Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারতের পানি আগ্রাসন

তিস্তার পানি বিপদসীমার উপরে ফের বন্যার আশঙ্কা তিস্তা ব্যারাজের ৪৪ গেট খুলে দেয়া হয়েছে, নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপচরে বসবাসরত পরিবারগুলো পানিবন্দি হয়ে পড়েছে

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩ আগস্ট, ২০২২, ১২:০২ এএম

বন্ধুত্বের সুযোগে ভারত সীমান্ত হত্যার পাশাপাশি বাংলাদেশের ওপর পানি আগ্রাসন চালাচ্ছে। তিস্তা চুক্তি এক যুগ ঝুলিয়ে রেখে ফেনী নদীর পানি চুক্তি করেছে। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে পদ্মা নদীর পানি প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন করেছে। তিস্তার উজানে একাধিক বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। যখন খুশি পানি ছেড়ে দিয়ে তিস্তার নদীর আশপাশ ভাসিয়ে দিচ্ছে। এতে বাংলাদেশের কৃষকের ব্যাপক ফসলহানি ঘটছে। আবার শুষ্ক মৌসুমে গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকার কৃষক ও সাধারণ মানুষকে বিপন্ন করে তুলছে। পানি ইস্যুতে ভারত কার্যত আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করেছে।

১৯৯৮ সালে তিস্তা নদীর বাংলাদেশ সীমান্তের ৬০ কিলোমিটার উজানে ভারত সরকার এই বাঁধ নির্মাণ করে। এই গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে তিস্তা নদীর নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে চলে গেছে। এই বাঁধে ফটক রয়েছে ৫৪টি, যা বন্ধ করে তিস্তার মূল প্রবাহ থেকে পানি বিভিন্ন খাতে পুনর্বাহিত করা হয়। প্রধানত তিস্তার পানি তিস্তা-মহানন্দা খালে পুনর্বাহিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই এই বাঁধ স্থাপন করা হয়। ২ হাজার ৯১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা-মহানন্দা খালের মাধ্যমে ভারত সরকার জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার ও মালদহ জেলায় সেচের পানি সরবরাহ করছে। কার্যত তিস্তা নদীর পানি গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে বিহারের মেচী নদীর দিকে প্রবাহিত করা হচ্ছে। ফলে তিস্তা নদী মরণদশায় পড়েছে।

আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে ভারত সরকার ইচ্ছামাফিক শুষ্ক মৌসুমে গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে তিস্তার পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিচ্ছে; আবার বর্ষা মৌসুমে ওই বাঁধের সবগুলো কপাট খুলে দিয়ে তিস্তা নদীর আশপাশের গ্রাম ভাসিয়ে দিচ্ছে। ফলে যখন-তখন তিস্তার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপচরে বসবাসরত পরিবারগুলো পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

এ প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশকে না জানিয়ে গজলডোবার সবগুলো গেট খুলে দিয়ে ভারত রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ করেছে। সারাদেশের মানুষ যখন বন্যার কারণে না খেয়ে দিনাতিপাত করছে, তাদের জন্য কিছু ব্যবস্থা না করে প্রধানমন্ত্রী সেপ্টেম্বরে ভারত যাচ্ছেন। ভারত যাবেন আমাদের নদী হিস্যার কিছু করবেন কী? আসলে প্রধানমন্ত্রীর এজেন্ডায় একবারও দেখিনি তিস্তার আলোচনার কথা।

সিলেটে অসময়ে দু’দফা বন্যার মতোই ভারত হঠাৎ হঠাৎ করে পানি ছেড়ে দেয়ায় কিছুদিন আগে বৃহত্তর রংপুর বিভাগের জেলাগুলো বন্যাকবলিত হয়েছিল। ফের গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে বৃদ্ধি পেয়েছে তিস্তা নদীর পানি। এরই মধ্যে ভারত গজলডোবা বাঁধের সবগুলো কপাট খুলে দিয়েছে। হু হু করে পানি ঢুকছে তিস্তায়। ফলে রংপুরে বন্যা পরিস্থিতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর জেলার তিস্তার পানিতে তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপচরে বসবাসরত পরিবারগুলো পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যা পরিস্থিতির কারণে চরে আবাদ করা আমন ধান, পাটসহ বিভিন্ন শাকসবজির ক্ষেত তলিয়ে গেছে। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, উজানের পাহাড়ি ঢলের কারণে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে গত সোমবার রাতে ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে গতকাল মঙ্গলবার তিস্তা নদীর পানি কিছুটা কমে আসে। বিকেলে ডালিয়া পয়েন্টে ৫২ দশমিক ৭৪ সেন্টিমিটার পানি রেকর্ড করা হয়, যা বিপদসীমার ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর আগে দুপুর ১২টায় ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৭৭ সেন্টিমিটার। ওই সময় বিপদসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া পয়েন্টের নির্বাহী প্রকৌশলী আসাফ-উদ-দৌল্লা বলেন, পানি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪ গেট খুলে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে বিপদসীমার ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা নদীবেষ্টিত নোহালী, কোলকোন্দ, লক্ষ্মীটারী, গজঘণ্টা ও মর্নেয়া ইউনিয়নের প্রায় আড়াই হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অনেকে ঘরের আসবাবপত্র, গবাদিপশু নিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন।
লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী বলেন, তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আমার ইউনিয়নের বেশিরভাগ ওয়ার্ডের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিগত সময় যেসব গ্রামে পানি ঢোকেনি এবার সেসব গ্রামও প্লাবিত হয়েছে। চরের মানুষের ঘরবাড়ি, গাছপালা, ফসলি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পশ্চিম বাগেরহাট আশ্রয়ণ কেন্দ্র এলাকার ৪০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

