Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পরিবর্তিত কক্সবাজারে বিদ্যুৎ চাহিদা মেঠাতে কর্তৃপক্ষ অপ্রস্তুত

কক্সবাজার থেকে স্টাফ রিপোটার | প্রকাশের সময় : ৬ আগস্ট, ২০২২, ৪:৫৯ পিএম

- বর্তমান চাহিদার অর্ধেক
বিদ্যুৎ খাচ্ছে ইজিবাইক
- সময়মত উৎপাদনে যেতে পারছেনা বিদ্যুৎ কেন্দ্র লগুলো
-ইজিবাইকে সৌর বিদ্যুৎ চালুর দাবি
-অতিরিক্ত টাকায় দেয়া হয় অপ্রজনীয় ইজিবাইক লাইসেন্স

শামসুল হক শারেক,।
কক্সবাজারে বর্তমান বিদ্যুৎ চাহিদা মেঠাতে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রেল লাইন, উন্নত সড়ক পথ ও সাগর পথে আগামীতে
আরো বাড়বে পর্যটক। সেই পরিবর্তিত কক্সবাজারে বিদ্যুৎ চাহিদা মেঠাতে কর্তৃপক্ষ কতটুকু প্রস্তুত তা নিশ্চিত নয়। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে এখন সারাদেশে চলছে লোডশেডিং। কক্সবাজারেও লোডশেডিং এ বিপর্যস্থ জনজীবন। এই সঙ্কটেও কক্সবাজার জেলায় ২৮ লাখ মানুষ ও কলকারখানার জন্য সরবরাহকৃত বিদ্যুতের প্রায় অর্ধেকই গিলে খাচ্ছে ব্যাটারিচালিত টমটম ইজিবাইক।

জানা গেছে, কক্সবাজারে প্রতিদিন
বিদ্যুৎ চাহিদা রয়েছে ১৫০ থেকে ১৬০ মেগাওয়াট। তার মধ্যে প্রতিদিন ৬০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ যাচ্ছে ইজিবাইকের (টমটম) ব্যাটারি চার্জে। সচেতম মহলের মতে চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের কারণে সীমাহীন যানজট ও বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের কবলে পড়তে হচ্ছে জেলাবাসীকে। তবে কক্সবাজার বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ থেকে বলা হয় ইজি বাইকের চার্জে নয়, বরং বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি হওয়ায় লোডশেডিং সমস্যা হচ্ছে।
এদিকে কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মানে উন্নিত হওয়া এবং আগামী বছর রেল যুক্ত হচ্ছে কক্সবাজারে। আরো উন্নত হচ্ছে সড়ক যোগাযোগ। এতে করে কক্সবাজারে পর্যটক সংখ্যা বাড়ছে আস্তে আস্তে। এছাড়াও সাগর পথে কক্সবাজার আসছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটক। আগামী কয়েক বছরে কক্সবাজারে পর্যটক সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে বর্তমান সংখ্যার কয়েকগুণ বেশি। তখন বিদুৎ চাহিদাও বাড়বে আরো অনেকগুণ বেশি।

কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ একদিকে বর্তমান চাহিদা পূরণে যেখানে হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহে কক্সবাজার বিদ্যুৎ বিভাগ কোনভাবেই প্রস্তুত নয় বলে জানা গেছে। এছাড়াও কক্সবাজারে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন হতে যাচ্ছে। তবে ওসব কেন্দ্র থেকে খুব কাছাকাছি সময়ে বিদ্যুৎ পাওয়ার কোন সম্ভাবনাও নাই। সচেতন মহলের মতে সব মিলিয়ে আগামীতে পরিবর্তিত কক্সবাজারে বিদ্যুৎ সরবরাহে কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত।

কক্সবাজার হোটেল মোটেল ও রেস্ট হাউজ গেষ্ট হাউজ মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব আবুল কাশেম সিকদার এ প্রসঙ্গে বলেন, এখনই যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহে কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও রেল লাইন চালু হলে এবং সড়ক ব্যবস্থা আরো উন্নত হলে পর্যটক সংখ্যা বহুগুণ বাড়বে। তখন কলকারখানা ও স্থাপনা বাড়বে এখনকার চেয়ে দ্বিগুণ। সেই পরিবর্তিত কক্সবাজারে বিদ্যুৎ চাহিদা মেঠাতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়া দরকার।

কক্সবাজার বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, শুধু কক্সবাজার পৌরসভায় ৫৫ হাজার গ্রাহকের জন্য বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ৪০ মেগাওয়াট। বর্তমানে প্রতিদিন ৩২-৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্রাহকের মাঝে সরবরাহ করা হচ্ছে। আর পল্লী বিদ্যুৎ সমবায় সমিতির আওতায় জেলায় গড়ে প্রতিদিন ১১০ থেকে ১২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সরবরাহ করা হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ মেগাওয়াট। এত সংকটের পরও বৈধ অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে কক্সবাজার জেলায় সহস্রাধিক টমটম গ্যারেজে।

যেখানে শুধু কক্সবাজার পৌরসভা ও আশপাশে দুই শতাধিক গ্যারেজে প্রতিদিন ১৫ হাজারের বেশি টমটম চার্জ দেওয়া হয়। এছাড়া অন্যান্য পৌরসভা এবং নয় উপজেলা মিলে আরও প্রায় ২০ হাজারের বেশি টমটমে চার্জ দেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কক্সবাজার পৌরসভা ও উপজেলায় বৈধ অবৈধ মিলে প্রায় ১৫ হাজার, টেকনাফ উপজেলায় ৫ হাজার, চকরিয়ায় ৪ হাজার, উখিয়া উপজেলায় ৩ হাজার, মহেশখালী উপজেলায় ৩ হাজার, পেকুয়া উপজেলায় ৪ হাজারসহ নয় উপজেলা মিলে প্রায় ৪০ হাজার ইজিবাইক (টমটম) চালু রয়েছে। প্রতিটি টমটমে চার থেকে পাঁচটি ১২ বোল্ড ব্যাটারি রয়েছে। সেই হিসাবে দুই লাখ ব্যটারির জন্য প্রতিদিন বৈদ্যুতিক চার্জ দিতে হয়।

