Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সংরক্ষনে বঙ্গোপসাগরে ৬৫ দিনের আহরন নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল মধ্যরাতে আহরন নিষিদ্ধকালীন সময়ে জেলেদের খাদ্য সহায়তা

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ২৩ জুলাই, ২০২২, ৫:০৫ পিএম | আপডেট : ৫:০৮ পিএম, ২৩ জুলাই, ২০২২

বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে মৎস্য সম্পদ সমৃদ্ধ করণে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল গত মধ্যরাতে। সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সমৃদ্ধ করণে মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে গত কয়েক বছর ধরে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ রাখছে সরকার। এ বছরও গত ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞায় মৎস্য বিভাগ থেকে পুলিশ, র‌্যাব, কোষ্ট গার্ড সহ নৌ বাহিনীর সহায়তায় বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা সহ বিভিন্ন মৎস্য আড়ত, বাজার ও মাছের মোকামগুলোতে অভিযান এবং পরিদর্শনের মাধ্যমে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের চেষ্টা করেছে মৎস্য বিভাগ।

তবে দক্ষিণাঞ্চলে মৎস্য অধিদপ্তরের নিজস্ব কোন নৌযান না থাকায় ঝড়ঝঞ্ঝার এ মৌসুমে সাগর দুরের কথা উপক’লীয় এলাকাতেও মৎস্য বিভাগের পক্ষে তেমন কোন অভিযান পরিচালনা সম্ভব হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। শুধুমাত্র কোষ্ট গার্ড ও নৌবাহিনী স্বপ্রনোদিত হয়ে এ ব্যাপারে কঠোর নজরদারী চালায়।
তার পরেও গত ৬৫ দিনের এ নিষেধাজ্ঞার সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের সাগর উপক’লে প্রায় সাড়ে ৮শ অভিযান ও শতাধিক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে প্রায় ১০ টন বিভিন্ন ধরনের মাছ আটক করে বাজেয়াপ্ত করা হয়। এসময়ে বিপুল পরিমান নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ও বেহুন্দি জাল সহ বিভিন্ন ধরনের জাল আটক করে পুড়িয়ে ফেলা ছাড়াও জরিমানাও আদায় করা হয়েছে। তবে এবার কোন জেলেকে জেল হাজতে পাঠান হয়নি।
উপক’লের জেলে ও মৎস্যজীবীরা ৬৫ দিনের এ আহরন নিষিদ্ধের বিষয়টিকে ভালভাবে না নিলেও মৎস্য সম্পদের টেকসই উন্নয়নের স্বার্থেই তা করা হচ্ছে বলে মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। এমনকি আহরন নিষিদ্ধকালীন এ সময়ে উপক’লের প্রায় ৩ লাখ জেলে পরিবারকে দু দফায় মাথাপিছু ৮৬ কেজি করে চাল বিতরন করেছে সরকার।
ঝড়Ñঝঞ্ঝার এ মৌসুমেও ৬৫ দিন মৎস্য আহরনে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে বিশাল জেলে ও মৎস্যজীবীদের নানামুখি অভিযোগ থাকলেও মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, এর ফলে গত কয়েক বছরে দেশের মৎস্য সম্পদে লক্ষাধীক টন মাছ যোগ হয়েছে। অপরদিকে মৎস্যজীবীদের অভিযোগ, ‘বাংলদেশের সমুদ্র এলাকায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও এসময়ে ভারতে নিষিদ্ধ না থাকায় সে দেশের জেলেরা অবাধে আমাদের সমুদ্রসীমায় প্রবেস করে মাছ লুটে নিচ্ছে’। দেশের জেলেদের জেলÑজরিমানা করা হলেও ভিনদেশী জেলেরা আমাদের মাছ লুটে নিচ্ছে। তার তেমন কোন প্রতিকার হয়না।
মৎস্য বিজ্ঞানীগন এক্ষেত্রে ‘প্রতিবেশী দেশের সাথে সমতা রেখে সাগরে মৎস্য আহরন নিষিদ্ধ ঘোষনার সময় পুণঃ বিবেচনার’ তাগিদ দিয়েছেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের তাদের সীমানায় ১৫ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত মৎস্য আহরনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মিয়ানমারে জুন থেকে আগষ্ট পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। বিশে^র বিভিন্ন দেশেই মৎস্য সম্পদ সংরক্ষন ও সম্প্রসারনে বিভিন্ন সময়ে আহরন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এব্যাপারে মৎস্য অধিদপ্তরের পরিচালক(সামুদ্রিক) ড. মোঃ শরিফ জানান, ‘৬৫ দিন মাছধরা বন্ধ রাখায় সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের কার্যকরি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুফল পাচ্ছে দেশ।

