Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করতে হবে

উপ-সম্পাদকীয়

| প্রকাশের সময় : ৩ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী : পৃথিবীর সব মানুষই বোধ হয় এখন এক ধরনের মানসিক সংকটে ভুগছে। সংকটটা অনেকখানি এরকম : যা সে করছে তা সে করতে চায় না, যা সে দেখছে তা সে গ্রহণ করতে পারছে না মনেপ্রাণে। নিজের কাজেও নৈতিক সমর্থন পাচ্ছে না সব সময়। নিজের চোখের সামনে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ঘটে যাচ্ছে অনেক কিছু। মূল্যবোধ নিয়ে তৈরি হচ্ছে বড় ধরনের নৈতিক সংকট। সব কিছু দেখে মনে হচ্ছে, মূল্যবোধের কী বিপর্যয়ই না ঘটছে! এই সংকট এখন পৃথিবী জোড়া। আমরা হয়তো ভাবছি সংকটটা কেবল আমাদের মতো অনুন্নত দরিদ্র দেশের। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা জাপানের মতো শিল্পোন্নত দেশেও নৈতিক মূল্যবোধের এই সংকট আজ তীব্র। আমেরিকার মানুষ মনে করে, তাদের মূল্যবোধ যেন কোথায় নেমে যাচ্ছে। নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে সব কিছু। একটি প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকী মূল্যবোধ সম্পর্কে লেখা সম্পাদকীয়টির শিরোনামই দিয়েছে  Vanishing Values : Where have our Values gone? আমেরিকা, জাপান কিংবা ফ্রান্স-বৃটেনের মতো দেশে যখন সমাজের মূল্যবোধ সম্পর্কে প্রশ্ন উঠে তখন বুঝতে হয় সংকটটা নিংসন্দেহে গভীরে। পশ্চিমা উন্নত সমাজকে বলা হয় মুক্ত সমাজ। মানুষ সেখানে নিজের স্বাধীন সত্তা উপলব্ধি করতে পারে। বাধা-নিষেধের প্রাচীরে মানুষকে সেখানে আটকে রাখার চেষ্টা করা হয় না। আবদ্ধ সমাজে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও স্বাধীন মতামতের বিশেষ কোনো মূল্য নেই। সে নানাভাবে সামাজিক বাধা-নিষেধ, সংস্কার ও প্রাচীন ধ্যান-ধারণার কাছে বন্দি। উন্মুক্ত সমাজ মানুষকে এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়েছে। ফরাসি লেখক-দার্শনিকরা বহু আগেই ঘোষণা করেছেন, ‘Man is born free but everywhere he is in chains.’ মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মায়, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত। মানুষের এই শৃঙ্খলিত জীবন সম্পর্কে তাদের মৌলিক চিন্তা হচ্ছে রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্মীয় অনুশাসন সংস্কার, বিশ্বাস, জীবিকা এসব তো আছেই এমনকি বন্দি সে নিজের কাছেও। মানুষের এই শৃঙ্খলিত জীবন জাঁ পল সার্ত্র ও সীমন দ্য বুভ্যোয়ার মতো চিন্তাশীল ব্যক্তিদের গভীরভাবে পীড়িত করেছে। বলা যায় প্রায়, সারা জীবন তারা মানুষের এই অস্তিত্বের মৌলিক সংকট মোচনের লক্ষ্যে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন।
মানুষের সমাজ আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তার জন্য তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে বহু দুর্গম পথ, বহু পাথরের মতো ভারী দিন-রাত্রি। এক-দুই দিনে মানুষের সমাজ এই অবস্থায় পৌঁছেনি। মানুষের এই দুর্গম পথযাত্রায় ও অগ্রগতির দীর্ঘ সময়ে ইতিহাসের অনেক মলিন পৃষ্ঠা ঝরে গেছে। মানব সমাজে সংঘটিত হয়েছে অনেক পরিবর্তন। সেসব পরিবর্তন ও রূপান্তর এমনই ব্যাপক, বিস্তৃত ও বিস্ময়কর যে, হাজার বছর আগের কথা দূরে থাক দুই-তিনশ বছর আগের কোনো মানুষকে