Inqilab Logo

শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

পঞ্চাশ শয্যার হাসপাতাল এখন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিণত

রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স

| প্রকাশের সময় : ৫ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

খলিল সিকদার, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) থেকে  : সরকারি হাসপাতাল হলেও নেই অ্যাম্বুলেন্স চালক, ঔষধ সংকট, প্যাথলজি যন্ত্রাদি বিকল, রেডিওগ্রাফির ফ্লিম সংকট, মেয়াদোত্তীর্ণ ডায়াবেটিস গ্লুকোমাচেক, রক্ত পরীক্ষা না করাসহ নানা সংকটের মধ্যে সাধারণ রোগীরা বিনামূল্যের সরকারি চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হচ্ছে বলে জানা গেছে। এমন চিত্রই দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার একমাত্র ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে। আইনি বাধ্যবাধকতা ছাড়া কোনো রোগী এ হাসপাতালে  চিকিৎসা নিতে আসছেন না। তারপরও থানা পুলিশের মামলা সংক্রান্ত সনদ বিষয়ে স্থানীয় নানা ঘটনায় আহত রোগীরা বাধ্য হয়ে এ হাসপাতালে ভর্তি হলেও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্র না থাকায় গুরুতর যখম হওয়া রোগীরা উল্টো হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কেউ কেউ পথেই মারা যাচ্ছেন সঠিক সময়ে চিকিৎসার অভাবে। নারায়ণগঞ্জের বৃহৎ আয়তনের উপজেলাটি শীতলক্ষ্যা উভয় পারের ৭টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভার রোগী পরিবহনের জন্য রয়েছে একটিমাত্র অ্যাম্বুলেন্স। কিন্তু তাতেও চালক না থাকায় দেড় মাস যাবৎ বন্ধ রয়েছে অ্যাম্বুলেন্স সেবাটি। ফলে এ এলাকার রোগীরা পাচ্ছেন না অ্যাম্বুলেন্স সেবা।  নুন আনতে পানতা ফুরানোর ন্যায় অ্যাম্বুলেন্স চালক না থাকলে যেমন এখন বন্ধ রয়েছে তেমনি চালক থাকলে অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করতে লেগে যায় প্রায় মাস। আর এভাবেই অ্যাম্বুলেন্সসেবা বঞ্চিত হয় রোগীরা। হাসপাতাল অভ্যন্তরে রেডিওগ্রাফির কক্ষে নেই রোগী। কোলাহলহীন কক্ষ বিষয়ে জানতে চাইলে এ বিভাগে  দায়িত্বে থাকা সেলিনা বেগম জানান, রেডিওগ্রাফির যন্ত্র থাকলেও ফ্লিম না থাকায় বিগত ২ বছর যাবৎ বন্ধ রয়েছে এক্সরে সেবা। মাঝেমধ্যে ফ্লিম থাকলেও বিকল হয়ে পরা রেডিওগ্রাফির যন্ত্রটির মেরামতে সময় লাগে ৩ থেকে ৪ মাস। সূত্র জানায়, এসব বিষয়ে রোগীরা হতাশা ও বাধ্য হয়েই ভর্তি হয় বেসরকারি হাসপাতালে। অন্যান্য হাসপাতালে ডিজিটাল এক্সরে মেশিন থাকলেও এ হাসপাতালে নেই তা। ফলে উন্নত চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ দরিদ্র রোগীরা। অন্যদিকে আল্ট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র, টাইফয়েড টেস্ট যন্ত্র, বাতজ্বর, হেপাটাইটিস যন্ত্রাদির সংকট থাকায় প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এ হাসপাতালটি। একটু জটিল হলেই রেফার্ড করেন অন্যত্র। তাই হাসপাতালটির প্রতি স্থানীয়দের আস্থাহীনতা দেখা গেছে। খুব ঠেকায় পড়ে আসেন এখানে সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশির চিকিৎসা নিতে। গরিব মায়েরা তাদের নরমাল ডেলিভারি এখানে করান। তবে সিজার পদ্ধতিতে সন্তান প্রসবকারী মায়েদের এখানকার চিকিৎসা বিষয়ে অভিযোগের শেষ নেই। সবকিছু বাইরে থেকে কিনে আনতে বাধ্য হন তারা। গুতিয়াব এলাকার রোগী নাছিমা আক্তার জানান, এখানকার নার্সদের আচরণও ভালো না। রোগীদের কাছ থেকে বকশিশ দাবি করে। আর সব ঔষধ বাহিরের দোকান থেকে কিনে আনতে হয়। প্যাথলজি বিভাগে দায়িত্বরত আলমগীর কবির বলেন, বায়োক্যামিস্ট্রি এনালাইসিসসহ নানা সরঞ্জামাদির সংকট রয়েছে। মেয়াদহীন গ্লুকোমা চেক থাকায় ডায়াবেটিস রোগীদের পরীক্ষা নিরীক্ষাও করতে পারছেন না। এসব সংকট নিরসনে বিলম্বতার বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি। হাসপাতাল অভ্যন্তরের স্টোর রুমে ট্রেট্রাসাইক্লিন জাতীয় ঔষুধ পর্যাপ্ত মজুদ থাকলেও শিশু রোগ বিভাগের তারল্য ঔষধের দেখা মেলেনি  হাসপাতালের ফামের্সিতে। ফামের্সি থেকে বিনামূল্যে ঔষধের জন্য ডাক্তারের দেয়া ব্যবস্থাপত্রের অতিরিক্ত ঔষধ প্রদান করতেও দেখা গেছে। তবে ফার্মেসিতে দায়িত্বরত রেবুতি মোহন তরফদার জানান,  মেট্রোনিডাজল, প্যারাসিটামল, এ›ট্টাসিড, ফ্লুক্লক্স জাতীয় অতিব প্রয়োজনীয় ঔষধের সংকট রয়েছে। এছাড়াও ওটির ঔষধ, প্রয়োজনীয় ইনজেকশন, সিজার সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় ঔষধের ভয়াবহ সংকট রয়েছে বলে জানান তিনি। সূত্র আরো জানায়, হাসপাতালের দায়িত্বরত ডাক্তার, নার্স ও কর্মকর্তারা নিয়মিত হাসপাতালে আসেন না বলেও রয়েছে রোগী পরিবারের অভিযোগ। বেসরকারি হাসপাতালে রেফার্ড করে গরিব রোগীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে সরকারি চিকিৎসাসেবা থেকে। ফলে সাধারণ রোগীদের হয়রানির শেষ নেই। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের বেশিরভাগই পুলিশ কেইস সংক্রান্ত। পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা কলহের জেরে সংঘর্ষের ঘটনায় আহত রোগীরা সেবা নিতে আসলেও  ডাক্তারের দেয়া পরামর্শের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতাল থেকে। আর ঔষধ কিনতে হচ্ছে হাসপাতালের দুটির ফটকের পাশে গড়ে ওঠা ঔষধের দোকান থেকে। আলমপুরা এলাকা থেকে আসা খাদিজা আক্তার নামের আহত রোগী জানান, ৪ দিন যাবৎ এ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছি। পারিবারিক অসন্তোষের কারণে তার হাতের বাহুর হাড় ভেঙেছে মনে করে ডাক্তার এক্সরে করার পরামর্শ দেন। তবে এ হাসপাতালে এক্সরে যন্ত্র বিকল থাকায় টাকার অভাবে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে এক্সরে না করিয়েই ব্যথানাশক ঔষধ খাচ্ছেন। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, রোগীদের জন্য  পরিবেশন করা খাবার নিয়েও রয়েছে নানা অসন্তোষ। পাতলা ডাল আর মোটা চালের রান্না করা ভাত ও কমদামি মসলাযুক্ত খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। এ নিয়ে কিছু সচেতন রোগীরা বাক-বিত-ায় জড়ালেও রোগীদের ভয়ভীতি দেখায় হাসপাতালের কর্মরত কর্মচারীরা। হাসপাতাল অভ্যন্তরের পরিবেশগত দিক নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। হাসপাতালের আয়া হিসেবে দায়িত্বরত রিনা বেগম সাজগোজ করে রোগীদের থেকে সিরিয়ালের নাম করে আদায় করেন টাকা। আর হাসপাতালের অভ্যন্তরে পরে থাকে রোগীদের বর্জ্য ও ময়লা-আবর্জনা। তাতে অন্য রোগীরাও দুর্গন্ধের শিকার হয়ে বিরক্ত ও হয়রানি হচ্ছেন। সরেজমিন ঘুরে আরো জানা যায়, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের বেশিরভাগ হতদরিদ্র। ফলে ডাক্তার রোগ শনাক্ত করার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দিলেও এসব পরিবার টাকার অভাবে তা করাতে পারছেন না। ফলে হাসপাতালের প্যাথলজি সেবা সঠিকভাবে চালু না থাকায় টাকার অভাবে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাচ্ছেন না তারা। আর তাতে গরিব ও অসহায় রোগীরা তাদের মৌলিক চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হয়ে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকছেন বাধ্য হয়ে। স্থানীয় লোকজন ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, এ হাসপাতালে আসা রোগীরা কেবল আইনি ঝামেলা এড়াতেই ভর্তি হন। একটি সুবিধাজনক সনদের সুবিধা নিয়ে চলে যায় উন্নত চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে। আর নানা সংকট ও  সমস্যা থাকায় হাসপাতালটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তারা। একই হাসপাতালে উপজেলার দক্ষিণবাগ এলাকার নবী হোসেন নামে এক রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এ সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিস্তারিত জানতে চাইলে হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার অসৌজন্য আচরণ করেন বলে জানান তিনি। এসব বিষয়ে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক্তার জাইদুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে ঔষধ সংকট, প্যাথলজির নানা যন্ত্রাদির সংকট ও অ্যাম্বুলেন্স চালকের গাফিলতি রয়েছে। এসব বিষয়ে ঊর্ধŸতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। এ সময় রোগীদের সাথে কর্তব্যরত চিকিৎসক দুর্ব্যবহার করেন না বলে জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, উপজেলার ৩৯টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্থানীয়দের সঠিকভাবে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তবে এসব যন্ত্রাদির কারণে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাধ্য হয়েই অন্যত্র থেকে করিয়ে আনতে হয় রোগীদের। অতি দ্রুত এ সংকটের সমাধান হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি। তার দাবি, বৃহত্তর রূপগঞ্জ উপজেলার জন্য একটিমাত্র অ্যাম্বুলেন্স যথেষ্ট নয়। তাই অন্তত আরো ২টি অ্যাম্বুলেন্স প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