Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হারিয়ে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির মাছ

মৎস্য সপ্তাহ শুরু, উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজ করছে সরকার : মৎস্য মন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, ডোবা-নালা, খাল-বিল ভরাট করায় মাছের আবাসস্থল কমে যাওয়া, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ফসলি জম

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ২৪ জুলাই, ২০২২, ১২:০১ এএম

মাছে-ভাতে বাঙালি চিরায়ত এই কথাটি এখন আর কাউকে খুব একটা বলতে শোনা যায় না। দেশের হাওর-বাওর, খাল-বিল, নদী-নালায় এক সময় মিঠাপানির দেশি প্রজাতির মাছ প্রচুর পাওয়া যেত। এখন আর সে সব মাছ খুব বেশি দেখা যায় না। গত কয়েক দশকে দেশি প্রজাতির অনেক মাছই হারিয়ে যেতে বসেছে। মৎস্য অধিদফতরের তথ্য মতে, হারিয়ে যাওয়া দেশি প্রজাতির মাছের সংখ্যা আড়াইশ’র বেশি। হাওর-বাওর, পুকুর, খাল-বিল, হাটবাজার কোথায়ও এখন আর মিঠাপানির অনেক সুস্বাদু মাছ আগের মত পাওয়া যাচ্ছে না। দেশি মাছের বদলে এখন পুকুরে, বাজারে জায়গা দখল করে নিয়েছে চাষের পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, ক্রস ও কার্পজাতীয় মাছ।

দেশি প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ক্রমেই হারিয়ে যাওয়ার জন্য অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, ডোবা-নালা, খাল-বিল ভরাট করায় মাছের আবাসস্থল কমে যাওয়া, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কারেন্ট জালের অবৈধ ব্যবহার, ফসলি জমিতে অপরিকল্পিত কীটনাশক ব্যবহার, নদীদূষণ, নদ-নদীর নব্য হ্রাস, উজানে বাঁধ নির্মাণ, নদী সংশ্লিষ্ট খাল-বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, ডোবা ও জলাশয় ভরাট করা, মা মাছের আবাসস্থলের অভাব, ডিম ছাড়ার আগেই মা মাছ ধরে ফেলা, ডোবা-নালা-পুকুর ছেঁকে মাছ ধরা, বিদেশি রাক্ষুসে মাছের চাষ ও মাছের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটানো। এছাড়া কৃষি ও চাষাবাদ ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। একই সঙ্গে পোনা আহরণ, নেটজাল ও মশারি জাল ব্যবহার করে খালে-বিলে-নদীতে মাছ ধরার কারণেও দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে।

এ অবস্থায় গতকাল থেকে সারা দেশে শুরু হয়েছে মৎস্য সপ্তাহ। রাজধানীর মৎস্য ভবনে মৎস্য অধিদফতরের সভা কক্ষে ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২২’ উদ্বোধন উপলক্ষ্যে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। শোভাযাত্রায় প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ শেষে সাংবাদিকদের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, মাছে-ভাতে বাঙালির যে ঐতিহ্য, তা আমরা ফিরিয়ে আনতে চাই। মাছ রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে চাই। মাছ চাষের মাধ্যমে বেকারত্ব দূর হবে, উদ্যোক্তা তৈরি হবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি সচল হবে। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাছ সবার কাছে পৌঁছে দেওয়াই সরকারের লক্ষ্য বলেও জানান তিনি। ২৩ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ-২০২২ উদযাপন হচ্ছে।
মৎস্য মন্ত্রী বলেন, মিঠা পানির মাছ, সামুদ্রিক মাছ সব ক্ষেত্রে আমাদের অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। বিগত ১৬ বছরের ব্যবধানে মাছের উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ মৎস্যখাতের অবদান। বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ ৩য়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে ৫ম, ইলিশ উৎপাদনে ১ম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে ৪র্থ স্থানে রয়েছে।

তবে মন্ত্রীর দেওয়া এ তথ্যের সাথে বাস্তবে অনেকটা ফারাক দেখা যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষি ও চাষাবাদ ব্যবস্থায় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উজাড় হয়ে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির কৈ, মাগুর, শিং, পাবদা, টেংরা, পুঁটি, ডারকা, মলা, ঢেলা, চেলা, শাল চোপরা, শৌল, বোয়াল, আইড়, ভ্যাদা, বুড়াল, বাইম, খলিসা, ফলি, চিংড়ি, মালান্দা, খরকাটি, গজার, শবেদা, চেং, টাকি, চিতল, গতা, পোয়া, বালিয়া, উপর চকুয়া, কাকিলাসহ প্রায় আড়াইশ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ। গ্রামে একসময় পৌষ-মাঘ মাসে পুকুর, খাল, ডোবা, ঘেরের পানি কমতে থাকলে দেশি মাছ ধরার ধুম পড়তো। অথচ এখন অনেক গ্রামেই দেশি প্রজাতির মাছ নেই বললেই চলে। শীতকালের বাইরে বর্ষাকালে ধানের জমিতে কইয়া জাল, বড়শি ও চাই পেতে মাছ ধরার রীতিও হারিয়ে গেছে অনেক এলাকা থেকে। যারা একসময় পুকুর, খাল-বিল, ডোবা, নালায় মাছ ধরে পরিবারের চাহিদা পূরণ করতেন, তাদের অনেকেই এখন বাজার থেকে মাছ কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছেন। খালে-বিলে মাছ না থাকায় যে সব জেলেরা মাছ বিক্রি করে সংসার চালাতেন তারা এখন বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করছেন।