যদি এই পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতো, তাহলে বর্তমান পৃথিবীর রূপ ও তার পরবর্তী বংশধর এই মানুষের জীবনযাত্রা দেখে সম্ভবত তার তৎক্ষণাৎ বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকত না। একইভাবে আজকের পৃথিবীর কোনো মানুষকে যদি দুই-তিন শতাব্দী পরের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় তাহলে তার পরিণতি এ ছাড়া আলাদা কিছু হবে না। এটাই হচ্ছে বাস্তব সত্য। পৃথিবী ও সমাজ নিত্য পরিবর্তনশীল। মানুষের সমাজ কোথাও থেমে নেই। প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন এমনই সূক্ষ্ম যা আমরা সর্বক্ষণ অনুভব করতে পারি না। হঠাৎ বহু বছর পর একদিন দেখে চমকে উঠি, ভাবি কোথায় গেল আমাদের সেই সময়, আমাদের সেই সোনালী দিনগুলো? মানুষের একটি সহজাত প্রবণতাই এই যে, সে তার সময়কে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়, মনে করে তার ফেলে আসা দিনগুলোর কোনো তুলনা হয় না। এই অভ্যাস ও প্রবণতার জন্যই পরিবর্তনকে সে সহজে স্বীকার করে নিতে পারে না। তার চোখে সবকিছুই কেমন বেখাপ্পা লাগে। একটি যুগের মূল্যবোধ অন্য যুগে প্রায় অচল হয়ে গেলেও তাকেই সে প্রাণপণে ধরে রাখতে চায়। মানুষের সংস্কার এমনি দুর্বার। সব যুগে সব সময়ই কিছু মানুষ সংস্কারমুক্ত থেকেই যায়। সংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে পরিবর্তিত মূল্যবোধ ও জীবনকে স্বাগত জানাতে পারে দু-একজন মানুষ। রাসেল, সার্ত্র, বুভ্যোয়া ছিলেন তেমনি বিরল ব্যক্তিত্ব।
এবার মূল্যবোধের কথায় আসি। মানুষের সমাজে তার সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক জীবনের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার রুচি, আদর্শ ও মূল্যবোধেরও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এক সময় মানুষ ছিল গভীরভাবে আধ্যাত্মবাদী। তার জীবন, চিন্তাধারা ও মূল্যবোধও ছিল সেভাবেই গড়ে ওঠা। শুধু ব্যক্তিজীবন নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনও ছিল সীমাবদ্ধময়। এই যুগের মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ, রুচি, আদর্শ ও চিন্তাধারার সঙ্গে ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব ও আধুনিক গণতন্ত্রের বিকাশ-পরবর্তী যুগের মানুষের মূল্যবোধ বা নীতি-আদর্শের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য ঘটাই তো স্বাভাবিক। কেবল অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও কৃষিভিত্তিক জীবন ব্যবস্থা ও শিল্প প্রযুক্তির বিকাশ পরবর্তী যুগের মানুষের জীবনাচরণ ও মূল্যবোধের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান লক্ষ্য করাই স্বাভাবিক। অর্থনৈতিক চিন্তা ও দর্শনের ক্ষেত্রেও পৃথিবীতে কত পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। কৃষিভিত্তিক জীবন, যন্ত্র শিল্পের প্রথম যুগ, পরে শিল্প বিপ্লব, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি, পুঁজিবাদ, লেসেকেয়ার, সাপ্লাই সাইন ইকোনমি, বাজার অর্থনীতি এমনি নানা মতবাদ ও চিন্তা  মানুষের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলেছে। এসব প্রভাব এমনি গভীর ও ব্যাপক যে, মানুষের ব্যক্তিজীবনের আদলই প্রায় বদলে গেছে, অনেক নৈতিক মূল্যবোধ ও প্রচলিত বিশ্বাস