Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিশুদের অগ্রাধিকার দিতে হবে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৬ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শৈশবের সোনালি দিনগুলো মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। সোনালি দিনগুলো হাসি আর আনন্দের মধ্যেই ফুরিয়ে যায়। শৈশবের সে দিনগুলোর মধ্যদিয়েই শিশুরা ভবিষ্যতের পথে পা ফেলে। প্রকৃতিতে শিশুদের শিক্ষাদীক্ষা, চরিত্র ইত্যাদির আধার শৈশবের সোনালি দিনগুলোতেই গড়ে ওঠে। চিরসবুজ প্রকৃতির কোলে নয়ন মেলে একটি শিশু যে পরিবেশ লাভ করে, সে পরিবেশ থেকেই দেখে-শুনে তারা জ্ঞান-শিক্ষা অর্জন করতে আরম্ভ করে। শিশু যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে, সে পরিবেশের প্রভাব তার জীবনে পড়া নিতান্তই স্বাভাবিক। তাই প্রতিটি শিশুকে জাতির, দেশের এবং বিশ্বের উপযুক্ত নাগরিক করে গড়ে তোলার জন্য সুস্থ, সবল পরিবেশের প্রয়োজন রয়েছে। এখানেই প্রশ্ন আজকের পৃথিবীতে শিশুরা কি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সুস্থ-সবল পরিবেশ লাভ করছে?
আমরা জানি শিশুরা শিশু বয়সে যে শিক্ষা পায়, তা-ই পরবর্তী জীবনের পাথেয়। মানুষের সর্বপ্রকার কর্মকা- পরিচালিত হয় জ্ঞান বা তথ্যের দ্বারা। জ্ঞান বা তথ্য রক্ষিত হয় মস্তিস্কে। মায়ের গর্ভে ভ্রুণ গঠনের মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে মস্তিস্ক গঠন হতে শুরু করে এবং তার কয়েকদিন পর থেকে শব্দ, কম্পন দ্বারা নিউরন নামক জ্ঞান ভা-ারে অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়। জন্ম পরবর্তী সময়ে শব্দ, আলো, স্বাদ, স্পর্শ, গন্ধ পভৃতির মাধ্যমে নানা প্রকার জ্ঞান অর্জন করে। এসব জ্ঞানকে বলা হয় ফাউন্ডেশন নলেজ। শিশুর ফাউন্ডেশন নলেজ তৈরি হয় সাধারণত জন্মের তিন বছর বয়সের মধ্যে। ফাউন্ডেশন নলেজ পরিবেশ থেকে বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত হয়। কখনও বই বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে হয় না। শিশুর প্রথম তিন বছরে ফাউন্ডেশন নলেজ ভালো হলে পরবর্তীতে ওই শিশুর মনোবিকাশ সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়।
শিশুর মনোবিকাশের আরেকটি ক্ষেত্র হল চিন্তার বিকাশ ও সুস্থ পরিবেশ। জ্ঞান দ্বারা চিন্তা পরিচালিত হয়। প্রতিটি শিশু পরিবেশ থেকে যুক্তি শিখে নেয়। বিশেষ করে পারিবারিক পরিবেশ থেকেই তাকে প্রথমে শিখতে হয়। যে কোন নতুন বিষয় তার কাছে উপস্থাপিত হলে সে নানা ধরনের প্রশ্ন করে। তারপর সে যুক্তির মাধ্যমে চিন্তা করে। পরিবেশ থেকে আসা নানা সমস্যা সমাধান করা বা সমস্যা এড়িয়ে চলার জন্য জ্ঞান ও চিন্তার ভূমিকাই প্রধান। সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয় এমন ধরনের চিন্তাকে আমরা সাধারণত অস্বাভাবিক চিন্তা বলি। অস্বাভাবিক চিন্তা, অতিরিক্ত চিন্তা, বারবার একই চিন্তা করার ফলে আচরণে নানা ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়।
