Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুরাদনগরে কৃষি জমির মাটি উত্তোলনের মহা-উৎসব

দেবিদ্বার (কুমিল্লা) উপজেলা সংবাদদাতা : | প্রকাশের সময় : ২৩ জুলাই, ২০২২, ১২:০১ এএম

কুমিল্লার মুরাদনগরে কিছুতেই থামছেনা কৃষি জমি থেকে ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে মাটি উত্তোলন। এতে বিলীন হচ্ছে উপজেলার তিন ফসলি জমি। উপজেলার ২২টি ইউনিয়নে প্রায় দুই শতাধিক অবৈধ ড্রেজার দিয়ে প্রতিনিয়ত কৃষি জমি থেকে মাটি উত্তোলন করছে স্থানীয় চক্ররা। এ বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় অর্ধ শতাধিক জমির মালিক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাবর বার বার অভিযোগ করেও নিরুপায় হয়ে তারা এখন ড্রেজার ব্যবসায়ী চক্রের কাছে জিম্মি।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অভিযানে বের হলে ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই খবর চলে যায় ড্রেজার ব্যবসায়ীদের কাছে। যার ফলে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদেরকে পাওয়া যায়না। তবে ব্যবসায়ীদের না পেলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তার অভিযান শেষে অবৈধ ড্রেজার মেশিন জব্দ করে নিয়ে আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবারো সেখানে বসানো হয় অবৈধ নতুন ড্রেজার মেশিন। ফলে স্থানীয়দের মুখে এখন একটাই শব্দ অভিযান কি তাহলে শুধুই লোক দেখানো?
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার ৩১২টি গ্রামের মধ্যে প্রায় দু’শতাধিক গ্রামের কোন না কোন স্থানে অবৈধ ড্রেজার মেশিন চলে। মাইলের পর মাইল পাইপ সংযোগ দিয়ে ড্রেজিংয়ের মাটি দিয়ে কোথাও ফসলি জমি আবার কোথাওবা পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। বর্তমানে অবৈধ ড্রেজিংয়ের কারণে ৫০/৬০ ফুট গভীর থেকে মাটি ও বালি উত্তোলনের ফলে আশ-পাশের তিন ফসলের জমিগুলো পরিনত হচ্ছে কূপে।
মুরাদনগর উপজেলার বেশ কয়েকজন কৃষক বলেন, ড্রেজার বসিয়ে গভীরভাবে মাটি কাটার কারণে আমাদের তিন ফসলী জমি ড্রেজিং গর্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কেউ যদি ইচ্ছা করে জমি দিতে না চায়, তাহলে সেখান থেকে জোর পূর্বক মাটি কাটা শুরু করে শেষ পর্যন্ত ড্রেজার মালিকদের নিকট কমমূল্যে জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সাধারণ কৃষক। ড্রেজার সিন্ডিকেটরা জমির মালিকদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দিয়ে জিম্মি করে রাখে এবং রাজনৈতিক নেতাদের নাম ভাঙ্গায়। ফলে তাদের ভয়ে কেউ কোন অভিযোগ করে না। আর যদিও কেউ অভিযোগ করে প্রশাসনের লোকজন আসার আগেই কিভাবে যেন তারা টের পায়। পরে মেশিনপত্র বন্ধ করে চলে যায়। পরক্ষণে প্রশাসনের লোকজন চলে গেলে তারা আবারো মাটি কাটার উৎসবে মেতে ওঠে। শুনেছি সবাই নাকি ভূমি অফিসের লোকজনকে টাকা দিয়া ড্রেজার চালায়। গণমাধ্যমকর্মীদের নিকট তাদের দুঃখের কথা বলতে গিয়ে অনেক কৃষক কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
ড্রেজার ব্যবসায়ী হারুন মুন্সী বলেন, সবাই মনে করে আমরা ড্রেজার চালাইয়া কত টাকা জানি কামাইতাছি। আসলে এক সময় ঠিকই কামাইতে পারতাম। প্রতি প্রজেক্টে দেড় থেকে ২ লাখ টাকা লাভ হইতো। তখন কাউকে অতো টাকা দিতে হইতো না। এখন ড্রেজার মেশিন বসিয়ে পাইপ লাগানোর সাথে সাথে চলে আসে নায়েব সাব (ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা)। তাকে দিতে হয় ১৫-২০ হাজার টাকা। মেশিন চালু করতে না করতে গলায় কার্ড ঝুলিয়ে হাতে লাঠির মতো একটা মাইক লইয়া হাজির হয়ে পরিচয় দেয় আমি সাংবাদিক, টাকা না দিলে শ্রমিকদের মারধর পর্যন্ত করে। তাদেরকে প্রতি সপ্তাহে দিতে হয় ৮-১০ হাজার টাকা। আবার অনেকে প্রাইভেটকার করে এসে বলে আমি কি ছোট সাংবাদিক, তোর কি মনে হয়? তাদেরকে দিতে হয় বেশি টাকা। এর পর আসে স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ব্যক্তি। তাদেরও দিতে হয় টাকা। আবার মাঝে মধ্যে এসিল্যান্ড স্যার আইসা মেশিন লইয়া যায়। পরে নতুন করে মেশিন কিনে বসাতে হয়। সব মিলিয়ে এখন তেমন একটা লাভ করতে পারি না।
সচেতন মহলের লোকজন বলছে, এইসব অবৈধ ড্রেজারের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় যারা রক্ষক তারাই ভক্ষক এর ভূমিকায়। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমান ২৪ হাজার ২৯৩ হেক্টর। এর মধ্যে বেশীর ভাগই দুই থেকে তিন ফসলী জমি। অথচ সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিলের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত অনাবাদী রয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাইন উদ্দিন আহম্মেদ সোহাগ বলেন, আমি উদ্ধিগ্ন ও আতঙ্কিত। কেননা তিন ফসলি জমির টপসয়েল্ট (উর্ভর মাটির উপরের অংশ) ব্যাপকহারে কেটে নিচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৬ মাসের মধ্যে চাষাবাদের জন্য একখন্ড জমিও থাকবে না।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. নাজমূল হুদা বলেন, ভূমি অফিসের কোন কর্মকর্তা ড্রেজার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে এ বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি কারো বিরুদ্ধে এমন কোন অভিযোগ পাই, তাহলে অবশ্যই ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অভিষেক দাশ বলেন, এসব অবৈধ ড্রেজার নির্মূল করতে হলে সকলকে আন্তরিক হতে হবে। প্রত্যেকটি জায়গা থেকে সকলের সহযোগিতা পেতে হবে। তাহলে ড্রেজার বন্ধ করা সম্ভব। তবে যেখান থেকেই ড্রেজারের অভিযোগ এসেছে, সেখানেই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। আর অবৈধ ড্রেজার বন্ধে আমাদের অভিযান সবসময় অব্যাহত আছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