Inqilab Logo

সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপির প্রস্তাব এবং সরকারি দলের প্রত্যাখ্যান

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ২৫ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশে বিরোধী দলের দাবি মেনে নেয়ার নজির খুব কমই দেখা যায়। সেটা সংসদে হোক বা সংসদের বাইরের রাজনৈতিক দল হোক। দাবি যতই যৌক্তিক হোক, সরকারি দল তা বরাবরই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে উপেক্ষা করে যায়। কোনো বিলের ওপর সংসদে বিরোধী দল ও সরকারি দলের যুক্তি, পাল্টা যুক্তি বা তীব্র তর্ক-বিতর্ক হওয়ার পর যখন স্পিকার বিলটি পাসের জন্য আহ্বান জানান, তখন দেখা যায় বিরোধী দল সমস্বরে ‘না’ বলে, আর সরকারি দল ‘হ্যাঁ’ বলে। স্বাভাবিকভাবেই সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় স্পিকার ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়েছে, ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়েছে, ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়েছে বলে ঘোষণা দেন। বিরোধী দলের আপত্তি ও যুক্তি পরাজিতই থেকে যায়। সারা বিশ্বে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় অধিকাংশ সময়েই সরকারি দলের প্রস্তাবের জয় হয়। তবে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে মাঝে মাঝে বিরোধী দলের আপত্তির মুখে প্রস্তাব স্থগিত এবং সংশোধন হতে দেখা যায়। আমাদের দেশে এমন রেওয়াজ ও দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। এখানে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সম্পর্ক সব সময়ই ‘দা-কুমড়া’র। একে অপরকে দু’চোখে দেখতে পারে না, শত্রুজ্ঞান করে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বা পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়টি কেবল একবারই দেখা গেছে। আমরা ’৯০-এর গণআন্দোলনের বিষয়টি স্মরণ করতে পারি। এ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব দল একাট্টা হয়ে এরশাদকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। তার আগে এরশাদ কার কাছে পদত্যাগ পত্র দেবেন বা পদত্যাগের পর দেশের শাসনভার কার ওপর ন্যস্ত হবেÑ এ পরিস্থিতির অবসানে সব দলের মধ্যে ঐকমত্য হয়। সিদ্ধান্ত হয়, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাই করা হয় এবং এরশাদের পদত্যাগের পর দেশের শাসনভার সর্বসম্মতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর অর্পিত হয়। পরবর্তীতে জাতীয় নির্বাচন এই সরকারের অধীনে হলে বিএনপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে বসে। সে সময় সংসদে আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতির প্রস্তাব করে। বিএনপি প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতিতে বিশ্বাসী হলেও গণতন্ত্রের নব সূচনাকালে বিরোধী দলের সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব স্বসম্মানে গ্রহণ করে। সংসদে সর্বসম্মতিতে বা সবার ভোটে সংবিধান পরিবর্তন করে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়। আমরা ওই একবারই দেখেছি, বিরোধী দলের প্রস্তাবকে সরকারি দল কর্তৃক অকুণ্ঠচিত্তে গ্রহণ করতে। তারপর থেকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থে বিরোধী দলের কোনো প্রস্তাব গ্রহণের নজির আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। সরকারি দল কর্তৃক বিরোধী দলের প্রস্তাব গ্রহণের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। বিএনপি যদি সে সময়ে আওয়ামী লীগের প্রস্তাব নাকচ করে দিত, তাহলে হয়তো আজকের যে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা তা ফিরে আসত না।
দুই.
নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে পারস্পরিক অবিশ্বাস দূর করা এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে নির্বাচনী পদ্ধতি সংযোজন করা হয়, তাও সর্বস্মতিতেই করা হয়েছিল। এ সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে পরাজিত দলের প্রথাগত অভিযোগ থাকলেও শেষ পর্যন্ত ফলাফল মেনে নেয়ার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসার পর আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ ঘোষণা করায় আওয়ামী লীগ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান সংশোধন করে তা বাদ দিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ বিরোধিতা করলেও সরকারি দল আওয়ামী লীগ তা আমলে নেয়নি। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ শুরুতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মতামত দিলেও পরবর্তীতে অবস্থান পরিবর্তন করে। এমনকি পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলে আদালত যে রায় দেয়, তাও বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়নি। বিরোধী দল বিএনপি ও তার জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন এবং জোর আন্দোলন করেও সফল হতে পারেনি। সরকার তাদের দাবি আমলেই নেয়নি। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলে দিয়েছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কবরস্থ হয়েছে এবং বারবার বলেছেন, আগামী নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনেই হবে। অর্থাৎ বিরোধী দলের কোনো দাবিই সরকার গ্রহণ করেনি এবং তার আন্দোলন মাঠেই মারা গেছে। সরকারি দলের যে ক্ষমতা এবং আধিপত্য, তাতে এটা এখন নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়া যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার দূরে থাক, নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া সুদূরপরাহত হয়ে পড়েছে। এ প্রেক্ষিতে বিরোধী দলের আর কী করার থাকতে পারে! একটাই পথ, নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে গঠন করে শক্তিশালী করা। নির্বাচন কমিশনকে সরকারের আনুগত্য পোষণ থেকে পুরোপুরি মুক্ত রাখা গেলে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা হয়তো সম্ভবপর হতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন নাও হতে পারে, যদি নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও শক্তিশালী হয়। নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনই তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। দুঃখের বিষয়, কোনো রাজনৈতিক দলই নির্বাচন কমিশনারকে স্বাধীন, শক্তিশালী ও তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকায় আনার বিষয়টি আমলে নেয়নি। নেয়নি সম্ভবত এ কারণে যে, নির্বাচন কমিশনকে তারা সব সময়ই তাদের করতলে বা আজ্ঞাবহ করে রাখতে চেয়েছে। এর মাধ্যমে জয়লাভ করতে চেয়েছে। এখন পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফিরে আসার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই, তাই নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করারও কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সঙ্গত কারণেই দেশের নাগরিক সমাজ থেকে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার দাবি এখন জোরালো হয়ে উঠেছে। বিদেশিরাও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করার কথা বলছে। সম্প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের (ইপি) প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সফরকালে সংবাদ সম্মেলনে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করার কথা জোর দিয়ে বলেছে। তারা বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সমর্থ নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। এ কমিশন গঠনে অবশ্যই উপযুক্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মেনে চলতে হবে। তারা নিজ দেশের উদাহরণ দিয়ে বলেন, নির্বাচন কমিশন এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে। সেই রকম মেকানিজম ইউরোপে রয়েছে। ইউরোপে সব দলের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়ে থাকে। দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে নাগরিক সমাজের বিশিষ্টজনদের পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গত শুক্রবার নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি রূপরেখা উপস্থাপন করেছেন। ১৩ দফার এ রূপরেখায় নির্বাচন কমিশন কীভাবে গঠিত হতে পারে, তা প্রস্তাব করা হয়েছে। তার প্রস্তাব উত্থাপনের পরপরই সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তা ‘অন্তঃসারশূন্য’ বলে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল এত দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে যে, এতে মনে হতে পারে তারা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন, এ প্রস্তাব গ্রহণ করবেন না। ক্ষমতাসীন দলের এ সর্বৈব প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি অনেকের কাছেই ‘ধাক্কা’ হিসেবে ঠেকেছে। প্রস্তাব দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে উড়িয়ে দেয়া অনেকেই মানতে পারেননি। তারা মনে করছেন, প্রস্তাব যে কেউই দিতে পারে। জাতীয় ইস্যুতে দেয়া প্রস্তাবের ভালো-মন্দ নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ হতে পারে। তারপর একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যেতে পারে। তা একেবারে আমলে না নিয়ে প্রত্যাখ্যান করা রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সৌজন্যতার পক্ষে মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। বলাবাহুল্য, পত্র-পত্রিকার বদৌলতে বিএনপির এ প্রস্তাব খালেদা জিয়া উত্থাপনের বেশ কয়েক দিন আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। ক্ষমতাসীন দল যেমন জেনেছে, তেমনি দেশের মানুষও জেনেছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপনের পর ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে, তারা যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছে। তাদের তাৎক্ষণিক প্রস্তাব নাকচের বিষয়টি অনেকের কাছেই মনে হয়েছে, তারা বিএনপি নামক দলটিকে পাত্তা এবং তার কোনো কথাই শুনতে চায় না। ক্ষমতাসীন দলের এমন প্রতিক্রিয়া অনেকে ভালোভাবে নেয়নি। তারা মনে করেন, ক্ষমতাসীন দল বলতে পারত, প্রস্তাব আমরা দেখেছি, সময় নিয়ে বিশ্লেষণ করে জবাব দেব। তবে এটাও ঠিক, সরকার যেমন আগে থেকেই প্রিডিটারমাইন হয়েছিল বিএনপির প্রস্তাব গ্রহণ করবে না, তেমনি বিএনপিও বিলকুল জানত, সরকার তা গ্রহণ করবে না। তারপরও একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করার ক্ষেত্রে বিএনপি যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাকে বিশেষজ্ঞরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। কারণ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এ দাবি তাদেরও। বিএনপি প্রস্তাব দেয়ায় তার এ দাবির পক্ষে শক্তিশালী সমর্থন পাওয়া গেল। এ প্রস্তাবের মাধ্যমে এটাও স্পষ্ট হয়েছে, বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক। তার এই ইচ্ছা পোষণকেও বিশেষজ্ঞরা স্বাগত জানিয়েছেন।
তিন.
