দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
জিলহজ্ব মাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল হলো ‘তাকবীরে তাশরীক’। তাকবীর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্যের ঘোষণা করা। শিরকের পাপ থেকে নিজেকে পবিত্র রেখে সর্বদা তাওহীদের চেতনায় উজ্জীবিত থাকা। একজন মুমিনের জন্য এটা সব সময়ের আমল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা নির্দিষ্ট কিছু সময়ে বিশেষভাবে তাঁর বড়ত্বের কথা ঘোষণা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আইয়্যামে তাশরীক এমনই একটি সময়। পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ”তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ করগ্ধ। (সূরা বাকারা: ২০৩)
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এখানে নির্দিষ্ট দিনগুলো দ্বারা উদ্দেশ্য-তাকবিরে তাশরিক পাঠের দিনসমূহ। ( সহীহ বুখারী, মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আছার, হাদিস-১০৮৭২)
অন্য এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ‘আইয়ামে তাশরীক পানাহার ও আল্লাহর যিকিরের জন্য। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০৭২২
‘আইয়্যামে তাশরীক’ নামকরণের কারণঃ তাশরীক শব্দের এক অর্থ হলো, রোদে গোশত শুকানো। এই দিনগুলোকে তাশরীক বলার কারণ হলো, আগের জমানায়া মানুষ এই দিনগুলোতে কুরবানীর গোশত কে টুকরা টুকরা করে রোদে শুকাতো। তাই এই অর্থের বিবেচনায় এই দিনগুলোকে আইয়্যামে তাশরীক বলা হয়। (ফাতওয়ায়ে শামী-২/১৭৭ সায়ীদ, ফাতহুল কাদীর-২/৪৮ রশীদিয়া)
কোনো কোনো ওলামায়ে কেরামের মতে ঈদের নামায এবং কুরবানীর দিনকেও তাশরীক বলা হয়। কেননা ঈদের নামায ঐ সময় আদায় করা হয় যখন সূর্য তাশরীক তথা আলোকিত হয়। (ফাতহুল কাদীর-২/৪৮ রশীদিয়া)
তাকবীরে তাশরীকের বাক্যঃ তাকবীরে তাশরীকের বাক্য ও শব্দমালা নিয়ে রেওয়ায়েতর ভিন্নতা রয়েছে। তবে সর্বাদিক প্রসিদ্ধ বর্ণনা হলো, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ’
অর্থাৎ শুরুতে দুই বার ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে। হানাফী,মালেকী,হাম্বলী মাযহাবের মতানুযায়ী উপরোক্ত নিয়মে তাকবীরে তাশরীক বলা উত্তম। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-৫৬৫১,ইলাউস সুনান-৮/১৫৬)
অব্যশ্য ভিন্ন রেওয়াতে শুরুতে তিনবার আল্লাহু আকবার বলাসহ ভিন্ন পদ্ধতির কথাও উল্লেখ রয়েছে। তাই হাদীসে বর্ণিত যেকোন এক পদ্বতিতে পড়লেই তাকবীরে তাশরীকের হক আদায় হয়ে যাবে। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি কাম্য নয়। (দারাকুতনী-১৮২, তারিখে বাগদাদ-১০/২৩৮,আসসুনানুল কুবরা লিল ইমাম বাইহাকী হাদিস নং-৬৫০৪)
তাকবীরে তাশরীকের ইতিহাসঃ তাকবীরে তাশরীকের একটি ইতিহাস ফুকাহায়ে কেরাম উল্লেখ করেন। সেখানে তারা বলেন জিবরাইল আ. যখন দেখলেন ইবরাহীম আ. পুত্র ইসমাঈলকে যবেহ করার উপক্রম তখন জিবরাইল আ. আশ্চর্য হয়ে দুই বার আল্লাহু আকবর বলেন। এর পর ইবরহীম আ. জিবরীল কে দেখে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আল্লাহ আকবর’ বলেন। অতঃপর ইসমাঈল আ. যখন জান্নাত থেকে দুম্বা আসার বিষয়টি জানতে পারলেন তখন তিনি ‘আল্লাহ আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ বলেন’। (বাহরুর রায়েক-২/১৬৫)
