Inqilab Logo

সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সারা দেশে ব্যাহত আমন চাষ

রফিক মুহাম্মদ : | প্রকাশের সময় : ৩০ জুলাই, ২০২২, ১২:০৮ এএম

অনাবৃষ্টি ও তাপদাহে উত্তরাঞ্চলে মরুর প্রভাব

সেচে চাষ করায় হাজার কোটি টাকা বেশি খরচ
লক্ষ্যমাত্রার চার ভাগের এক ভাগ মাত্র রোপণ হয়েছে
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে এখনই দুশ্চিন্তার কিছু নেই আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমন চাষ চলবে

আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে খরায় পুড়ছে রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া তথা দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলাসহ অন্যান্য আরও বেশ কেয়েকটি জেলা। এসব এলাকার কৃষক পানির অভাবে জমিতে আমন চাষ করতে পারছে না। কষ্ট করে বীজতলা তৈরি করলেও পানির অভাবে কৃষক জমিতে আমনের চারা রোপণ করতে পারছে না। আবার তৈরি করা বীজতলার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। অনেক বীজতলা পানির অভাবে হলুদ হয়ে গেছে। মরে যাচ্ছে। সামান্য যেসব জায়গায় সম্পূরক সেচ দিয়ে আমনের চারা লাগিয়েছেন কৃষক, তাও পানির অভাবে মরে যাচ্ছে, রোদে পুড়ে ঝলসে যাচ্ছে। পানি নেই কোথাও। অনেক কৃষক জমিতে হাল দিয়ে রেখেছেন, কিন্তু চারা লাগাতে পারছেন না। অনেকে এখনো জমিতে হালই দিতে পারেননি। সামর্থ্যবান কিছু কৃষক স্যালো ও বিদ্যুৎচালিত মোটর দিয়ে আমন লাগানো শুরু করলেও তারা খরচে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। অপর দিকে প্রান্তিক, বর্গা, বন্দকী ও ক্ষুদ্রচাষিরা এখনো চাতক পাখির মতো আকাশের দিকে চেয়ে আছেন। বৃষ্টির জন্য আল্লার কাছে প্রর্থনা করছেন।
বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও বিগত কয়েক বছরে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত কয়েক বছর যাবত গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রীর বেশি থাকছে। যাকে মরুর তাপমাত্রা বলা হচ্ছে। তাপমাত্রার এই অস্বাভাবিকতার ফলে দিনে দিনে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। আবার কখনো বা অসময়ে দেশের কোন অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে। ্এর ফলে কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
এবার অসময়ে বন্যায় আক্রান্ত হয়ে দেশের হাওরাঞ্চলে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এরপর বর্সার শুরুতেই দুই দফা বন্যার কারণে সিলেট ও সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণাসহ হাওরাঞ্চলে সময়মতো আমনের আবাদ করতে পারছেনা কৃষক। এ ছাড়া ভরা বর্ষায় দেশের উত্তরাঞ্চলসহ আরও কয়েকটি জেলায় স্বাভাবিক বৃষ্টি না হওয়ায় সে সব এলাকায়ও কৃষক আমন চাষ করতে পারছে না। বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার পাশাপাশি কোথাও কোথাও থাকে তাপপ্রবাহ। ফলে ফসলের মাঠ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে খরার কবলে পড়েছে ফসলের মাঠ। বৃষ্টি না হওয়ায় সেচ দিয়ে জমি তৈরী করতে হচ্ছে। এতে কৃষকের বাড়তি খরচ হচ্ছে হাজার কোটি টাকা। আবার বৃষ্টি কম হওয়ায় কোথাও কোথাও পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেচ সংকটে পড়েছেন কৃষক। সব মিলিয়ে আমনের বীজতলা ক্ষতিগ্রস্তসহ চারা রোপণ ব্যাহত হচ্ছে। এতে আমন চাষে লক্ষমাত্রাপূরণে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে ৫৯ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর অর্থাৎ প্রায় ৬০ লাখ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। তবে সর্বশেষ জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত মাত্র ১৫ লাখ হেক্টর জমিতে চাষ করা সম্ভব হয়েছে। এতে লক্ষমাত্রার চার ভাগের এক ভাগ জমিতে আমনের চাষ হয়েছে। তবে এ নিয়ে এখনই হতাশ নয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। তাদের মতে রোপা আমনের সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আমন রোপন করা যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপমহাপরিচালক কে জে এম আব্দুল আউয়াল ইনকিলাবকে বলেন, আমন চাষের লক্ষমাত্রা নিয়ে এখনই দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সারাদেশে কৃষকরা আমন চাষ করছেন। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিও কিছু না কিছু হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমন চাষ নিয়ে আমরা আশাবাদী।
