Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পদ্মাসেতুর প্রভাবক ভূমিকা

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ২৬ জুন, ২০২২, ১২:০২ এএম

বলা হচ্ছে, ‘স্বপ্নের পদ্মাসেতু’। আসলেই একদা পদ্মাসেতু স্বপ্নের মধ্যে ছিল। ‘প্রমত্তা পদ্মা’, ‘কীর্তিনাশা পদ্মা’, ‘সর্বনাশা পদ্মা’ ইত্যাদি নামে পদ্মাকে অভিহিত করা হয়। পৃথিবীর দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী পদ্মা। এরকম বেপরোয়া নদীকে বাঁধের শিকল পরিয়ে দেয়া যাবে, এমনটা ভাবতে কল্পনার জোর লাগে। অনেক দিন ধরে বাংলাদেশ ‘অভাবী’, ‘দরিদ্রপীড়িত’, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত’ দেশ হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতার পর একে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে বর্ণনা করা হয়। সেই দেশে পদ্মাসেতুর মতো একটা মহাপ্রকল্প ও কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে, তাও নিজস্ব অর্থে, সেটা বিশ্বাসে আসেনি। পদ্মা দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমকে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব থেকে আলাদা করে রেখেছে। দুই অংশকে জুড়ে দেয়ার আকাক্সক্ষা বা স্বপ্ন অস্বাভাবিক নয়। স্বপ্ন তো ছিলই। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের উপায়, সামর্থ্য, সাহস ও দৃঢ়তা ছিল না। আজ পদ্মাসেতু স্বপ্ন নয়, বাস্তব। পদ্মাসেতু আমাদের সামর্থ্য-সক্ষমতার প্রমাণ, সাহসের প্রকাশ এবং অহংয়ের প্রতীক। পদ্মাসেতু নির্মাণে যার ইচ্ছা, দৃঢ়তা, আন্তরিকতা ও দুঃসাহসিকতা সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে, তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় এই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সঙ্গে তার নামও ওতপ্রোত হয়ে গেছে।

পদ্মাসেতু শুধুমাত্র একটি নদীসেতু নয়, তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। দেশের দু’অংশের মিলনের সেতুবন্ধ এই সেতু। পদ্মায় লালনশাহসেতু কিংবা রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আছে বটে, তবে তাদের ব্যবহার এবং প্রভাব যোগাযোগ ও অর্থনীতিতে তেমন বেশি নয়। যমুনায় নির্মিত বঙ্গবন্ধুসেতুর সুবিধা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে লালনশাহসেতু নির্মিত। আর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ তো কেবলই রেলসেতু। মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া এবং শরীয়তপুর জেলার জাজিরা প্রান্ত সংযোগকারী বহুল আলোচিত পদ্মাসেতু সবদিক দিয়েই আলাদা ও স্বতন্ত্র। পদ্মাসেতু যে সম্ভাবনা ও সেবা উন্মুক্ত করতে যাচ্ছে, তাতে হয়তো বলতে হবে, পদ্মাসেতুর আগের বাংলাদেশ আর পরের বাংলাদেশ এক নয়। দু’য়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। পদ্মাসেতুর কারণে বহু ক্ষেত্রে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে। যোগাযোগ, কৃষি, শিল্প, অবকাঠামো, পর্যটন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। উন্নয়ন ও জনগণের জীবনমান ত্বরান্বিত হবে। আমরা কয়েকটি বিষয়ে এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করব।

১. যোগাযোগ : দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের পদ্মা পাড়ি দিয়ে এপারে আসা দুরূহ। ফেরি, লঞ্চ, নৌকাসহ বিভিন্ন নৌযানই এক্ষেত্রে ভরসা। এতে সময় বেশি লাগে, ব্যয় বেশি হয় এবং দুর্ঘটনার আশঙ্কাও থাকে। দ্বিতীয়ত, পণ্যসামগ্রী পরিবহন একই কারণে ব্যাহত হয়। পদ্মাসেতুর ফলে মানুষের যাতায়াত যেমন অনেকটাই নিরাপদ ও সহজ হবে, তেমনি পণ্যাদির পরিবহনও দ্রুতায়িত হবে।

