Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

একের পর প্রাকৃতিক দূর্যোগের পরেও দক্ষিণাঞ্চলে চাহিদার দ্বিগুণের বেশী মাছ উদ্বৃত্ত

সারা দেশে উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৭০ ভাগেরই উৎপাদন ও আহরণ

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ২৫ জুলাই, ২০২২, ৯:৩৫ এএম

ইয়াশ, অশনি, আম্পান, বুলবুল, মহাশেন ও সিডর’র মত প্রাকৃতিক দূর্যোগ সহ নানামুখি প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে ‘মাছে ভাতে বাঙালী’র দক্ষিণাঞ্চলে চাহিদার প্রায় দ্বিগুন মাছ উদ্বৃত্ত থাকছে। এমনকি এ অঞ্চলে মৎস্য সেক্টরে অনুমোদিত জনবলের অর্ধেকেরও বেশী ঘাটতির পাশাপাশি সাগর ও নদ-নদীতে অভিযোনের মত কোন নৌযান না থাকলেও প্রবৃদ্ধি জাতীয় হারের চেয়ে বেশী। সারা দেশে উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৭০ ভাগেরই উৎপাদন ও আহরন দক্ষিণাঞ্চলের উন্মুক্ত জলাশয় সহ উপক’ল সংলগ্ন সাগর এলাকায়। এমনকি মাছ উৎপাদনে দেশ ২০১৬-১৭ সালে সয়ম্ভরতা অর্জন করলেও দক্ষিণাঞ্চল সে সফলতা অর্জন করেছে আরো পাঁচ বছর আগে । গত এক যুগে দেশে মৎস্য সেক্টরে প্রবৃদ্ধি প্রায় ৫৩% হলেও এ অঞ্চলে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৭৫%। এসময়ে দেশে ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৭০% বৃদ্ধি পেলেও দক্ষিণাঞ্চলে প্রবৃদ্ধির হার ১১৫%-এর মত।

পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, একজন মানুষের দৈনন্দিন মাছের চাহিদা ৬০ গ্রাম হলেও আমাদের দেশে প্রাপ্যতা ইতোমধ্যে প্রায় ৬৩ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে তা আরো বেশী। যা ইতোপূর্বে ছিল ৫৩ গ্রাম। দক্ষিণাঞ্চলের ৬ জেলায় ৩ লাখ ২০ হাজার টন চাহিদার বিপরিতে ২০২০-২১ অর্থবছরে মাছের উৎপাদন ছিল ৮ লাখ টনেরও বেশী। তবে এতসব অর্জনের পরেও সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে আজ পর্যন্ত মৎস্য শিক্ষা সহ গবেষনা ধর্মী কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রী শম রেজাউল করিমের দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন।

দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলায় প্রায় ৪ লাখ ২৭ হাজার পুুকুর ও দীঘি, ৬৬৭টি বরোপীট, ৯০টি প্রবাহমান নদ-নদী, ৪৩টি বিল, একটি বাঁওড় বা মরা নদী, প্রায় দেড় হাজার খাল ও সোয়া ৬শ প্লাবন ভূমিতে বার মাসই কমবেশী মাছের চাষ ও আহরন হচ্ছে। এ অঞ্চলের প্রায় ৫৪.৬০ লাখ হেক্টর জলাশয়ে ২০০৮-০৯ সালে মাছের উৎপাদন ২ লাখ ৯৮ হাজার টন থেকে ২০২০-২১ অর্থ বছরে ৮ লাখ ১ হাজার ৮০৬ টনে উন্নীত হয়েছে। এ সময়ে দক্ষিণাঞ্চলে ইলিশের উৎপাদনও প্রায় ৩.৭০ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষি ফসলের চেয়ে মাছ চাষে মুনাফা বেশী হওয়ায় এ সেক্টরের প্রতি গ্রামঞ্চলের মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। এমনকি দক্ষিণাঞ্চলের ৪২টি উপজেলায় নিবিড় ও আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চাষের মাধ্যমে রুই জাতীয় মাছের উৎপাদনও বছরে প্রায় ১ লাখ টন। পাশাপাশি পাঙ্গাস, শিং-মাগুর, কৈ, তেলাপিয়া এবং চিংড়ি ছাড়াও অন্যান্য মাছের উৎপাদনও দেড় লাখ টনের কাছে। এ অঞ্চলের সরকারী-বেসরকারী ৫০টি হ্যাচারী ও ৯২৩টি নার্সারীতে প্রায় ৩৫ হাজার কেজি রেনু ছাড়াও ৩৫ লাখ মাছের পোনা উৎপাদন হচ্ছে। পাশাপাশি এ অঞ্চলের প্রায় দেড় হাজার খাঁচায় বছরে দুই থেকে আড়াই হাজার টন সাদু পানির বিভিন্ন ধরনের মাছ উৎপাদন করছেন।
অপরদিকে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় কাকড়া ও কুচিয়া চাষ স¤প্রসারনেও সাফল্য আসছে। এ অঞ্চলের ৫টি জেলার ১১টি উপজেলার পুকুরে কিশোর কাকড়া চাষ, পেনে ও খাঁচায় কাকড়া মোটাতাজা করণ ও সামাজিক পর্যায়ে কুচিয়া চাষ-এর প্রদর্শনী খামার ইতোমধ্যে চাষীদের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। দক্ষিণাঞ্চলের ১১০হেক্টর জমিতে প্রায় ৭শ খামারে বছরে ৩শতাধীক টন কাকড়া উৎপাদিত হচ্ছে। যা অভ্যন্তরীণ চাহিদার পাশাপাশি রপ্তানি খাতকেও সমৃদ্ধ করছে।

