Inqilab Logo

বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আর্থিক অসময়েও ফেঞ্চুগঞ্জ সারখানার দেড়শ কোটি টাকার স্ক্র্যাপ মালামাল নিয়ে উদাসীন কর্তৃপক্ষ !

সিলেট ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৩:৪০ পিএম

দেশজুড়ে আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ উৎকন্ঠা। চলছে কৃচ্ছতা সাধনের নানা প্রক্রিয়াও। ভবিষ্যত নিয়ে শংকিত দেশবাসী। কিন্তু এর মধ্যে আর্থিক নানা খাত পড়ে রয়েছে অযত্নে অবহেতলা ও সিদ্ধান্তহীনতায়। বিশেষ করে ‘সরকারী মাল দরিয়া মে ঢাল’ আপ্ত বাক্যটি নমুনা বিভিন্ন পর্যায়ে। ব্যক্তগত হলে সুরক্ষার কত দেয়াল সৃষ্টি হতো। কিন্তু সরকারী কে দেখবে ? প্রশ্ন হলো দেখার লোক কি নাই। আছে সেই লোকগুলো আমলাতান্ত্রিক জটিলার প্যাঁচে গা ছাড়া। এভাবে আর কত দিন ? শেষ কি হবে না, এমন প্রশ্ন সিলেটের শিল্প নগরীর সচেতন ফেঞ্চুগঞ্জবাসীর। দেশের সবচাইতে প্রাচীন ন্যাচারাল গ্যাস ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরী (এনজিএফএফ) কারখানা এ এলাকায় । কারখানাটি পরিত্যক্ত ঘোষিত হবার পরও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে কারখানার স্ক্র্যাপ মালামাল অপসারণ প্রক্রিয়া। এ অবস্থায় কারখানাটির প্রায় দেড়শ কোটি টাকার মালামাল পড়ে আছে অরক্ষিত অবস্থায়। স্থানীয়দেও ধারনা বেড়ায় ধান খাচ্ছে, রক্ষকদের সহযোগীতায় চুরি হচ্ছে অনেক মূল্যবান মালামাল। কিন্তু যেন সবাই বেখবর!


১৯৬১ সালে তৎকালীন সর্ববৃহৎ ইউরিয়া সার কারখানা ন্যাচারাল গ্যাস ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরীটি প্রতিষ্টিত হয় সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে। এর আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়ায় ২০১৬ সালের ৩০ জুন। এর কারখানাটি ঘোষণা করা হয় বিলুপ্ত। বিকল্প হিসেবে পার্শ্ববর্তী স্থানে নতুন ভাবে স্থাপিত শাহজালাল সার কারখানার অধীনে এই প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় জনবল ন্যস্ত করা হয়। বিসিআইসি-এর ব্যবস্থাপনাধীন শাহজালাল সার কারখানাটি বর্তমানে পুরোদমে উৎপাদনে আছে। অপরদিকে, বিলুপ্ত ঘোষিত ন্যাচারাল গ্যাস ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরীটি (এনজিএফএফ)-এর কারখানার স্টিল স্ট্রাকচার ও পরিত্যক্ত মালামাল স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী শিল্প মন্ত্রণালয় এই পুরাতন সার কারখানার স্ক্র্যাপ মালামাল অপসারণের লক্ষ্যে এনজিএফএফ স্ক্র্যাপ ডিসপোজাল কমিটি নামের উচ্চ কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ১০ সদস্যের একটি কমিটি ঘোষণা করে। এই কমিটি সার কারখানাটির স্ক্র্যাপ মালামাল ৭টি শ্রেণীতে ভাগ করে মূল্য সকল পণ্যে মোট মূল্য নির্ধারণ করে ৯৮,৮৫,৪৭,৫২৩ টাকা। পরবর্তীতে এই মালামাল বিক্রির জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। প্রথম দফায় আহ্বান করা এই টেন্ডারে সর্বোচ্চ দরদাতা হয় সিলেটের একটি প্রতিষ্ঠান- মেসার্স আতাউল্লাহ। তারা ১০৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা মূল্যে কারখানাটির পরিত্যক্ত মালামাল কিনে নেয়। কিন্তু, পরবর্তীতে মেসার্স আতাউল্লাহ টেন্ডারের শর্ত পূরণ করতে না পারায় তাদের অনুকলে প্রদত্ত বিক্রয়াদেশ বাতিল করা হয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালের ২৫ মে এনজিএফএফ এর স্ক্র্যাপ মালামাল অপসারণের লক্ষ্যে ২য় দফা টেন্ডার আহ্বান করা হয়। ২য় দফার টেন্ডারে মোট ১৪টি দরদাতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮টি প্রতিষ্ঠান যথাযথ কাগজপত্র দাখিল করতে না পারায় ৬টি প্রতিষ্ঠানের দাখিলকৃত দরপত্র পর্যালোচনার জন্য গ্রহণ করা হয়। এই ৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বোচ্চ দরদাতা হয় ঢাকার মেসার্স আল মামুন ট্রেডার্স। তারা স্ক্র্যাপ মালামালের জন্য ১৩১ কোটি টাকা দর প্রদান করে। ১ম দফা দরপত্রের সর্বোচ্চ দরদাতা মেসার্স আতাউল্লাহর চেয়ে ২য় দফায় প্রায় ২৮ কোটি টাকা বেশী মূল্য প্রদান করে। ফলে, বিগত ৯ আগস্ট ২০২১ তারিখে টেন্ডার প্রক্রিয় সম্পন্ন করে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে আল মামুন ট্রেডার্সকে কার্যাদেশের পাওয়ার যোগ্য হিসেবে ঘোষণা করে সংশ্লিষ্ট কমিটি। ফলে, টেন্ডারের যাবতীয় শর্ত পূরণ করে মেসার্স আল মামুন ট্রেডার্স সরকারের তহবিলে প্রয়োজনীয় অর্থও জমা দিয়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত ১০ সদস্যের কমিটি সর্বোচ্চ দরাদাতা মেসার্স আল মামুন ট্রেডার্সকে কার্যাদেশ প্রদানের জন্য প্রেরণ করেছে সুপারিশও। কিন্তু, টেন্ডার আহ্বানের প্রায় দেড় বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে কার্যাদেশ পায়নি মেসার্স আল মামুন ট্রেডার্স।