আমাদের সাগর ও উপক’লে ২০১৫ থেকে ’১৮ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র বাণিজ্যিক ট্রলারের ক্ষেত্রে ৬৫ দিনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ কার্যকর থাকলেও ২০১৯ থেকে তা সব মৎস্য নৌযানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়েছে। এছাড়াও প্রতিবছর আশি^নের বড় পূর্ণিমার আগে-পড়ের ২২ দিন উপক’লের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে সব ধরনের মৎস্য আহরন সহ দেশের সব নদ-নদীতে ইলিশ আহরন নিষেধাজ্ঞায় গত দুই দশকে এ মাছের উৎপাদন প্রায় তিনগুন বেড়েছে। পাশাপাশি নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত দেশে ইলিশ পোনা-জাটকা আহনেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, দেশের মৎস্য সম্পদে সামুদ্রিক মাছের অবদান প্রায় ৮Ñ১০%। সমুদ্র এলাকায় প্রায় ৫.১৬ লাখ জেলে ২৫৫টি বানিজ্যিক ট্রলার ছাড়াও প্রায় ৭০ হাজার ইঞ্জিন চালিত ও ইঞ্জিন বিহীন নৌকায় ১ লাখ ৮৯ হাজার জাল সহ মাছধরার নানা সরঞ্জামের সাহায্যে মৎস্য আহরন করে থাকেন। চিংড়ির প্রজনন প্রক্রিয়া নিরাপদ ও নিশ্চিত করা সহ অন্যান্য মাছের বিচরন, প্রজনন ও উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি আহরন প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে, বঙ্গাপসাগরে নিজস্ব অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৬৫ দিনের মৎস্য আহরন নিষেধাজ্ঞার কোন বিকল্প নেই।
দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের সাতক্ষিরা থেকে পূর্ব-দক্ষিণের টেকনাফ পর্যন্ত ৭১০ কিলোমিটার উপক’লীয় তটরেখা এবং সমুদ্রের ২শ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত ‘একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা’র ১ লাখ ৪০ হজার ৮৬০ বর্গ কিলোমিটারে ছোট-বড় নানা প্রকারের ৪৭৫ প্রজতির মৎস্য সম্পদ আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখছে। এ ছাড়াও সমুদ্র এলাকায় ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া, ৫ প্রজাতির কচ্ছপ ও ১৩ প্রজাতির প্রবাল সহ বিভিন্ন জলজ সম্পদ আমাদের সমুদ্র সম্পদকে সমৃদ্ধ করেছে।
অপরদিকে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র ও মাইগ্রেশন পথ নির্বিঘœ রাখা সহ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের মজুদ ও জীব বৈচিত্রকে আরো সমৃদ্ধ করতে ২০১৯ থেকে হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন ৩ হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে দেশের প্রথম ‘সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা বা মেরিন রিজর্ভ এরিয়া’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বিভিন্ন বৈশিষ্ট ও বৈচিত্রপূর্ণ মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর বিশে^র একমাত্র উপসাগর যেখানে সবচেয়ে বেশী নদী বিধৌত পানি প্রবাহিত হয়। কিন্তু সম্প্রতিককালে বিশ^ব্যাপী ‘সামুদ্রিক ও উপক’লীয় মৎস্য সম্পদ অতি আহরন, ভ’মি ও সমুদ্র হতে সৃষ্ট দুষণ এবং জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন সহ নানামুখি সংকটের সম্মুখিন’। ফলে বাংলাদেশ সহ বিশে^র মৎস্যকুলের প্রাচুর্য, বিস্তৃতি ও প্রজাতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
এসব বিবেচনায় সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সংরক্ষন ও উন্নয়নে ৬৫ দিনের আহরন নিষেধাজ্ঞার কোন বিকল্প নেই বলেও মনে করছেন মৎস্য অধিদপ্তর ও মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর বিজ্ঞানীগন। ২৩-৭-২০২২.



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