অচল মনে হয়েছে তার কাছে। গ্যালোলিও ও কোপার্নিকাসের বৈজ্ঞানিক সত্য মানুষের বিশ্বাসের ভিতকেই কাঁপিয়ে দিযেছে দারুণভাবে। তছনছ হয়ে গেছে তার সেই বিশ্বাসের জগৎ। একদিন যে মানুষ বিশ্বাস করত সূর্যই পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে এবং যা সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত দেখতেও পায় সে যখন জানতে পারল যে সূর্য স্থির আর পৃথিবীই ঘুরছে সূর্যের চারদিকে তখন তার এতদিনের অর্জিত বিশ্বাস তারই সামনে ভেঙে খান খান হয়ে গেল। এই সত্যকে স্বীকার করতে অনেক দিন সময় লাগল তার। নিউটন কিংবা আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানুষকে কেবল চমকেই দিল না সে হয়ে পড়ল এসব আবিষ্কার ও সত্যের মুখোমুখি হতচকিত বিহ্বল অনেকটাই বিভ্রান্ত ও বিচলিত। কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা এমনি দ্রুত ও বিস্ময়কর গতিতে অগ্রসর হতে লাগল যে, সেসব কিছু বুঝে ওঠার আগেই চোখের সামনে ঘটে চলল একেকটি অবিশ্বাস্য ঘটনা। প্রথমে তার চোখ ছানাবড়া হলো ঠিকই, কিন্তু এই বিজ্ঞানের সত্যকে অস্বীকার করাও আর সম্ভব হলো না তার পক্ষে। কিন্তু সৃষ্টি হলো মনোজগতের সংকট। সে এই পরিবর্তনকে স্বীকারও করতে পারল না, পুরোপুরি অস্বীকারও করতে পারল না। কারণ তার নিজের জীবনও এই বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত সত্যের জগতের মধ্যেই আবর্তিত। এভাবেই তৈরি হয়েছে বর্তমান পৃথিবীর বিজ্ঞান প্রযুক্তিনির্ভর মানুষের মনোজগতের দ্বন্দ্ব ও সংকট।
মানুষের মনোজগতের এই সংকট আজ শুরু হয়নি। এই সংকট খুবই পুরনো। বলা যায়, প্রায় সব যুগেই মূল্যবোধের এই অবক্ষয় সেই যুগের মানুষকে ভাবিত করে তুলেছে। তারা  শংকিত, উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হয়েছে; মূলবোধের পরিবর্তনকে তারা আখ্যায়িত করেছে অবক্ষয় বলে। এ ঘটনা কিন্তু প্রায় সব যুগেই ঘটতে দেখা গেছে। মানুষের কাছে তার নিজের সময় সবচেয়ে ভালো সময়। এভাবেই মানুষ তার নিজের সময়কে দেখতে অভ্যস্ত। আসলে মানুষের জীবনে কোনো সময়ই খুব বেশি ভালোও ছিল না, খুব বেশি খারাপও ছিল না। সব যুগ ও সব ভালো-মন্দ মিলেই মানুষের জীবন। কিন্তু মানুষ ভাবে মূল্যবোধের পরিবর্তন মানেই মূল্যবোধের অবক্ষয়। এই ভ্রান্ত ও আবেগগ্রস্ত চিন্তার ফলে মূল্যবোধ নিয়ে মানুষের এই আক্ষেপ ও হাহাকার। যুগে যুগে মানুষের মূল্যবোধের পরিবর্তন হওয়াই স্বাভাবিক। সেটা হওয়াই উচিত। মানুষ যদি আজ পাঁচশ বছর আগের সেই রীতিনীতি ও মূল্যবোধ আঁকড়ে ধরে বসে থাকত, যেসব মূল্যবোধ গড়ে উঠেছিল সে সময়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে, তাহলে আজ অবস্থাটা কি হতো? কি হতো মানুষের এই সভ্যতার অবস্থা? মানুষ যে ক্রমান্বয়ে আধুনিক হয়ে উঠেছে, যুক্তিবাদী, সংশয়প্রবণ, কৌতূহলী ও জিজ্ঞাসু হয়ে উঠেছে এই অনুসন্ধানই তাকে আজ এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। বস্তুজগতের মধ্যে সে সন্ধান করেছে জীবনের রহস্য, মানুষ আজ আর কেবল রহস্যবাদী অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী হয়ে তৃপ্ত থাকতে চায় না, সে জীবন রহস্যের সন্ধান করতে করতে বস্তুর রহস্যভেদ করেছে, আবিষ্কার করেছে অনেক অজ্ঞাত-সত্য। এই সত্যানুসন্ধানী মানুষ আজ মহাশূন্য পর্যন্ত তার করতলগত করেছে, সে পৌঁছেছে