আমনের আবাদ কৃষকদের জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমত এবং মৌসুমের বোনাস আবাদ হিসেবে পরিচিত। কারণ আমনে বৃষ্টির পানি দিয়েই গোলায় ধান তোলেন কৃষক। কিন্তু সেই পরিস্থিতি এবার দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন অঞ্চলে নেই। উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন অঞ্চলের প্রকৃতি বিগত ১০ বছরের চেয়ে বেশি উত্তপ্ত। ফলে খোদ কৃষি বিভাগই আমনের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ব্যাপারে শঙ্কিত। এ অবস্থার উন্নতি না ঘটলে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও অর্জন সম্ভব না হওয়ার আশঙ্কা করছে কৃষি বিভাগ।
আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের প্রকৃতিতে চলছে মরুভূমির উত্তাপ। সাথে ভ্যাপসা গরম। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহেও স্বাভাবিক চাহিদার মাত্র দশমিক ৫২ শতাংশ বৃষ্টি হয়েছে এ অঞ্চলে। সর্বত্রই চলছে পানির জন্য হাহাকার। কৃষি বিভাগ বলছে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবার ২৫ লাখ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও অনাবৃষ্টির কারণে আবাদ হয়েছে মাত্র এক লাখ হেক্টরে। তাও আবাদ করতে হয়েছে সম্পূরক সেচ দিয়ে। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের জমিগুলোও যদি সম্পূরক সেচ দিয়ে আবাদ করতে হয় তাহলে কৃষকের বাড়তি খরচ হবে কমপক্ষে ১০০০ কোটি টাকা। পরিস্থিতি সামাল দিতে কৃষি বিভাগ লিফলেট বিতরণ ও মাইকিং করে সম্পূরক সেচ দিয়ে আমন রোপণের পরামর্শ দিচ্ছেন।
উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার চারটি কৃষি জোন হলো রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও রাজশাহী। এ চারটি কৃষি জোনের আওতায় এবার আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ২৫ লাখ হেক্টর জমিতে। এ পরিমাণ জমিতে আমন রোপণের জন্য এপ্রিল-মে মাসের মধ্যেই বীজতলা তৈরির পর মধ্যজুন থেকে ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে আমনের চারা রোপণের সঠিক সময়। এরপর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আমন রোপণ করা গেলেও তাতে ফলন কম হওয়ার পাশাপাশি পোকা-মাকড়ের উপদ্রব বেশি হয়। এ চার জোনের কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী এ পর্যন্ত মাত্র এক লাখ হেক্টরের কিছু বেশি জমিতে আমনের আবাদ করেছেন চাষিরা। যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৪ শতাংশ। তাও কৃষকদের করতে হয়েছে সম্পূরক সেচ দিয়ে। এতে বাড়তি খরচ করতে হয়েছে চাষিদের।
রংপুর সদরের চন্দনপাট ইউনিয়নের চাপড়ার বিলে শ্রাবণ মাসে কখনো পানি না শুকালেও এবার রেকর্ড ভেঙে খরতাপে খাঁ খাঁ করছে। এখানকার কৃষক মো: আলম জানালেন জুলাই মাস শেষ হয়ে গেছে এখনো জমিতে চারা লাগাতে পারিনি। বৃষ্টি নেই, তাই এবার ডিপের পানি নেব। ডিপের পানি প্রতি ঘণ্টায় নিতে হয় ১৫০ টাকা।
২৫ জুলাইয়ের আগে আমন লাগাতে না পারলে ফলন কাক্সিক্ষত হবে না। তাই চাপড়ার বিল এলাকার অনেক কৃষক স্যালোসহ গভীর-অগভীর নলকূপের সেচে আমন লাগানো শুরু করেছেন। এখানকার কৃষক হোসেন আলী জানালেন, ঘণ্টা ১৫০ টাকা হিসেবে এক একর জমিতে পানি নিচ্ছি। প্রায় ৮ ঘণ্টা লাগবে আমার শুধু জমি ভিজিয়ে নিতে। এরপর চারা লাগানোর পর চারা জীবন্ত রাখতে কয়েক দিন পর আবার পানি নিতে হবে। এতে আমার লাগানো এবং পরের সেচ দিতে প্রায় এক একর জমিতে টাকা লাগবে দেড় থেকে দুই হাজার টাকার মতো। এটা আমার বাড়তি খরচ। এভাবে সারাদেশে কৃষক যদি সম্পূরক সেচে আমন চাষ করে তাহলে তাদের কমপক্ষে এক হাজার কোটি টাকা বাড়তি খরচ হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