগ্রামে লিপ্ত। ডাকাতিয়ায় এখন আর শোনা যায়না যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচলের আওয়াজ, দেখা যায়না রঙ্গীন পালতোলা নৌকার দৃষ্টি নন্দন আনাগোনা, শোনা যায়না মাঝি-মাল্লাদের ভাটিয়ালী ও জারি-সারি গানের সুর। শহর-গ্রামের বাজারগুলোর নদীর ঘাটে নেই শ্রমিক-কুলিদের মালামাল উঠানো নামানো নিয়ে হাঁক-ডাক। নদীতীরে নেই নির্মল বাতাস। প্রানবন্ত ডাকাতিয়া যারা দেখেছেন তাঁদের কাছে এই ডাকাতিয়া যেন এক ‘অভিশপ্ত দীর্ঘশ^াস’।

কিছুদিন আগে ‘ডাকাতিয়া সুরক্ষা আন্দোলন’ এই নদী দখল ও দূষনমুক্ত করার লক্ষ্যে রায়পুর পৌর শহরে মানব বন্ধন করেছেন। তাঁদের আহŸান, ‘ডাকাতিয়া নদী দখল ও দূষনমুক্ত করার জন্য সরকারী, বেসরকারী ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।’

রায়পুর উপজেলা নদী রক্ষা টাস্কফোর্সের আহŸায়ক ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) রাসেল ইকবাল বলেন, ‘ভরাট ও অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়া নদী পুনরুদ্ধারের জন্য অচিরেই অভিযান পরিচালনা করা হবে।’

রায়পুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মামুনুর রশীদ বলেন, ‘দখল হয়ে যাওয়া নদীতীর পুনরুদ্ধার ও নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে রায়পুরের দৃশ্যপট পাল্টে যাবে বলে মনে করি।’



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