চাঁদে, মঙ্গলগ্রহে। পানি, স্থল ও অন্তরীক্ষের বহু রহস্যই আজ তার কাছে উন্মোচিত ও উদঘাটিত। এই মানুষের মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটবে, তার চিন্তাজগতেও যে অনেক রদবদল হবে এতে বিস্মিত বা বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। আর এই পরিবর্তন ও রূপান্তরের সবকিছুকেই এক কথায় অবক্ষয় বলে খারিজ করারও কোনো অর্থ হয় না। জীবন যেমন পরিবর্তনশীল, মানুষের আচার-আচরণ, অভ্যাস, রুচি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধও তেমনি পরিবর্তনশীল। যুগের সঙ্গেই নৈতিকতা ও মূল্যবোধেরও বিচার হয়ে থাকে। ¯েœহ, প্রীতি, বাৎসল্য, হৃদয়ানুভূতি এমনি যেসব শাশ্বত মানবিক গুণাবলীর কথা আমরা এতদিন জেনে এসেছি আজ এমনকি তারও আবেদন সংকুচিত হচ্ছে কিনা কিংবা এসব মানবিক সম্পর্কের মধ্যেও চিড় ধরার উপক্রম হচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে সঠিকভাবে কিছু বলতে পারা যাচ্ছে না। সমাজের এই গভীর সংকট, তার সব সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, এই অন্তঃসারশূন্যতা, দেউলিয়া হয়ে পড়া, মানবিক অনুভূতির এই দৈন্য বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত করে তুলছে। মানব সমাজের এই পরিণতি নিয়ে তারা হতাশ না হয়ে পারছেন না। আসলে মানুষের সমাজ বিবর্তন একটি গভীর পর্যবেক্ষণের বিষয়। এই বিবর্তনের ধারায় মানুষের সমাজ ও সভ্যতা একুশ শতকের প্রথম ভাগে এমন এক স্তরে এসে পৌঁছেছে যেখানে আগের অনেক কিছুই এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। আধুনিক মানুষ আজ এসে দাঁড়িয়েছে উত্তর-আধুনিকতার মুখোমুখি, যেখানে সে প্রায় নিরালম্ব, সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, স্মৃতিহীন, ঐতিহ্যবিমুক্ত। এই উত্তর-আধুনিক যুগের মানুষ সমস্ত প্রাচীন মূল্যবোধ ভেঙে দিয়ে প্রায় সম্পূর্ণ শূন্যতায় পৌঁছাতে চাচ্ছে, নিজেকে এভাবে সবকিছু থেকে মুক্ত করে শূন্যে কাজ স্থান করতে চাচ্ছে। সামাজিক, পারিবারিক বন্ধন আজ তার কাছে অনেকটাই শিথিল হয়ে গেছে, নারী-পুরুষ সম্পর্ক, সন্তান ও আত্মীয়পরিজনের সঙ্গে যে পারিবারিক ঐতিহ্যগত সম্পর্ক, বয়স্কদের প্রতি তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি, সেই অবিচল শ্রদ্ধার আসন এসবও আজ অনেকটাই এলামেলো ও ওলোট-পালোট হয়ে যাচ্ছে। আর তাই এসব অনেক কিছুই আজ অনেকের কাছেই ভাবনার বিষয় হয়ে উঠেছে। মানুষ পারিবারিক জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, সে হয়ে উঠছে অনেকটাই উন্মুল। মনে হয় এই সমস্যার আলোকেই মার্কিন সাময়িকীতে লেখা হয়েছে-There are daily Confrontations with almost everyone in, authority, Children against parents,  mothers against matrimony, fathers against child support. এই সমস্যা আজ শিল্পোন্নত সমাজেই অধিক প্রকট। হয়তো এই মুহূর্তে একে মূল্যবোধের সংকট বলেই মনে হবে, উদ্বিগ্নও করে তুলবে প্রাচীন অভ্যাস মূল্যবোধে বিশ্বাসী অনেক মানুষকেই এ কথাও সত্য, কিন্তু সমাজ বিবর্তনের ধারায় এ সবকিছুই হয়তো একদিন স্বাভাবিক বলেও মনে হবে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে তা-ই কিন্তু হয়। মূল্যবোধ ভেঙে তৈরি হয় নতুন মূল্যবোধ। এভাবেই হয়তো নতুন সমাজ ও নতুন মানব সভ্যতাও গড়ে ওঠে।
