Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভাষা দিবসের শিক্ষা

প্রকাশের সময় : ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ ইয়ামিন খান : ২১ ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে ওঠা মহান ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত দিন। বাঙালি জাতিকে ঐক্যের নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধকরণে এই দিনটি সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। তাই এই জাতি সত্যিকার অর্থেই ভোলেনি ভাষার জন্য আত্মদানকারীদের। সময়ের আর্বতে ৬৪ বছর পর আবার যখন আমাদের মাঝে ফিরে আসে ২১ ফেব্রুয়ারির দিনটি তখন সমগ্র শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় মাথা অবনত করে জানা আর অজানা শহীদদের প্রতি। ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করতে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিল তা হচ্ছে ঐক্য। জগতের একটি চিরন্তন ও প্রাকৃতিক নিয়ম হচ্ছে ঐক্য অনৈক্যের উপর বিজয় অর্জন করে। দশজন ঐক্যবদ্ধ লোক একশো জন ঐক্যহীন লোকের ওপর বিজয় লাভ করে যদি ঐ দশজন লোকের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে একতা থাকে। এ চিরন্তন সত্যটি হাজার হাজার বছর আগেও সত্য ছিল হাজার বছর পরেও সত্য হবে। আল্লাহ মুমিনদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “তোমরা শক্তভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ করো, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না” (সূরা ইমরান : ১০৩)। আল্লাহ আরো বলেছেন, “আল্লাহ তাদেরকেই ভালবাসেন যারা গলিত সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ হয়” (সূরা ছ্বফ : ৪)। সুতরাং আল্লাহ প্রদত্ত প্রাকৃতিক নিয়ম মোতাবেক একমাত্র ঐক্যের গুণে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে বিজয় অর্জন করে বাঙালি জাতি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করে চলে যায়। এখানে উল্লেখ্য বিষয় হলো, ইসলামের সুমহান আদর্শ-সাম্য, ন্যায়বিচার, সম্পদের সুষম বণ্টনভিত্তিক ইসলামি জীবনাদর্শ এই অঞ্চলের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দেওয়ার কথা বলে ভারত থেকে স্বাধীন জাতিসত্তা নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় ভূখ-ের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। তারা এক আল্লাহকে সেজদাহ করে, একই দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে; এমনকি একই নবীর উম্মত। অথচ ন্যায়, হক্ব ও সত্য জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না করে ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া জীবনব্যবস্থা প্রবর্তন করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হলো। এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ঈমান তথা ধর্মবিশ্বাসকে ভুল খাতে প্রবাহিত করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে এই ভূখ-ের মানুষদের উপর অন্যায়, অবিচার, অনাচার, জুলুম ও নির্যাতন এবং বৈষম্যমূলক শাসননীতি চাপিয়ে দিয়ে অধর্ম করেছিল। সর্বপ্রথম তারা যে আঘাতটি হেনেছিল সেটি হচ্ছে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রবর্তন করা।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এই স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। বিশেষ করে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রবর্তন করার জন্য কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের ঘোষণার প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ যে আন্দোলনের সূচনা করেছিল তা ভাষা আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ঘোষণা করেন, “একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” এই ঘোষণার পর ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং সারাদেশে দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করতে জীবন উৎসর্গ করেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিকসহ আরো নাম না জানা দেশপ্রেমিক বীরসন্তানেরা। ভাষা আন্দোলনে বাঙালি জাতির যে ইস্পাতকঠিন ঐক্য হয়েছিল তা পরবর্তী সময়ে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সিঁড়ি বেয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত ও শক্তিশালী বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটায়। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল; কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো এর পরও বিগত ৪৪ বছরে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ষড়যন্ত্র একটি দিনের জন্য এই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে দেয়নি বরং ধর্মীয় ও রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন দল-পথ-মতে বিভক্ত করে পরস্পর হানাহানিতে লিপ্ত করে দিল। আজ দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার লক্ষ্যে দেশ ও জাতিকে ভয়াবহ বিপদের মধ্যে নিক্ষেপ করা হচ্ছে।
বিশেষ করে সম্প্রতি এরশাদের জাতীয় পার্টির মধ্যকার অসন্তোষ, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক, বিচার বিভাগকে নিয়ে বিতর্ক, ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত ১/১১ সরকারের সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রতিবেদন প্রকাশ করায় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার ও এর সম্পাদক মাহফুজ আনামকে নিয়ে বিতর্ক এবং সর্বশেষ বিএনপির অফিসের সামনে ছাত্রদলের পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীদের তা-বের দৃশ্য স্বার্থের রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ। আমাদের ঐক্যহীনতার কারণে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এদেশকে ঘিরে ভয়ঙ্কর খেলা যে শুরু করেছে তা দেখা গেছে সম্প্রতি মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানের একটি আশঙ্কার মধ্য দিয়ে। আর তা হচ্ছে, “ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দমন নীতিতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তৎপরতা বাড়তে পারে।” আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ, এই এক টুকরা মাটি; এদেশের মাটিতে আমরা সেজদাহ করি, এদেশে আমাদের পূর্বপুরুষদের অস্তিমজ্জা মিশে আছে। এদেশে আমরা কোদাল নিয়ে ক্ষেতে ফসল ফলাই, তা দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করি; তাই এভাবে হানাহানি করতে করতে ইরাক-সিরিয়ার মতো এদেশকে ধ্বংস করে দিতে পারি না। আজ আমাদের সবাইকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে বিদেশি শকুনদের দৃষ্টি থেকে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষার একমাত্র উপায় ধর্মবিশ্বাসকে মানবতার কল্যাণে কাজে লাগানো এবং ১৬ কোটি বাঙালিকে ধর্মীয়, ঈমানি ও সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে সকল প্রকার অন্যায়, অসত্য, জঙ্গিবাদ এবং অপরাজনীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করা। আর এটাই ভাষা দিবসের শিক্ষা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভাষা দিবসের শিক্ষা

১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
আরও পড়ুন