ফুকাহায়ে কেরাম তাকবীরে তাশরীকের যে ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। এটা বিভিন্ন ফিকহের কিতাবে পাওয়া গেলেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোন হাদীস দ্বারা তা প্রমাণিত নয়। তাই এটাকে হাদীস মনে করে বিশ^াস করা যাবে না।
তাকবীরে তাশরীক পড়ার হুকুম ও সময়ঃ ৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আছর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরয সালাতের পর প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরষ মুকীম হোক বা মুসাফির, একাকী নামায পড়ুক বা জামাতে, ফরয সালাতের পর এক বার তাকবীরে তাশরীক বলা হানাফী মাযহাব মতে ওয়াজিব। এ তাকবীর পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর পড়বে। এই দিনগুলোর বিতর বা অন্যান্য সুন্নত বা নফল নামাযের পর পড়ার নিয়ম নেই। অবশ্য গ্রহণযোগ্য মতানুযায়ী ঈদের নামাযের পর পড়বে। (দুররুল মুখতার-৩/৬৪ যাকারিয়া, ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া-২/৬৪৩ যাকারিয়া)
হাদিস শরীফে এসেছে; হযরত জাবের রাযযি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার দিন তথা ৯ ইজিলহজ ফযর নামাযের থেকে আইয়ামে তাশরিকের শেষ দিন তথা ১৩ই জিলহজ আসরের নামাজের পর পর্যন্ত ফরযের সালাম ফিরানোর পর তাকবীরে তাশরীক পড়তেন। (সুনানে দারা কুতনী-২/৩৭ হাদিস নং-১৭১৯ বায়রুত)
অপর একটি বর্ণনায় এসেছে ; আবু ইসহাক রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন আরাফার দিন ফজরের নামাজের পর থেকে তাকবিরে তাশরিক শুরু হওয়ার ব্যাপারে হযরত ওমর, হযরত আলী ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.একমত হয়েছেন। হযরত ওমর ও হযরত আলী রা. ১৩ তারিখ আসর নামাজের পর পর্যন্ত তাকবীরে তাশরীক পড়তেন। (আসসুনানুল কুবরা লিল ইমাম বাইহাকী হাদিস নং ৬২৭৪)
ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়াতে উল্লেখ আছে, ‘তাকবীরে তাশরীক ওয়াজিব। শুরু হবে ইয়াওমে আরাফাহ তথা ৯ জিলহজ¦ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ¦ আসর পর্যন্ত। এই আইয়্যামে তাশরীকে যাদের উপর ফরয নামায ওয়াজিব তাদের উপর এই তাকববীর ওয়াজিব। (ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া-২/৬৩৪-৬৪০ যাকারিয়া)
তাকবীরে তাশরীক পড়ার পদ্ধতিঃ তাকবীরে তাশরীক উক্ত পাঁচ দিনে ফরয নামাযের সালাম ফিরানোর পরপরই পড়া ওয়াজিব। সালামের পর নামায পরীপন্থী কোন কোন কাজ করার আগেই তাকবীর পড়তে হবে। কেননা এটা নামাযের সাথে খাস। তাই কেউ যদি তাকবীর না পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে যায় অথবা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কথা বলে বা ইচ্ছাকৃত হদস করে কিংবা নামায পরিপন্থী কোন কাজ করে ফেলে তাহলে তার থেকে তাকবীর পড়ার বিধান রহিত হয়ে যায় এবং তাকবীর না পড়র দরুন গুনাহগার হয়। (ফাতওয়ায়ে শামী-৩/৬১-৬৩ যাকারিয়া,বাহরুর রায়েক-২/১৬৫)