বিশ্বায়নের প্রভাব দিন দিন সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রকট হয়ে উঠেছে। সৃষ্টি হচ্ছে গভীর ক্ষত। শিক্ষা যেখানে জাতীয় মেরুদ- গড়ার প্রাথমিক শর্ত, সেখানে শিক্ষা ব্যবস্থা স্থবির না হলেও গড়িয়ে চলছে ভিন্ন খাতে। আজকের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের স্থান দখল করেছে সার্টিফিকেট সর্বস্বতা। উচ্চস্তরীয় ডিগ্রিধারীদের মধ্যে মূল্যবোধের চরম অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিক্ষাকে সঠিক ও কাক্সিক্ষত পথে পরিচালিত করতে না পারলে জাতির উন্নয়নের সঠিক নিশানা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কারণ বহুবিধ।
সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া একাধিক নারীর অমর্যাদাকর ঘটনার পর দেশব্যাপী বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজের চলমান অর্থনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে জৈবিক চাহিদার সম্পর্ক রয়েছে। ভোগবাদী সমাজে এক ধরনের যৌন প্রবণতা প্রবলতর হয়েছে। যৌনতা কোনও নতুন বিষয় নয়। আদিকালেও ছিল, আজও আছে। বর্তমান সমাজে এমন কিছু নতুন উপাদানের সম্পৃক্ততা ঘটেছে যে কারণে জৈবিকতায় আদিমতা ফিরে আসছে। পাশ্চাত্য গণতন্ত্র ও ভোগবাদী সমাজে এই প্রবণতা কোনও অবস্থায়ই অপরাধ বলে গণ্য হয় না। এর অন্যতম কারণ পাশ্চাত্য দেশে পরিবার-সমাজ বলে তেমন কিছু নেই। মূল্যবোধের চর্চা বলতে প্রকৃতার্থে যা বোঝায় পাশ্চাত্যে তা মোটেই নেই। বাংলাদেশের মরহুম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথায়, পশ্চিমের জানালা খুলে দেব যাতে আলো হাওয়া আসতে পারে, কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে ধুলো-ময়লা প্রবেশ করতে না পারে। বাস্তবে আজ তা কিন্তু হচ্ছে না। বরং বলা চলে বাইরের ধুলোঝড় এ দেশের যুব সমাজকে মাতোয়ারা করে তুলেছে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ওসমান গণী প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে তুলনা করে দুই ধরনের সমাজের ছবি তুলে ধরেছেন। পাশ্চাত্যে বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে সমাজে অবাধ যৌনাচার প্রবেশ করেছে। বিশ্বযুদ্ধে পুরুষদের মৃত্যুতে সমাজে পুরুষের সংখ্যা কমে যায়, ফলে যৌনতা বঞ্চিত নারীরা স্বামী ভাগ করে নেওয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার করেছিল। তৎকালীন সময়ে সমাজ রক্ষার নামে নারীদের মধ্যে চাহিদা পূরণের প্রশ্নে সমাজে নারী-পুরুষের অনৈতিক সম্পর্কের প্রচার ও প্রসার ঘটে। যার প্রভাব আজ বিশ্বব্যাপী নারীবাদীরা পাশ্চাত্যের এই ঘটনাকে এ দেশেও বাঁকা পথে নৈতিকতায় বেঁধে ফেলতে চাইছেন।
প্রাচ্যের দেশগুলোর সমাজ ব্যবস্থা আমাদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যৌনতাকে কেন্দ্র করে যে অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে তাতে ওসব দেশে পরিবার ব্যবস্থায় ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে। সামাজিক জীবনে নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে, মারাত্মকভাবে ক্ষতি হচ্ছে সামাজিক বন্ধন। বর্তমানের উন্নততর তথ্যপ্রযুক্তির অপপ্রয়োগই এর অন্যতম কারণ বলা চলে। মা মেয়েদের নিয়ে টিভির পর্দায় এমনসব ছবি দেখছেন, যাতে এক পুরুষ একাধিক নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করছে, আবার এক নারী একাধিক পুরুষের সঙ্গে যৌন তৃপ্তি ভোগ করছে। এসব সরকারি সেন্সরপ্রাপ্ত ছবি পুরোপুরি পর্নো না হলেও সমাজের জন্য সত্যিই ক্ষতিকর। তাই পর্নোগ্রাফির করাল গ্রাসে নিপতিত আজকের সমাজ। মাঝেমধ্যে পুলিশ ব্লু-ফিল্মের বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হচ্ছে না। পর্নোর সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। তথ্য বলছে, বিশ্বের সর্বাধিক পর্নোর ব্যবস্থা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এসব পর্নো এবং টিভি সিরিয়ালের পাশ্চাত্যমুখী প্রভাব পড়ছে আজকের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ের ওপর, বিশেষ করে কম্পিউটার নেটিংয়ের নানা প্রোগ্রামের মধ্যে প্রায় সব কিছুই পাওয়া সম্ভব। এদিকে কম্পিউটার তো আজ নব প্রজন্মের ছেলেমেয়ের হাতে হাতে। ফলে সহজ মেলামেশার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে নারী-পুরুষের মধ্যে। পাশ্চাত্যের অনুকরণে ব্যবহৃত পোশাক-পরিচ্ছদ যৌনতার ব্যাপারে অনেকাংশে দায়ী। ভুলে গেলে চলবে না, ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী নারী দেহ সৌষ্ঠবের প্রতি পুরুষের আকর্ষণ। আরেকটু এগিয়ে বলতে হয়, নারীদেহের এমন কিছু অংশ পুরুষকে আকর্ষণ করে যা পুরুষের মস্তিষ্ক কোষে যৌনতার প্রলুব্ধ করে।
ইতিহাসের চাকা এগিয়ে চলে সামনের দিকে, কখনও পিছোয় না। সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে যৌনতার সম্পর্ক আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। রাহুল সংস্কৃতায়ন তার বিভিন্ন গ্রন্থে দেখিয়েছেন, প্রাচীনকালে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন ভেদাভেদ ছিল না। সমাজে বিয়ে প্রথা চালু হওয়ার পর কেবলমাত্র স্বামী-স্ত্রীর মিলনকেই বৈধতা দেওয়া হয়। এর বাইরের অন্য সব সম্পর্কই অনৈতিক বলে মনে করা হয়। চীন দেশে নিকটাত্মীয়র মধ্যে বিয়ে আইনত নিষিদ্ধ। আধুনিক সভ্য সমাজে অনৈতিক সম্পর্ক রোধের জন্য আইনকানুনও চালু রয়েছে বিভিন্ন দেশে। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে এবং চীন দেশে পর্নো আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ওইসব দেশে অনৈতিক সম্পর্ক বা ধর্ষণের মতো ঘটনার খবর পাওয়া যায় না। মুক্ত যৌনতার সমর্থকরা বলতে পারেন, সৌদি আরবে আইনকানুন ধর্মীয় নেতাদের নির্দেশে চলে। কিন্তু আধুনিক চীন, সেখানে তো ধর্মের গোঁড়ামি নেই, সেখানেও অনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে রয়েছে কঠোর আইন। অথচ ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা সরকারি নিয়মেরই অংশ। আমার চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে। আমি চীন ভ্রমণ করেছি ১৯৮০ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সাথে। লক্ষ্য করেছি বিমানবন্দর থেকে শুরু করে চীনের সর্বত্র সমাজ গড়ার প্রতিটি কাজে নারী-পুরুষের সহাবস্থান। কল-কারখানায়, কৃষিকাজে, অফিস-আদালতে সমসংখ্যক নারী-পুরুষ মিলেমিশে কাজ করছেন, অথচ অবৈধ সম্পর্ক সেখানে নিয়ন্ত্রণে। একাকিত্বের কারণে কোনও নারী সেখানে পুরুষের আক্রমণের শিকার হয়েছেন বলে তেমন কোনও খবর নেই। মেয়েরা নির্ভয়ে পথ চলছে একাকি। অথচ আমাদের দেশে সাধারণ মেলামেশার সূত্র ধরেই বিপজ্জনক অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলে পরিবার ভাঙছে, সমাজ নড়বড়ে হচ্ছে। মারাত্মক মরণব্যাধি ‘এইডস’-এর মূলেও সেই অনৈতিক সম্পর্ক।