তারপরও আশার কথা হচ্ছে, বিলুপ্ত হওয়া প্রায় ৩০ প্রজাতির দেশীয় মাছ এখন বিশেষ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হচ্ছে। তাছাড়া নদী-হাওর-বিলে দেশীয় মাছের পোনা অবমুক্তকরণ এবং মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় মাছের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। তবে উদ্বেগের বিষয়, বর্তমানে চাষ করা বিভিন্ন প্রজাতির মাছে বিরক্তিকর গন্ধের উপস্থিতি ভোক্তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। অভিযোগ রয়েছে, সামুদ্রিক পচা মাছ, ট্যানারির বর্জ্যসহ ক্ষতিকর ধাতু মেশানো হয় মাছের খাবারে। বিষাক্ত এই খাবারে বেড়ে ওঠা মাছ খেলে মানবদেহে নানা জটিল রোগ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানো মাছের খাবারের সঙ্গে মাছ দ্রুত বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। মাছ মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাই মাছ চাষের সঙ্গে সম্পর্কিত সব বিষয় যথাযথ পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষত মাছের কৃত্রিম খাবার নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখতে হবে, সেগুলোতে কোনো ক্ষতিকর পদার্থ আছে কি-না। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সব দেশি মাছের বিলুপ্তি ঠেকাতে ও এর উৎপাদন বাড়াতে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এমনটাই তাদের প্রত্যাশা।

রাজধানীর শান্তিনগর বাজারের মাছ ব্যবসায়ী আজাদ ইনকিলাবকে বলেন, কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকায় আমার বাড়ি। আজ থেকে পনের বিশ বছর আগেও মাছ কিনে খাওয়ার তেমন রেওয়াজ ছিল না আমার এলাকায়। কেনার মধ্যে শুধু ইলিশ মাছ কেনার কথাই মনে পড়ে। মাছের প্রয়োজন হলে সবাই বাড়ির সামনে বিলে বা নদীতে চলে যেত। খালে, পুকুরে তখন এত মাছ ছিল যে, কেউ খালি হাতে নেমেও হাতিয়ে মাছ ধরতে পারতো। অথচ এখন সারাদিন জাল নিয়ে বসে থাকলেও তরকারি রান্না করার মত মাছ পাওয়া যায় না।

গত বছরের মার্চ মাসে নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় হাওর এলাকায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে ভেসে উঠেছিল। সংশ্লিষ্ট জেলার মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, ধান পঁচে হাওরের পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি হয়ে অক্সিজেন কমে যাওয়ার কারণেই মাছ মরে গেছে। তবে হাওর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্ভিদ পঁচে অ্যামোনিয়া তৈরি হয় না। অন্য কোনও কারণ আছে। সেগুলোকে খুঁজে বের করতে খুব দ্রুত বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে হবে বলা হলেও তা এখনও করা হয়নি। গবেষণার পরিকল্পনাও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নেই।

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অর্থাৎ সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জের বিশাল হাওরকে মিঠাপানির মৎস্য সম্পদের আড়ত বলা হয়। তবে এই অঞ্চল থেকে দিন দিন কমে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির সুস্বাদু সব মাছ। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস, খাল-বিল ও জলাশয় শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে অসাধু জেলেরা অবাধে কীটনাশক প্রয়োগ করছে। এ ছাড়া কোণাবেড় ও কারেন্ট জাল দিয়ে নিষিদ্ধ উপায়ে মাছ শিকারের কারণে কমছে মিঠাপানির মাছ।

স্থানীয় মৎস অধিদফতর ও মৎস্যজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাওরাঞ্চলে একসময় প্রায় ২৬০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ও ২৪ প্রজাতির সুস্বাদু চিংড়ির আবাসস্থল ছিল। এ অঞ্চলের আহরিত মাছ নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবছর বিদেশে রপ্তানি করা হতো। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও মানব সৃষ্ট নানা কারণে বিস্তীর্ণ মৎস্য ভান্ডার এখন হুমকি মুখে। ইতিমধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। সংকটাপন্ন মাছের সংখ্যাও বহু।

মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, কয়েক দশক আগেও এ অঞ্চলে আড়াইশ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ছিল। মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতায় এসব মাছের অনেক প্রজাতি এখন আর চোখে পড়ে না। বর্ষা মৌসুমে নদী, খাল, বিল থেকে কারেন্ট জাল দিয়ে ব্যাপক হারে ডিমওয়ালা মাছ ধরার কারণে দেশি মিঠা পানির মাছের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

দেশি প্রজাতির মাছের হারিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, বিভিন্ন কারণেই দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে প্রকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে মানুষের সচেতনতার অভাবও রয়েছে। হারিয়ে যাওয়া দেশি মাছ রক্ষায় এখন ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে। ইতোমধ্যে পাবদা, টেংরা, বোয়াল, আইড়, পাঙ্গাস ও কৈ মাছের চাষ হচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