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করে ভুল করেছিল বলে সরকারি দলের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়। আবার কেউ কেউ ঘুরিয়ে বলেন, বিএনপি যাতে নির্বাচনে না আসে, এ জন্য ক্ষমতাসীন দল ইন-আউট সব ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছিল। এ কৌশলের কাছে বিএনপি পরাস্ত হয়ে নির্বাচন বর্জন করেছিল। আপাত দৃষ্টিতে বিএনপির নির্বাচন বর্জনের বিষয়টি ভুল ঠেকতে পারে। কারণ বিএনপি যদি ভুল করেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করত, তাহলে ক্ষমতাসীন দল উল্টো সমস্যায় পড়ে যেত। গৃহপালিত বিরোধী দল নিয়ে তাদের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের কৌশল ভেস্তে যেত। ফলে ক্ষমতাসীন দলের লক্ষ্যই ছিল, বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা। সেটা স্থানীয় হোক বা জাতীয় হোক। সরকারি দল ভালো করেই জানে, বিএনপিকে যদি উত্তেজিত করে সব ধরনের নির্বাচন থেকে দূরে রাখা যায়, তাহলে কোথাও তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। একপ্রকার ‘নাই’ হয়ে যাবে। দেরিতে হলেও বিএনপি হয়তো ক্ষমতাসীন দলের এ কৌশল বুঝতে পেরেছে এবং মনে করছে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা তাদের ভুল ছিল। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া আধিপত্য, হামলা-মামলা, নির্যাতন উপেক্ষা করে পৌরসভাসহ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে তার এই উপলব্ধি বোঝা যায়। বিএনপির এই বিলম্বিত উপলব্ধিই এখন ক্ষমতাসীন দলের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্রতিপক্ষকে দমনে তার যে অবাধ ‘স্পেস’ ছিল তা কিছুটা হলেও সংকুচিত হয়ে আসছে। মানুষের যখন অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র সংকুচিত হয়, তখন তার ভেতর এক ধরনের ক্ষুব্ধতা ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপি ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে এ ক্ষুব্ধতা এবং কিছুটা উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পেরেছে। বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করত, তখন তার বিপক্ষে অনেক যুক্তিই উপস্থাপন করা যেত। যেমনটি করা হয়েছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা নিয়ে। ক্ষমতাসীন দল ও তার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা অহরহ যুক্তি দেখিয়েছে, কেউ নির্বাচন নাই করতে পারে এবং নির্বাচনে না এলে তো জোর করে আনা যায় না। এ যুক্তি যেমন একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না, তেমনি তা সুষ্ঠু রাজনীতির ক্ষেত্রে মোটেও সঠিক নয়। কারণ বিএনপির জায়গায় যদি আওয়ামী লীগ থাকত, তখন তারা এ যুক্তি দিত কিনা সন্দেহ। বলাবাহুল্য, এসবই কুতর্ক। তবে একটা বিষয় এখন স্পষ্ট, বিএনপি নির্বাচনে না এলে ক্ষমতাসীন দলের যত সুবিধা, নির্বাচনে এলে তার চেয়ে বেশি অসুবিধা। বাস্তবতা হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের পথের সবচেয়ে বড় কাঁটা এখনো বিএনপিই। অন্য কোনো দল নয়। ক্ষমতাসীন দল ভালো করেই জানে, বিএনপি নির্বাচনে এলে এর নিরপেক্ষতা ও সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে জবাবদিহি করার একটা দায়বোধ জন্মাবে। ফেল করুক বা পাস করুক, বিএনপির জনসমর্থন তার ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। এ চাপ ক্ষমতাসীন দল নেবে কেন! তাই বিএনপিকে যতভাবে পারা যায়, নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে পারলেই তার জন্য মঙ্গল। এখন আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই ক্ষমতাসীন দলকে উষ্ণ করে তুলছে। এটা বোঝা যায়, নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিএনপির প্রস্তাব দেয়ার প্রতিক্রিয়া থেকে। এ প্রস্তাব যে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। তা নাহলে চটজলদি প্রস্তাব নাকচ করে জ্বালা জুড়ানোর কাজ করত না। বিএনপি এটা কতটা বোঝে, তা অনেকেরই বোধগম্য নয়। তবে দেশের সুষ্ঠু রাজনীতির স্বার্থে যে বিএনপিকে খুবই প্রয়োজন, এটা নাগরিক সমাজ ও দলনিরপেক্ষ বিশিষ্টজনরা আড়েঠাড়ে বহুভাবে বলে চলেছেন। তাদের এই উপলব্ধি থেকে এটাই বোঝা যায়, বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবে এবং সংসদে যেতে হবে। বিএনপির অস্তিত্বের স্বার্থেই তাকে তা করতে হবে। আমরা দেখেছি, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৩০-৩২টি সিট নিয়ে যখন বিএনপি সংসদে বিরোধী দল ছিল, তখন সরকার তার ওপর এতটা চড়াও হতে পারেনি। নিপীড়ন-নির্যাতনের ক্ষেত্রে সরকারকে যথেষ্ট সচেতনতা অবলম্বন করতে হয়েছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির ওপর চরম স্টিমরোলার চালানো থেকে। এমনকি এরশাদের মতো লোককেও বিএনপিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে দেখা যায়। বিএনপি যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে প্রস্তাব দিয়েছে, এর প্রতিক্রিয়ায় এই গত রবিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, সংসদের বাইরে থাকা কোনো দলের প্রস্তাব দেয়ার অধিকার নেই। এরশাদের মুখ থেকে এ ধরনের কথা শুনে তাজ্জব হওয়া ছাড়া আর কী গতি থাকতে পারে! বিএনপির সমর্থকদের মনে হতে পারে, হাতি গর্তে পড়লে ইঁদুর-বেড়ালও লাথি মারে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি তার এ পরিস্থিতি আর চলতে দেবে কিনা? তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপিকে সংসদে যেতে হবে। এতে দেশের রাজনীতির এখন যে করুণ অবস্থা তা অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে যাবে।  
চার.
বিএনপি যে আগামী নির্বাচনে যাবে তা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের প্রস্তাব দেয়া থেকে স্পষ্ট হয়েছে। এমনকি দলটি তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু থেকেও সরে এসেছে। সরকারের জন্য এটা মাথাব্যথার কারণ হলেও সচেতন ও নাগরিক সমাজের মধ্যে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার বিষয়টি বেশ ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করেছে। প্রাথমিকভাবে তারা আশা করছেন, বিএনপির অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক জমজমাট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে তারাও বেশ কথাবার্তা বলছেন। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য তারা জোর দাবি জানাচ্ছেন। সরকারি দল বিএনপির প্রস্তাব মানুক বা না মানুক, বিএনপির উচিত হবে, এ দাবির পক্ষে সোচ্চার থাকা। কারণ নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী না করার পক্ষে সরকারি দলেরও খুব বেশি কিছু বলার নেই। বিএনপি এ দাবিকে ‘ইটস মাই টার্ন’ বা ‘এবার আমার পালা’ হিসেবে নিতে পারে। সরকারি দল স্বাভাবিকভাবেই চাইবে সার্চ কমিটির মাধ্যমে বর্তমান কমিশনের মতোই তার আজ্ঞাবহ একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করতে। এটা যাতে করতে না পারে এ জন্য বিএনপির উচিত হবে, জনমত সৃষ্টি ও নাগরিক সমাজের মাধ্যমে চাপ তৈরি করা। নির্বাচন কমিশন গঠন করা নিয়ে সংবিধানে যে আইনের কথা বলা হয়েছে, তা প্রণয়নের দাবি করা। আইনটি প্রণীত হলে কীভাবে, কাদের নিয়ে এবং কী যোগ্যতা থাকলে নির্বাচন কমিশনার হওয়া যাবে, সব কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে। কারণ আইন এবং এর কাঠামোর মধ্যে পড়লে বাধ্যবাধকতার কারণেই অনিরপেক্ষ ব্যক্তির পক্ষেও তা লঙ্ঘন করা কঠিন।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