কেউ অস্বাভাবিক আচরণ করলে তখন আমরা তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ বলে আখ্যায়িত করি। চিন্তার বিকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ থেকে জ্ঞান অর্জনের পর প্রত্যেক শিশুই বড়দের নানা ধরনের প্রশ্ন করে। এসব প্রশ্নের উত্তর বড়দের কাছ থেকে যুক্তিপূর্ণভাবে না পেলে শিশুদের যুক্তি ক্ষমতার বিকাশ হয় না। ভুল উত্তর পেলেও যুক্তি বিকাশ হয় না। ফলে শিশুদের মনোবিকাশ বাধা পায়। যৌথ পরিবারের শিশুরা সহজে বড়দের সঙ্গ পায়। তাই তারা সহজে পরিবেশ থেকে আগত যে কোনও তথ্যযুক্তি দিয়ে বুঝতে শেখে। একক পরিবারের শিশুরা সে সুযোগ পায় না। ফলে তারা লব্ধ জ্ঞান যুক্তি দিয়ে ঝালাই করতে পারে না।
জ্ঞান ও চিন্তার পরই হল আবেগ ও আচরণ। প্রত্যেক শিশুর আবেগ রয়েছে, রয়েছে ভয়, আনন্দ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, ভালবাসা, সুখ, দুঃখ প্রভৃতি। আবেগ নিয়ন্ত্রণ বা আবেগ শিক্ষা শিশুরা পরিবার বা সমাজ থেকে পায়। কোনও শিশুকে ভয় দেখিয়ে কোনও কাজ করানো হলে ওই শিশুর মনোবিকাশ স্বাভাবিক হয় না। জীবনের কোনও না কোনও কাজে সে ভয় পাবেই। যে সব শিশু ভালোবাসা পায় না বা উপেক্ষিত হয় তাদের মনোবিকাশ স্বাভাবিক হয় না।
তারা নানা ধরনের আবেগজনিত সমস্যায় ভোগে। শিশুর মনোবিকাশ ও সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টিতে বড়দের ভূমিকাই প্রধান। শিশু মনোবিজ্ঞানের মতে, বড়রা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে শিশুর মনোবিকাশ সুন্দর ও সুগঠিত করতে পারে। সুস্থ পরিবেশের মাধ্যমে শিশুর মনোবিকাশে বড়দের করণীয় কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় নিয়ে এখানে আলোচনা করা হল।  ১) শিশুর সঙ্গে খোলামেলা হতে হবে। ২) বয়স অনুপযুক্ত পাঠ্যবই দিয়ে শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান বিকাশকে বাধা দেয়া যাবে না। ৩) শিশুর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে হবে। ৪) শিশুদের বাস্তব জ্ঞান অর্জনের সহায়তা করতে হবে। ৫) শিশুর সামনে নেতিবাচক আচরণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ৬) পারিবারিক যে কোনও আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। ৭) শিশুরা না বুঝে অনেক প্রশ্ন করতে পারে। যদি কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে সমস্যা হয়, তাহলে সে উত্তর পরবর্র্তীতে শিশু বড় হলে দেবেন, তার আশ্বাস দেয়াই ভালো। ৮) শিশুকে নিয়ে বিভিন্ন পরিবেশে ভ্রমণ করতে হবে। ভ্রমণের সময় কথা বলতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে নতুন দেখা বিষয়গুলো। ৯) দৈনন্দিন কাজে শিশুকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া ভালো। ১০) যে কোনও সমস্যা আসলে তা সমস্যা নয় বলে বলা হবে সমাধান আছে। ১১) নানা ধরনের অভিজ্ঞতা বা গল্প কাহিনী বলা যায় শিশুর অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির জন্য। ১২) শিশুর সামনে নানা ধরনের নেতিবাচক আচরণও শিশুর মনোবিকাশ বাধাপ্রাপ্ত করে। শিশুর সামনে কোনও প্রকার অসৎ, একচোখা অপরাধ করা উচিৎ নয়। ১৩) ধমক বা শাস্তি দিয়ে শেখানোর চেষ্টা না করে, বুঝতে চেষ্টা করতে হবে শিশু কেন বিষয়টি বুঝতে পারছে না।
বলতে দ্বিধা নেই আজকের সমাজ ব্যবস্থায় শিশুরা তাদের প্রয়োজনীয় উপযুক্ত পরিবেশ পাচ্ছে না। সম্প্রতিকালে পৃথিবীর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে অশুভ শক্তির মায়াজাল। সন্ত্রাসবাদ থেকে আরম্ভ করে অর্থনৈতিক সমস্যা, জনবিস্ফোরণ, মানুষের নৈতিক চরিত্রের খলন ইত্যাদি অশুভ পরিবেশের মধ্যেই আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠতে হচ্ছে দেশ-বিদেশের ভবিষ্যতের সম্পদস্বরূপ এ সমস্ত শিশুদের।
