দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
পূর্ব প্রকাশিতের পর
হোদায়বিয়ার সন্ধি
ষষ্ঠ হিজরি সনে ৬২৮ খ্রিষ্টব্দে রাসুল (সা.) ওমরা পালনের উদ্দেশে ১৪০০ জন সাহাবিসহ মক্কা যাত্রা করেন। মক্কার নয় মাইল দূরে হোদায়বিয়া নামক স্থানে উপনীত হন। কোরাইশরা ওমরা পালনে বাঁধা দেয়। রাসুল (সা.) জানালেন, ‘আমরা যুদ্ধের জন্য আসিনি। শুধু ওমরা করে চলে যাব।’ কিন্তু কোরাইশরা তাতেও রাজি হলো না। রাসুল (সা.) মক্কাবাসীদের কাছে ওসমান (রা.)-কে দূত হিসেবে পাঠান। তার ফিরে আসতে বিলম্ব হওয়ায় তিনি শহিদ হয়েছেন বলে রব ওঠে। রাসুল (সা.) মুসলমানদের থেকে এ হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ নেন। কাফেররা ভয়ে ওসমান (রা.)-কে ফেরত দেয়। সুহাইল আমরকে সন্ধির প্রস্তাব পাঠায়। ১০ বছরের জন্য সন্ধি হয়। এটি হোদায়বিয়ার সন্ধি নামে খ্যাত। সন্ধির শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিল- ১. মুসলমানরা এ বছর ওমরা না করে ফিরে যাবেন। আগামী বছর নিরস্ত্রভাবে তিনদিনের জন্য আসবেন। ২. কোনো মক্কাবাসী মদিনায় আশ্রয় নিলে তাকে মক্কায় ফেরত দিতে বাধ্য থাকবেন। কিন্তু কেউ মদিনা থেকে মক্কায় এলে তাকে ফেরত দেওয়া হবে না। ৩. আরবের যে কোনো গোত্র দুই পক্ষের যে কারও সঙ্গে মিত্রতা করতে পারবে। আপাত দৃষ্টিতে এ সন্ধির শর্তগুলো মুসলমানদের জন্য অপমানজনক হলেও প্রকৃতপক্ষে সুফল বয়ে এনেছিল। এতে কাফেররা মুসলমানদের একটি শক্তিধর স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে মেনে নিয়েছিল। দেশ-বিদেশে ইসলাম প্রচারের সুযোগ হলো। দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করতে লাগল। কোরআনে কারিমে একে প্রকাশ্য বিজয় বলা হয়েছে।
মক্কা বিজয়
হোদায়বিয়ার সন্ধির পর রাসুল (সা.) বিভিন্ন গোত্রে তার দাওয়াতি কর্মসূচি অধিক পরিমাণে বাড়াতে সক্ষম হন। ফলে এক বছরের মাথায় মুসলমানদের সংখ্যা অধিক হারে বৃদ্ধি পেল। এরই মাঝে কোরাইশদের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ বনু বকর মুসলমানদের মিত্র খোজাআ গোত্রের ওপর আক্রমণ করল। এর অর্থ দাঁড়াল, কোরাইশ এবং তার মিত্ররা হোদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করল। রাসুল (সা.) এ সংবাদ পেয়ে অত্যধিক ক্রুদ্ধ হলেন। মক্কা বিজয়ের উদ্দেশে দশ হাজার যোদ্ধার একটি বিশাল সেনাদল গঠন করলেন। তখন ছিল হিজরি অষ্টম বর্ষের রমজান মাস। এদিকে কোরাইশরা রাসুল (সা.)-এর মক্কাভিমুখে অভিযানের সংবাদ পেয়ে তাদের নেতা ও মুখপাত্র আবু সুফিয়ানকে ক্ষমা প্রার্থনা, সন্ধি চুক্তি বলবৎ এবং চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে রাসুল (সা.)-এর কাছে পাঠাল। রাসুল (সা.) তাদের ক্ষমার আবেদন নাকচ করে দিলেন। কারণ তারা অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় না দেখে ইসলাম গ্রহণ করল। অতঃপর সেনাদল মক্কাভিমুখে রওনা হয়ে মক্কার কাছাকাছি এলে মক্কাবাসী বিশাল দল দেখে আত্মসমর্পণ করল। আর রাসুল (সা.) মুসলমানদের সঙ্গে নিয়ে বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করলেন। তিনি বাইতুল্লাহ তওয়াফ করলেন। নিজ হাতের লাঠি দ্বারা কাবার আশপাশে রাখা সব প্রতিমা ভেঙে চুরমার করে দিলেন। স্বীয় রবের শেখানো আয়াত পাঠ করতে লাগলেন, ‘বলো, সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে, নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৮১)। অতঃপর রাসুল (সা.) সবার উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। ঘোষণা করলেন, ‘মক্কা পবিত্র ও নিরাপদ।’
বিদায় হজ
দশম হিজরিতে রাসুল (সা.) মুসলমানদের সঙ্গে নিয়ে হজব্রত পালন ও হজের আহকাম শিক্ষা গ্রহণ করতে মক্কায় যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান। তার আহ্বানে লক্ষাধিক সাহাবি উপস্থিত হলেন। তারা জিলকদ মাসের পঁচিশ তারিখ মক্কার উদ্দেশে রওনা হন। বাইতুল্লাহ পৌঁছে প্রথমে তওয়াফ করেন। অতঃপর জিলহজ মাসের আট তারিখ মিনার উদ্দেশে রওনা হন। এরপর নয় তারিখ জাবালে আরাফা অভিমুখে যাত্রা করেন। রাসুল (সা.) সেখানে অবস্থান করেন। মুসলমানদের উদ্দেশে তার ঐতিহাসিক অমর ভাষণ দান করে তাদেরকে ইসলামি বিধিবিধান ও হজের আহকাম শিক্ষা দেন। আল্লাহতায়ালা বললেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত পরিপূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (সুরা মায়িদা : ৩)।
ইন্তেকাল
বিদায় হজ থেকে ফেরার পর ১১ হিজরির সফর মাসে মহানবী (সা.) জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বরের তাপমাত্রা প্রচণ্ড হওয়ায় পাগড়ির ওপর থেকেও উষ্ণতা অনুভূত হলো। অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি এগারো দিন নামাজের ইমামতি করেন। অসুস্থতা তীব্র হওয়ার পর তিনি স্ত্রীদের অনুমতি নিয়ে আয়েশা (রা.)-এর কক্ষে অবস্থান করতে থাকেন। তার কাছে সাত কিংবা আট দিনার ছিল। মৃত্যুর একদিন আগে তিনি তাও দান করে দেন। অবশেষে ১১ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসের ১ তারিখ ও ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসের ৮ তারিখ সন্ধ্যায় তিনি মহান প্রতিপালকের সান্নিধ্যে চলে যান। এ সময় তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।