মাসয়ালা: মাসুবুক ব্যক্তি যে নামযের কিছু অংশ পায়নি, সে তার ছুটে যাওয়া নামায শেষে সালাম ফিরানোর পর পড়ে নিবে। একাকী নামায পড়ার ক্ষেত্রেও পড়তে হবে। (রদ্দুল মুহতার-২/১৮০,মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-৪/২৩৯)
মাসয়ালা: তাকবীরে তাশরীক শুধু আইয়্যামে তাশরীকের দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সাথে খাছ। এই দিনগুলোর বিতর বা অন্যকোন সুন্নত কিংবা নফল নামাযের পর তা পড়ার বিধান নেই। অবশ্য গ্রহণযোগ্য মতানুযায়ী ঈদের নামাযের পর পড়বে (বাহরুর রায়েক-২/১৬৫,রদ্দুল মুহতার-৩/৬৩ যাকারিয়া, হিন্দিয়া-১/৩৭০)
মাসয়ালা: আইয়্যামে তাশরীকের আগের কোন নামায এই দিনগুলোতে কাযা করলে বা এই দিনগুলোর কোন নামায আইয়্যামে তাশরীকের পরে কাযা করলে তখন তাকবীরে তাশরীক পড়ার বিধান নেই। অবশ্য এই দিনগুলোর কোন ফরয নামায যথা সময়ে পড়তে না পেরে এই দিনগুলোর অন্যকোন দিন কাযা করলে তখন তাকবীর পড়তে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে-১/৪৪৬, রদ্দুল মুহতার-২/১৭৯)
মাসয়ালা: তাকবীরে তাশরীক পুরুষরা উচ্চ আওয়াজে আর নারীরা নিম্ন আওয়াজ তথা নিজে শুনতে পায় এমন আওয়াজে পড়বে। পুরুষরা নিম্ন আওয়াজে পড়লে তাকবীরে তাশরীক পড়ার হক আদায় হবে না। (ফাতওায়ে হিন্দিয়া-১/১৫২ যাকারিয়া,হিন্দিয়া-১/১৫২ যাকারিয়া)
মাসয়ালা: তাকবীরে তাশরীক কোন কারণে পড়তে না পারলে তা আর কাযা করার সুযোগ নেই । অনিচ্ছায় তাকবীর ছুটে গেলে গুনাহ হবে না তবে ইচ্ছাকৃত না পড়লে গুনাহগার হবে। তাই এর জন্য আল্লহ তায়ালার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবে। (বাহরুর রায়েক-২/১৬৫, বাদায়েউস সানায়ে-১/১৯৬)
মাসয়ালা: ঈদগাহে যাওয়া আসার সময় তাকবীর পাঠ করা সুন্নত। তেমনিভাবে ঈদে নামাযের ১ম খুতবায় ৯ ও দ্বিতীয় খুতবায় ৭ বার তাকবীর বলা মুস্তাহাব। ফাতওয়ায়ে হিন্দিয়া-১/৩৬৬,রদ্দুল মুহতার-২/১৭৫)
তাকবীরে তাশরীক কয়বার বলা সুন্নতঃ আইয়্যামে তাশরীকসহ জিলহজ¦ মাসের প্রথম দশকে কুরআন ও হাদীসে বেশি বেশি তাকবীর পড়ার কথা রয়েছে। তাই এই দিনগুলোতে যথাসম্ভব বেশিবেশি তাকবীর পড়া চাই। কিন্তু কথা হলো, আইয়্যামে তাশরীকে ফরয নামাযের পর তাকবীর পড়ার যে বিধান সেক্ষেত্রে কতবার তাকবীর পড়বে? একবার নাকি তিনবার? অনেকে বলে তিনবার বলতে হবে। তাদের এই ধারণা সঠিক নয়; বরং এক্ষেত্রে শুধু একবার তাকবীর বলা ওয়াজিব। তিনবার পড়তে হবে এমন কোন কথা হাদীসে বর্ণিত নেই। তাই একবার পড়াই সুন্নাহ সমর্থিত। শরীয়তের বিধান যেখানে যতটুকু সেখানে ততটুকুই পালন করতে হবে। কমবেশি করার সুযোগ নেই। তাই ফরয নামাযের পর একবার (পুরুষরা) উচ্চ আওয়াজে তাকবীর পড়বে। এর পর চাইলে সে নিম্ন আওয়াজে তিনবার বা আরো বেশি পড়তে পারে। তবে তিনবার পড়াকে সুন্নত মনে করা যাবে না। অন্যথায় তা মাকরুহ হবে। (ফাতওয়ায়ে শামী-৩/৬১-৬২,ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া-১/১০২,হেদায়া-১/১৭৫)
অতএব, আইয়্যামে তাশরীকসহ প্রতিটি দিন এবং প্রতিটি মুহুর্ত তাওহিদী চেতনায় উজ্জীবিত হোক প্রতিটি মুমিন হৃদয়। তাকবীর,তাহলীল আর তাসবীহে কাটুক আমাদের সময়।
লেখক : মুহাদ্দিস-জামিয়া ইমদাদিয়া আরাবিয়া শেখেরচর, নরসিংদী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।