শিশুরা যাতে সুস্থ-সবল পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারে এবং তারা যাতে নিজেদের অধিকার তথা প্রাপ্য সঠিকভাবে উপভোগ করতে পারে, তার জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় স্তরে সময়ে সময়ে চিন্তা-চর্চা করা হচ্ছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত বিশ্বে শিশুর অধিকার এবং সুরক্ষাতে এর সুরাহা হয়ে উঠেনি। উল্লেখ্য, জেনেভাতে ১৯৪৬ সালে জাতিসংঘের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং ওই সম্মেলনে শিশুর অধিকার খর্ব হওয়ার বিষয়ের ওপর আলোচনা করা হয়েছিল। জাতিসংঘ ১৯৫৯ সালে শিশুর অধিকারপত্র প্রকাশ করেছিল আবার ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শিশুর অধিকার বিষয়ে একটি সনদও গৃহীত হয়। কুড়িটি দেশ ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সনদটিতে অনুমোদন জানায়। পরবর্তীতে ওই সনদ শিশুর অধিকারবিষয়ক একখানি উল্লেখযোগ্য সনদরূপে চিহ্নিত হয়েছে।
সনদ শিশুর অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, শিশুরা বড়দের মতই এখন পৃথিবীর সকল অধিকার উপভোগ করার যোগ্য। বর্ণিত সনদে শিশুদের অধিকার চারটি মূল ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সে ভাগগুলো হলÑ১) জীবনে নিশ্চয়তার অধিকার, ২) নিরাপত্তার অধিকার, ৩) উন্নয়ন আর বিকাশের অধিকার এবং ৪) অংশগ্রহণের অধিকার। জীবনে নিশ্চয়তার অধিকারে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাদ্যের জোগান দেওয়া, সুচিকিৎসা, সুস্বাস্থ্য, বাসস্থান, উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করা ইত্যাদির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তার অধিকারে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী নির্বিশেষে শিশুকে অনাদর-অবহেলা না করা, শোষণ, নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন থেকে রক্ষা করা, শিশুশ্রম, যৌন উৎপীড়ন, শিশু অপহরণ ইত্যাদি থেকে শিশুকে রক্ষা করা ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে।
উন্নয়ন আর বিকাশের অধিকারে শিশুর শারীরিক এবং মানসিক উৎকর্ষ সাধনের কারণে খেলাধুলা, স্নেহ ভালোবাসা প্রদান, মনোরঞ্জনধর্মী অনুষ্ঠানে অশংগ্রহণের ব্যবস্থা করা, ব্যক্তিত্ব গঠন আর বিকাশের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অংশ গ্রহণের অধিকারে বয়স অনুপাতে শিশুর বক্তব্য প্রদানের ওপর গুরুত্ব প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ এবং জাতির বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণের নিশ্চিত ব্যবস্থা করা ও যে কোনও কথা প্রকাশের স্বাধীনতা প্রদান ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
শিশুর অধিকার সম্পর্কে জাতিসংঘের সনদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও আজকের শিশুশ্রম, যৌন উৎপীড়ন এবং অন্যায়-অবিচারের বলি হওয়া থেকে মুক্ত হতে পারেনি। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে, সম্প্রতি বিশ্বে শিশু এবং কিশোর-যোদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিবেদনের মতে, শিশু যোদ্ধাদের বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই যে বেশিরভাগ শিশু-যোদ্ধাই বিভিন্ন দেশ থেকে অপহরণ করে আনা হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী অ্যাঙ্গোলা, কলম্বিয়া, শ্রীলঙ্কা, রোয়ান্ডা, কংগো, আফগানিস্তান ইত্যাদি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন এবং সরকারি বাহিনীতে শিশু-যোদ্ধাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। সন্ত্রাসবাদে ডুবে যাওয়া দেশসমূহে যে ভাবে শিশুদের হাতে বন্দুক তুলে দেওয়া হচ্ছে, ঠিক সে ভাবেই আজকের বিশ্বে শিশুরা যৌন উৎপীড়নের বলি হচ্ছে। শ্রীলঙ্কার এল টি টি ই বা নেপালের মাওবাদী গেরিলারা শিশুদের অপহরণ করে নিয়ে তাদের ওপর যৌন উৎপীড়ন চালাচ্ছে। মার্কিন বিদেশ বিভাগের প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী পশ্চিম এশিয়া তথা পশ্চিমের দেশগুলো থেকেও যথেষ্ট সংখ্যক শিশু জোগান দেওয়া হয় এবং তাদের যৌন উৎপীড়নের কবলে পড়তে হয়। লন্ডনে অবস্থিত কোয়ালিশন টু স্টপ ইউজ অব চাইল্ড সোলজার নামের প্রতিষ্ঠানের মতে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর সদস্যদের আনন্দ প্রদানের কারণেও শিশুদের ব্যবহর করা হয়ে থাকে। তবে শিশুদের যৌন উৎপীড়ন করার ক্ষেত্রে আমাদের দেশও পিছিয়ে নেই।
সোনালি শৈশব চিনিয়ে নেওয়া শিশুদের সংখ্যা আজকের বিশ্বে কম নয়। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানে বর্তমানে ১৫ নিযুত শিশু-শ্রমিক রয়েছে। আর সে সমস্ত শিশু-শ্রমিকরা নিজেদের শ্রমের বিনিময়ে লাভ করছে সামান্যতম মজুরি। ইউনেস্কোর এক সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে বেশ কয়েক লাখ শিশু-শ্রমিক রয়েছে। এ সমীক্ষা ২০০০ সালের চালানো তথ্যের ওপর নির্ভর করে প্রকাশ করা হয়েছে। ভারতে শিশু-শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আজকের বিশ্বে শিশুদের মৃত্যুর হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জাতিসংঘের শিশু ট্রাস্টের প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। প্রতিবেদনের মতে, নগর-মহানগরের বস্তিতে জন্মগ্রহণ করা প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে ১০০ থেকে ২০০ শিশু অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কবলে পড়ে মৃত্যুবরণ করছে। দরিদ্র দেশে জন্মগ্রহণ করা এক-দশমাংশ শিশুর ১ বছর বয়সের আগেই মৃত্যু ঘটে চলেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী পাকিস্তানের করাচিতে এক হাজার শিশুর মধ্যে দু’শ’র বেশি শিশু স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অভাবেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। আমেরিকার মতো দেশে বর্তমানে দশ নিযুত শিশুর দারিদ্র্যের কবলে পড়াটা আশ্চর্য হলেও সত্য। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে আমেরিকার ৭.৬ নিযুত শিশু দারিদ্র্য সীমারেখার নিচে বসবাস করছিল। ২০১০ সালেও এর খুব একটা ব্যতিক্রম ঘটেনি। সে সঙ্গে আমেরিকাতে শিশু এবং কিশোর-কিশোরীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার প্রবণতার কবলে পড়ছে। ইউনাইটেড স্টেটস সাবস্টেন্স এবিউজ অ্যান্ড মেন্টাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (সামসা) নামের সংস্থার মতে- আমেরিকায় ১৪ থেকে ১৭ বছরের কিশোর-কিশোরীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জাতিসংঘের সনদে শিশুকে উপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের কথা বলা হয়েছে ঠিকই কিন্তু বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়া শিশুর সংখ্যা যথেষ্ট। একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়া শিশুর সংখ্যা ২৫ কোটিরও অধিক এবং বাংলাদেশের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়া শিশুর সংখ্যাও ৭০ লাখের মতো। ক্রিয়েটিভ চাইল্ড অ্যাডভোকেসি নামক গ্রন্থের লেখক আসাদ মাহমুদ শিশু-শ্রমিক এবং শিশু অপরাধীর বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন যে, পাকিস্তানের শিশু-শ্রমিক এবং শিশু অপরাধীর সমস্যাই পাকিস্তানের জন্য ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মতে, পাকিস্তান কিন্তু নিজের দেশের শিশু-শ্রমিক এবং শিশু অপরাধীর সমস্যা নিয়ে চিন্তিত নয়। তবে শিশু অপরাধীর সংখ্যা কেবল পাকিস্তানেই বৃদ্ধি পাচ্ছে না, অন্যান্য দেশেও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শিশুর উন্নয়নের দিশায় মনোযোগ দেয়ার জন্য সময়ে সময়ে নানা অনুষ্ঠান, সভা-সমিতি ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০০২ সালের মে মাসে জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো শিশু সম্পর্কীয় গুরুত্বপূর্ণ এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ১৮০টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।
জাতিসংঘের তদানীন্তন সচিব প্রধান কোফি আনান সভার প্রারম্ভে তার উদ্বোধনী বক্তব্যে বিশ্বে দেখা দেওয়া ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণেই শিশুর নায্য অধিকার হারিয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি সভায় বিশ্বের ১৮০টি দেশকে পৃথিবীর শিশুদের বসবাস করার উপযোগী করে গড়ে তোলার আহ্বান জানান। জাতিসংঘ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে শিশুকে যাতে যোদ্ধা হিসেবে ব্যবহার করা না হয় তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। শিশুশ্রম তথা শিশু-যোদ্ধা ইত্যাদি বন্ধ করার জন্য আইন প্রণয়ন করা হলেও সে আইনের দ্বারা যে শিশুর সমস্যাসমূহ সমাধান করা যাবে না, সেটা নিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শিশুদের ভবিষ্যৎ মানবসম্পদরূপে গড়ে তুলতে হলে শিশুকল্যাণের পথে প্রত্যেকটি দেশেরই গুরুত্ব সহকারে মনোযোগ দিতে হবে। শিশুদের তাদের প্রাপ্য অধিকার ভোগ করতে দেওয়ার অধিকার দিতে হলে সমাজ বা দেশের ধ্বজাধারীদের এগিয়ে আসতে হবে।
শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে শিশু তথা তার পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। কেবল আইন প্রণয়ন করে কিংবা সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দিয়ে শিশুদের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। জাতিসংঘের মতো সংগঠনের শিশুদের অধিকার সম্পর্কে সুপষ্ট ব্যাখ্যা দেয়ার পরেও শিশুদেরকে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মূল কারণ হচ্ছে সদিচ্ছা এবং আন্তরিকতার অভাব। এ ক্ষেত্রে আমাদের সমাজের সকল স্তরের মানুষ, সামাজিক সংগঠন এবং সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে আন্তরিকতার সাথে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক :  সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