উজানে তিস্তায় পানি বেড়ে যাওয়ায় কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার চরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে ভীতি-আতঙ্ক। কয়েক দিন আগে বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় মানুষ নতুন করে ঘরবাড়িতে ফিরেছে। এখনই ফের বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানের বিভিন্ন স্থানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। এতে উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীর পানি আরো বৃদ্ধি পেতে থাকবে। সেই সঙ্গে আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর অববাহিকাভুক্ত লালমনিরহাট, নীলফামারী ও রংপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে।

লালমনিরহাট জেলা সংবাদদাতা জানান, লালমনিরহটি তিস্তা নদীর অববাহিকায় আবারও দেখা দিয়েছে বন্যা। হাজার হাজার ঘরে উঠেছে পানি। পরিস্থিতি মোকাবেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলে দিয়েছে ৪৪টি গেট। ভারতের গজলডোবা ৫৪টি গেট খুলে দেয়ায় বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। গত দু’দিনে শ্যালো মেশিন দিয়ে তিস্তার চরে আমন ধানের চারা রোপন করার পর হঠাৎ পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আতঙ্কে ভুগছেন চরাঞ্চলের বাসিন্দারা। এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন, মহিষখোচা ইউনিয়নের বাহাদুরপাড়া গ্রামের মোফাজ্জল হোসেন। শুধু মোফজ্জল হোসেনই নন, এমন অভিযোগ নদীপাড়ের বাসিন্দাদের।

জানা গেছে, উজানের পাহাড়ি ঢলের কারণে লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলায় আবারও বন্যা দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন তিস্তার চরাঞ্চলের ১০ হাজার পরিবার। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ৩টায় তিস্তার পানি বিপদসীমার ১৪ সেন্টিমিটার (স্বাভাবিক ৫২.৬০) উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া পয়েন্টের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফা-উদ-দৌল্লা জানিয়েছেন।
এদিকে কয়েকদিনের ভারি বৃষ্টিপাত ও ভারতের গজলডোবা ব্যারাজে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তা নদীতে পানি বেড়েছে। তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নদীর তীরবর্তী এলাকায় ও নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। এতে জেলা সদর, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও পাটগ্রাম উপজেলায় নদীর তীরবর্তী ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে আদিতমারী উপজেলার সলেডি স্পার-২ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, তিস্তা নদীর পানি হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিস্তা পাড়ের লোকজন অনেকেই বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে চলে গেছেন। আবার অনেকেই তাদের গবাদিপশু নিয়ে গাদাগাদি করে অবস্থান করেছেন। এদিকে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে সেখানকার শিক্ষার্থীরা। গোবরধন এম এইচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোবরধন হায়দারীয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও গোবরধন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে কোমর পরিমাণ পানি উঠায় স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে। সেই সাথে বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার রাস্তায়ও হাঁটু সমান পানি উঠায় বিপাকে পড়তে হচ্ছে বানভাসি মানুষদের।

এদিকে উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের পানিবৃদ্ধি এলাকা পরিদর্শন করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার জি.আর সারোয়ার। এসময় সাথে ছিলেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মফিজুল ইসলাম। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মো. আবু জাফর বলেন, বন্যাকবলিত পরিবারগুলোর সার্বক্ষণিক খোঁজ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে।



 

Show all comments
  • মোঃ হাতেম আলী ৩ আগস্ট, ২০২২, ৮:৪৪ এএম says : 0
    আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে ভারত সরকার ইচ্ছামাফিক শুষ্ক মৌসুমে গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে তিস্তার পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিচ্ছে; আবার বর্ষা মৌসুমে ওই বাঁধের সবগুলো কপাট খুলে দিয়ে তিস্তা নদীর আশপাশের গ্রাম ভাসিয়ে দিচ্ছে। ফলে যখন-তখন তিস্তার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপচরে বসবাসরত পরিবারগুলো পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ফারাক্কার কথা না হয় বাদই দিলাম ওটা এখন ইতিহাস -------এই হল আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশের কাছ থেকে পাওয়া উপহার।বড়ই দুঃখজনক!!!!
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