বহু প্রাচীনকালে কুমারী মা হওয়াটা তেমন কোনও বিষয়ই  ছিল না। এরকম ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। হাজার হাজার বছর পর আজকের সমাজে কুমারী মা হওয়াটা নিন্দনীয় এবং এক সামাজিক অপরাধ বলেই গণ্য। স্বভাবতই এসব দৃষ্টান্তকে সামনে আনা বা সে যুগে ফিরে যাবার কথা বলাটা প্রচ- ধরনের মূর্খামি ছাড়া আর কিছু নয়। ইতিহাস ঠিক গতিতেই এগোবে, পেছনে ফিরবে না। অতি আধুনিকতার পরশে পাশ্চাত্য দেশে কুমারী মায়েদের নিয়ে সরকার চিন্তিত হয়ে পড়েছে, কুমারী মায়েদের গর্ভপাত করানোর ঘটনা সরকারকে বিড়ম্বনায় ফেলে দিচ্ছে। তাই পশ্চিমা হাওয়া যেমন আমাদের সমাজের জন্য কাক্সিক্ষত হতে পারে না, তেমনি প্রাচীন যুগকে ফিরিয়ে আনার চিন্তাও সমাজকে অধঃপতিত করবে। আমাদের দেশে নারীবাদীরা ইনিয়ে-বিনিয়ে অবৈধ প্রেম বা অনৈতিক সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিতে চাইছেন। নারীবাদীরা পুরুষবিদ্বেষী হয়ে নারীর অপরাধ আড়াল করে সমস্ত অপরাধের জন্য পুরুষকেই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টায় সচেষ্ট। ধর্ষণ নিয়ে দেশব্যাপী হুলস্থুল হচ্ছে অথচ সমঅপরাধ অনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে কেউ কোনো ধরনের প্রশ্ন তুলছে না। আসলে ধর্ষণ আর অনৈতিক সম্পর্ক দুটোই একই সমস্যার এপিঠ-ওপিঠ। ধর্ষণে অপরাধী একজন আর অনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টিতে অপরাধী উভয়েই। ধর্ষণ বলপূর্বক আর অনৈতিক সম্পর্ক স্বেচ্ছায়। দুটোতে আসলে মৌলিক কোনও তফাৎ নেই।  
যুগপৎ দুটো সমস্যাকে একই দৃষ্টিতে দেখতে হবে এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে সুস্থ সংস্কৃতিকে রক্ষার বা সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য কোনও মহল থেকেই তেমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে খবর নেই। এখন সমাজে আর্থিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, সামাজিক অবক্ষয়, কালো টাকা ইত্যাদি নিয়ে আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে। দেশের তথাকথিত ভাইটাল সমস্যাগুলো নিয়ে নানাজন নানাভাবে কথা বলছেন কিন্তু মারাত্মক এ সমস্যা সমাধানে কেউ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসছেন না। গুরুত্বপূর্ণ এই সমস্যায় পরিবারগুলো ভাঙতে ভাঙতে একদিন সমাজটাই বিপন্ন হয়ে পড়বে। আর সে কারণেই অনৈতিক সম্পর্কের সূত্র ও উৎস গভীরভাবে যেমন ভাবতে হবে, তেমনি পারিবারিক, সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো অনৈতিক সম্পর্ক রোধে আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়; লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সমাজবিজ্ঞানী সবার মনোযোগী হওয়া এবং উত্তরণের কার্যকর পথ বের করার জন্য চিন্তাভাবনা করার সময় এসে গেছে। সমাজবাদী দেশ চীনে অনৈতিক সম্পর্ক রোধ এবং নারীদের নির্ভয়ে পথ চলার পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হলে আমাদের এ দেশে তা কেন হবে না? এ প্রশ্ন মোটেই অবান্তর নয়।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