এছাড়াও দক্ষিণাঞ্চলের ৮টি উপজেলার প্রায় তিন হাজার মৎসজীবী সহশ্রাধিক টন শুটকী উৎপাদন করছে। যার পুরোটাই কীটনাশক মূক্ত ও রোদে শুকানোর মত স্বাস্থ্য সম্মত লাগসই প্রযুক্তির বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।
দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রায় ৫ লাখ জেলে মৎস্য সেক্টরের ওপর নির্ভরশীল হলেও মৎস্য অধিদপ্তরের নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা এখনো সাড়ে ৩ লাখের কিছু বেশী। তবে অধিদপ্তরের মতে, এ অঞ্চলে জেলে পরিবারের সংখ্যা ২ লাখ ২৮ হাজারের মত।
মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুাযায়ী দেশের ৮টি বিভাগের মধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলাতেই প্রায় সোয়া ৩ লাখ জেলে ইলিশ আহরনে জড়িত। যার ৬৫% সার্বক্ষণিকভাবে কর্মরত বলে মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে বলা হয়েছে।

তবে গত সোয়া দু বছরের করোনা সংকটে সারা দেশের মত দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্য সেক্টরেও যে স্থবিরতা ঘিরে ধরেছিল তা থেকে ইতোমধ্যে উত্তরন ঘটেছে। পাশাপাশি গত কয়েক বছরে একের পর এক প্রাকৃতিক দূর্যোগে দক্ষিণাঞ্চলের বিপুল সংখ্যক পুকুর, দিঘি ও মৎস্য ঘের সহ বদ্ধ জলাশয়ের মাছ ভেসে গিয়ে বিপুল সংখ্যক মৎস্য চাষি এবং ঘের মালিক সর্বশান্ত হয়েছেন। তবে তাদের জন্য তেমন কোন প্রনোদনা ছিলনা।

এসবের পাশাপাশি চীরাচরিত অবহেলা ও উদানীতার একটি অন্যন্য উদাহরন দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্য সেক্টরের জনবলের ক্ষেত্রে। বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলার ৪২টি উপজেলায় মাত্র ৩৭০টি মঞ্জুরিকৃত পদের মধ্যে বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ১৭৩ জন। ১৯৭টি পদেই কোন লোকবল নেই। এঅঞ্চলে সিনিয়র সহকারী পরিচালক, সহকরী পরিচরালক, সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা,উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, মৎস্য স¤প্রসারন কর্মকর্তা, মৎস্য স¤প্রসারন ও মান নিয়ন্ত্রন কর্মকতা ও মৎস্য জরিপ কর্মকর্তার অর্ধেকেরও বেশী পদেই জনবল নেই। এমনকি খামার ব্যাবস্থাপক সহ সহকারী মৎস কর্মকর্তার ৪২টি পদেরও বেশীরভাগ শূণ্য।

এসব বিষেয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপ-পরিচালক আনিসুর রহমান হাওলাদারের সাথে আলাপ করা হলে তিনি দক্ষিনাঞ্চলের মৎস্য সেক্টরে প্রভুত উন্নতির জন্য চাষীদের পরিশ্রম ও আন্তরিকতার কথা উল্লেখ করেন। তবে জনবল সংকট মৎস্য সেক্টরের সম্প্রসারনে অন্তরায় বলে মেনে নিয়ে এব্যাপারে সদর দপ্তর ও মন্ত্রনালয় অবহিত আছে বলেও জানান তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