মেসার্স আল মামুন ট্রের্ডাসের স্বত্বাধিকারী আব্দুর রহিম খান বলেন, তারা সকল শর্ত পূরণ করে টেন্ডারে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে বিবেচিত হয়ে ওয়ার্ক অর্ডার পাওয়ার জন্য মনোনীত হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কমিটি তাদেরকে ওয়ার্ক অর্ডার দেয়ার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশও করেছে। কিন্তু, রহস্যজনক কারণে এখন পর্যন্ত তাদেরকে কার্যাদেশ বা ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হচ্ছে না। টেন্ডারের জন্য ইতোমধ্যে তার প্রতিষ্ঠান ৩ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার পে-অর্ডার দাখিল করেছে। যা গত এক বছর ধরে জমা রয়েছে সরকারী তহবিলে।

এদিকে, দীর্ঘ ১ বছরেও স্ক্র্যাপ ডিসপোজাল কমিটির সুপারিশ মতে আল মামুন ট্রেডার্সকে কার্যাদেশ না দেয়ায় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দাখিল করা হয় হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনও। এই রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদেরকে কারণ দর্শানোর নির্দেশও প্রদান করে। কিন্তু, এর পরও আমলতান্ত্রিক জটিলতায় ঝুলে আছে কার্যাদেশ প্রদানের বিষয়টি। দীর্ঘ ১ বছরেও এনজিএফএফ-এর স্ক্র্যাপ মালামাল অপসারণ প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ার সুযোগে এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীর যোগসাজসে নিয়মিত চুরি হচ্ছে পরিত্যক্ত মালামাল।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে শাহজালাল সার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক জানান, ৩য় দফায় টেন্ডার আহ্বানের বিষয়টি বিবেচনা করছে মন্ত্রণালয়। টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার কারণে স্ক্র্যাপ মালামাল চুরি যাওয়ার আশঙ্কা আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে।

স্থানীয় সহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র মতে, পরিত্যক্ত এই সার কারখানার মালামাল নিয়মিত চুরি হচ্ছে। ফলে, সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্বহানির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। টেন্ডারে কাঙ্খিত মুল্য উদ্ধারের নামে একটি মহল আমলাতিন্ত্রক জটিলা সৃষ্টি করে মূল্যবান মালামাল চুরির মাধ্যমে পকেটভারীতে লিপ্ত। তারা বলছেন পরিস্থিতি এভাবে থাকলে, দেখা যাবে বেড়ার (রক্ষকদের) পেটে চলে গেছে মূল্যবান মালামাল। তখন টেন্ডার আহবানের সুযোই থাকবে না হয়তো! তারা বলছেন, কথিত কর্তৃপক্ষের হাভভাবে মনে হচ্ছে, মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। মাসিরাই গোপন লোপাঠে ব্যস্ত, একদিন দেখা যাবে কিছুই অবশিষ্ট নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