২. কৃষি : দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও বাণিজ্য এখনকার তুলনায় অনেক বাড়বে। উৎপাদনের উপকরণাদির দ্রুত প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে মূল্য কমলে উৎপাদন উৎসাহিত ও বেশি হবে। আবার এপারের সবচেয়ে বড় বাজার রাজধানীসহ অন্যান্য বাজারে কৃষিপণ্যের দ্রুত আগমনে ভোক্তারা সুবিধাপ্রাপ্ত হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফাবাজির সুযোগ কম হবে। উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়েই অধিক লাভবান হবে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল তুলনামূলকভাবে সব দিক দিয়েই পিছিয়ে আছে। দরিদ্র্যের সংখ্যা ও হার সেখানে বেশি। কৃষি উৎপাদন ও কৃষিপণ্যের বাণিজ্য বাড়লে তাদের বিশেষ উপকার হবে।

৩. শিল্প : দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একমাত্র খুলনা ছাড়া আর কোথাও শিল্প-কারখানা তেমন গড়ে ওঠেনি। খুলনার সেই শিল্পের রমরমাও আর নেই। পদ্মাসেতু ওই অঞ্চলে শিল্পবিকাশের দুয়ার খুলে দিতে পারে। পাট, বস্ত্র, চামড়া শিল্প গড়ে উঠতে পারে। গড়ে উঠতে পারে বিভিন্ন এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পবিকাশের সম্ভবনাও যথেষ্ট। ইতোমধ্যে মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল, ইপিজেড গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পদ্মাসেতুর কাছেই শেখ হাসিনা তাঁত পল্লীর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এসব শিল্পসম্ভাবনা ও শিল্পোদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে শুধু ওই অঞ্চলই শিল্পসমৃদ্ধ হবে না, দেশও শিল্পের ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে যাবে।

৪. উন্নয়ন : পদ্মাসেতু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উন্নয়নের প্রবাহ আরো জোরদার করে তুলতে পারে। পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে। রূপপুরে পারমাণকিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালীতে শিপ বিল্ডিং শিল্পের ব্যাপক সম্ভবনা রয়েছে। পদ্মাসেতুতে যেহেতু রেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ইন্টারনেট থাকবে, সুতরাং আরো বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আবাসন প্রকল্প, রিসোর্ট, বিনোদন কেন্দ্র, হাইটেক পার্ক, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।

৫. পর্যটন : পদ্মসেতু পর্যটনকেও উদ্দীপ্ত করবে। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত এক বিরল দর্শনীয় স্থান। ওই সৈকতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। সেটা পর্যটকদের জন্য একটা বিশেষ আকর্ষণ। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় আছে বিশ্বসেরা ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। ওই অঞ্চলে আছে ষাটগম্বুজ মসজিদসহ বহু ঐতিহাসিক ও প্রত্ননিদর্শন। যাতায়াত সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হলে এবং অনুকূল সুযোগ-সুবিধা ও পরিবেশ নিশ্চিত হলে পর্যটনে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

৬. কর্মসংস্থান : যেহেতু পদ্মাসেতুর সুবাদে কৃষি, শিল্প, উন্নয়ন, পর্যটন প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নতি ও অগ্রগতি ঘটবে, কাজেই বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানও হবে। এক গবেষণা মতে, পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পর প্রতি বছর দেশের মোট শ্রমশক্তির ১.০৪ শতাংশের কর্মসংস্থান হবে। সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনমান বাড়বে। অভাব-দারিদ্র্য কমবে। শুধুমাত্র সেতুর কারণে ফি বছর ১.০১ কমবে দারিদ্র্যের হার।

৭. আন্তর্জাতিক যোগাযোগ : পদ্মাসেতুর কারণে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নতুন মাত্রা লাভ করবে। ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে এই সেতু। সড়ক ও রেলে আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এই সেতুর গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পাবে। শুধু যাতায়াতের ক্ষেত্রে নয়, পণ্য পরিবহনে তা বিশেষ ভূমিকা রাখবে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মানুষের মধ্যে সংযোগ ও সম্পর্ক এতে আরো বাড়বে এবং পণ্যবাণিজ্যেরও প্রসার ঘটবে।

উপসংহারে বলবো, পদ্মাসেতু দেশের মানুষের জীবন, জীবনমান এবং সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান রাখবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, পদ্মাসেতু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়াবে ২.০৫ শতাংশ। আর দেশের জিডিপি বাড়াবে ১.২৩ শতাংশ। রেলের কারণে জাতীয় জিডিপি আরো ১ শতাংশ বাড়বে। বিশ্ব ব্যাংকের মতে, এই সেতু থেকে দেশের এক-পঞ্চমাংশ মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে। আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়বে। দারিদ্র্য বিমোচন হবে এবং উন্নয়ন-সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পদ্মাসেতুর প্রভাবক ভূমিকা
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