কক্সবাজার জেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি কার্যালয়ের তথ্যমতে- গড়ে প্রতিটি গাড়িতে ১.৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। এ হিসেবে প্রতিদিন শুধু টমটমে (ইজিবাইক) চার্জ দিতে প্রয়োজন পড়ছে প্রায় ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শহরের প্রবেশদ্বার লিংকরোড থেকে শুরু করে বাসটার্মিনাল, আলিরজাহাল, সিটি কলেজ এলাকা, এসএমপাড়া, টেকপাড়া, পেশকারপাড়া, কালুরদোকান, পাহাড়তলী, বৈদ্যঘোনা, ঘোনারপাড়া, কলাতলি, সমিতিপাড়া, বাহারছড়া, গাড়ির মাঠ, নুনিয়ারছড়া, মোহাজের পাড়া, খুরুশকুলসহ বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৪ শতাধিক গ্যারেজে প্রায় ১৫ হাজার টমটম (ইজিবাইক) চার্জ নিয়ে থাকে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, একদিকে যেমন অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ রয়েছে তেমনি অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ টমটম চার্জে চলে যাচ্ছে। এতে লোডশেডিং এর মাত্রা বেড়েই চলছে। এ যেন 'মরার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দাঁড়িয়েছে। টমটম চালকরা জানিয়েছেন, গ্যারেজ মালিককে প্রতিদিন একটি টমটমে ২২০ টাকা চার্জের বিল দিতে হয়।

শ্রমিক নেতা জহিরুল হক বলেন, কাগজে-কলমে পৌরসভায় ৩ হাজার টমটম চললেও বাস্তবে সাত হাজারের বেশি টমটম চলছে। শহর ও শহরতলীর আশাপাশে ২১৭টির মতো গ্যারেজ দৈনিক প্রতিটি গাড়িতে ২২০ টাকা চার্জ বিল দিতে হয়।

সম্প্রতি শহরে অতিরিক্ত লোডশেডিং এর বিষয় নিয়ে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির এক সভায় ব্যাপক আলোচনা হয়। এ সময় টমটম গ্যারেজের বিদ্যুৎ সংযোগ বাতিলের দাবি তুলেছেন অনেকে।

অপরদিকে কক্সবাজার পৌরসভার আশপাশে তিন শতাধিক টমটম গ্যারেজে সংযোগ দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে কক্সবাজার বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ।

কক্সবাজার বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের প্রকৌশলী মো. আবদুল কাদের গনি বলেন, শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বে বিদ্যুৎ সমস্যা চলছে। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে আসায় লোডশেডিং একটু বেড়েছে। তিনি বলেন, পৌরসভায় অনুমোদিত টমটমের লাইসেন্স বাতিল করলে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করা হবে। তবে আমরা গ্যারেজে ফ্রি-পেইড বিলের মিটার সংযোগ দিয়েছি। ফলে অবৈধ সংযোগ নেই।

কক্সবাজার জেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজারে নয় উপজেলার দুটি পৌরসভায় ১২০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। সেখানে সরবরাহ পেয়ে থাকি ৯০ থেকে ৯৫ মেগাওয়াট। আবহাওয়া গরম হলে ২০ থেকে ২২ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়।

কক্সবাজার জেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি জিএম মোহাম্মদ আক্তার উজ জামান লস্কর বলেন, জেলায় পল্লী বিদ্যুতের আওতায় সাত থেকে আটশো গ্যারেজ রয়েছে। টমটমে ৫ টি ১২ ভোল্টের ব্যাটারিতে প্রতিদিন দেড় কিলোওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। গ্যারেজের জন্য আলাদা ট্রান্সফরমার দেয়া হয়েছে। তবে গ্রাহকের মোট চাহিদা থেকে তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।

তিনি বলেন, সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ এর চাহিদা বেশি রয়েছে। এ কারণে ইজিবাইক গ্যারেজগুলোতে এ সময়ের মধ্যে যেন কোনো ইজিবাইক চার্জ দেওয়া না হয় এজন্য সতর্ক করা হয়েছে। যদি এ সময়ের মধ্যে কেউ ইজিবাইকের ব্যাটারি চার্জ করে তাহলে তাদের বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্ন করা হবে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য জেলার মসজিদগুলোতে প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

এদিকে রাস্তার উন্নয়নের কাজ শেষ হয়ে গেলে কক্সবাজার পৌরসভার ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (টমটম) খুব দ্রুত বন্ধ করা হবে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার পৌর মেয়র মুজিবর রহমান।

এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশিদ বলেন, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য খুব শীঘ্রই জেলা প্রশাসন থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে নতুন করে ইজিবাইক নির্মাণ গ্যারেজগুলো বন্ধ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

তবে সচেতন মহল বলছেন, ইজিবাইক (টমটম) দিয়ে প্রায় লাখের বেশি পরিবারের সংসার চলে। তাই এসব নিষিদ্ধ না করে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকগুলোকে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহারের উপযোগী হিসেবে করা গেলে বিদ্যুৎ সমস্যার স্থায়ী সমাধন করা যাবে।#

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