Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পদ্মাসেতুর জানা-অজানা কথা

সৈয়দ আবুল হোসেন | প্রকাশের সময় : ২৬ জুন, ২০২২, ১২:০২ এএম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্ত আর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে পদ্মাসেতু নির্মাণ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। পদ্মাসেতু আমাদের অহংকারের প্রতীক। পদ্মাসেতু আমাদের গৌরবের প্রতীক। পদ্মাসেতু আমাদের সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। প্রকৌশলগত এক বিস্ময়ের প্রতীক। পদ্মাসেতু আমাদের সততার প্রতীক। পদ্মাসেতু আমাদের অপমানের প্রতিশোধ, ষড়যন্ত্রের জবাব। পদ্মাসেতুর ফলে জাতির আত্মবিশ^াস বেড়েছে। পদ্মাসেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সততা ও সাহসের সোনালি ইতিহাস। প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে পদ্মাসেতুর মতো একটি কালজয়ী স্থাপনা আমাদের উপহার দিয়েছেন। তাঁকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে অভিনন্দন জানাই।

পদ্মাসেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ শুধু ভিত্তিহীন ও বানোয়াটই ছিল না, তা ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত। যার ভিত্তি ছিল গালগল্প আর গুজব। এখানে বিন্দুমাত্র সত্য ছিল না, ছিল না কোনো বিবেচনাবোধ আর নৈতিকতা। যখন পদ্মাসেতু নির্মাণের কোনো ঠিকাদার নিয়োগ হয়নি, কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি, কিংবা কোনো অর্থও ছাড় হয়নি, এই পর্যায়ে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল বিশ্বব্যাংকের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের একটি কূটকৌশল মাত্র। পরবর্তী সময়ে দুদকের তদন্ত এবং কানাডার আদালতের রায়ে আমাকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলা হলে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ যে মনগড়া ও অসত্য তা প্রমাণ হয়।

বিশ্বব্যাংক যখন তার সমর্থিত ঠিকাদার নিয়োগে ব্যর্থ হয়, তখনই বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও কূটকৌশল শুরু করে। আমরা চেয়েছিলাম পদ্মাসেতুর নির্মাণকাজ ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের রাজনৈতিক এজেন্ডা ছিল আমাদের সরকারের মেয়াদকালের মধ্যে যাতে পদ্মাসেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন না হয়। তৎকালীন বিশ্বব্যাংকের ঢাকাস্থ প্রতিনিধি মিস গোল্ড স্টেইনের সাথে বিভিন্ন সময়ে কথাবার্তা, আলাপা-আলোচনা এবং তার চালচলন, কর্মতৎপরতা থেকে বুঝা যায় যে, বিশ্বব্যাংক চায় না, এ সরকারের আমলে পদ্মাসেতু বাস্তবায়িত হোক। তাই তারা ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে পদ্মাসেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ ও বিলম্বিত করার চেষ্টা করে।

পদ্মাসেতুর দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আমাকে বিতর্কে পড়তে হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সে অভিযোগ অসত্য ও ভিত্তিহীন প্রমাণ হয়। আসলে পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্র যখন চারদিকে ডালপালা মেলে, অসত্য ও ভিত্তিহীন অভিযোগ যখন গোয়েবলসীয় কায়দায় প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়, তখন পদ্মাসেতু নির্মাণের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করি, আমার দপ্তর পরিবর্তন করে দিতে। প্রধানমন্ত্রী জানতেন, পদ্মাসেতু নির্মাণের ওই পর্যায়ে দুর্নীতির অভিযোগ অসত্য ও ভিত্তিহীন। কারণ পদ্মাসেতু নির্মাণে কোনো ঠিকাদার নিয়োগ হয়নি, কোনো চুক্তি হয়নি, কোনো অর্থছাড় হয়নি, সে পর্যায়ে দুর্নীতির প্রশ্ন আসে কীভাবে? পরের ইতিহাস সবার জানা। দুদকের তদন্ত ও কানাডার আদালতের রায়ে এ অভিযোগ ভিত্তিহীন প্রমাণ হয়। এক্ষেত্রে আমাকে নিয়ে যে বিতর্ক হয়, তার শেষ হয়। আমি নির্দোষ প্রমাণিত হই। আমি যে পদ্মাসেতুর নির্মাণে কোনো অনিয়ম করিনি, আমি যে সৎ ও কাজে একনিষ্ঠ ছিলাম তা দুদকের তদন্ত ও কানাডার আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয়।

পদ্মাসেতু নির্মাণ ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অঙ্গীকার। তাই যোগাযোগমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার প্রথম দিন থেকে আমি পদ্মাসেতু নির্মাণে মনোযোগী হই। পরামর্শ নিয়োগ প্রক্রিয়া, পরামর্শক নিয়োগে দরপত্র আহ্বান, মূল সেতুর প্রাক-যোগ্য দরপত্র আহ্বান এবং সেতুর অর্থায়ন সংস্থা- বিশ্বব্যাংক, জাপানের জাইকা, ইসলামি উন্নয়ন সংস্থা এবং এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নিই। স্বল্প সময়ে ভূমি অধিগ্রহণ করি। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনসহ যাবতীয় কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে আসি। এমনকি প্রাকযোগ্য দরদাতা নির্বাচন প্রক্রিয়াও শেষ করি। যেখানে বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রস্তুতি কাজ করতে ১০ বছর লেগেছে, সেখানে মাত্র দুবছরে আমরা পদ্মাসেতুর প্রস্তুতি কাজ শেষ করেছি। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে সেতুর কাজ শেষ হবে, এটাই ছিল আমার মূল টার্গেট এবং এ টার্গেট নিয়েই দ্রুততার সঙ্গে আমি কাজ এগিয়ে নিতে সচেষ্ট ছিলাম।

সব ডোনার এজেন্সির কো-অর্ডিনেটরের ভূমিকায় ছিল বিশ্বব্যাংক। তাই বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুর প্রস্তুতি কাজের প্রত্যেক পর্যায় অবলোকন ও অনুমোদন করে। পরামর্শক ও ঠিকাদার নিয়োগের প্রতিটি পর্যায় বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনে অগ্রসর হয়। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে কারিগরি কমিটি ঠিকাদার নিয়োগ ও কনসালট্যান্ট নিয়োগের কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু প্রাক-যোগ্য ঠিকাদার নির্বাচনের এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক, কারিগরি কমিটিকে একটি প্রাক-যোগ্য Qualified ঠিকাদারকে বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত থাকার কারণে বাদ দিতে বলে এবং একটি প্রাক-যোগ্যতায় Disqualified ঠিকাদারকে Qualify করতে বলে। কারিগরি কমিটি প্রাক-যোগ্য Qualified দরদাতাকে বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্তির কারণে বাদ দেয়। কিন্তু প্রাক-যোগ্য Disqualified দরদাতাকে অভিজ্ঞতার জাল সার্টিফিকেট দেওয়ায় Qualify করতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু বিশ্বব্যাংক প্রাক-যোগ্য Disqualified দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে Qualify করার লক্ষ্যে তার অনুকূলে বারবার কোয়ারি করে। প্রাক-যোগ্য Disqualified দরদাতাকে Qualified করতে কারিগরি কমিটি সম্মত হলো না। হওয়ার কোনো ন্যূনতম কারণও ছিল না। এরপরই তারা পদ্মাসেতুর কার্যক্রমে বাধা দিতে থাকে এবং নানা কর্নার থেকে অসত্য ও ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপন করে। উদ্দেশ্য, পদ্মাসেতুর বাস্তবায়ন বিলম্বিত করা।

বিশ্বব্যাংক সোজা পথে তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে না পেরে পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার নানামুখী অসৎ কর্মকাণ্ডের আশ্রয় নেয়। আমার বিরুদ্ধে দেশে নানা প্রপাগান্ডা শুরু করে। প্রাক-যোগ্য দরদাতা প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় এজেন্ট দিয়ে, স্থানীয় পত্রিকাকে প্রভাবিত করে, ভুয়া অভিযোগ দাঁড় করায় এবং পত্রিকায় প্রকাশ করে। যোগাযোগমন্ত্রীর অফিস মেরামত ও গাড়ি ক্রয়, কালকিনিতে ট্যাক্স প্রদত্ত অর্থে নির্মিত বাড়ি নিয়ে, সড়ক দুর্ঘটনাকে পুঁজি করে, ১/১১-এর বিভীষিকাময় দিনে অন্যায়ভাবে দুর্নীতিবাজ বানানোর কথা একাধারে নিউজ করায়। এসব পত্রিকার পেপার কাটিং বিশ্বব্যাংকে পাঠানো হয় ইংরেজি অনুবাদ করে। এভাবে বিশ্বব্যাংক পত্রিকার তথাকথিত অসত্য ও ভিত্তিহীন রিপোর্টের ভিত্তিতে আমার ব্যক্তিগত ইন্টিগ্রিটি নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং সে আলোকে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের প্রতিনিধি মিস গোল্ড স্টেইন আমাকে সেতু নির্মাণ কার্যক্রম ধীরগতিতে এগিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করেন। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের পদ্মাসেতুর সমন্বয়ক পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত জনৈক বিহারি এই ষড়যন্ত্রে সংশ্লিষ্ট ছিল বলে আমার মনে হয়েছে।

আমি যোগাযোগমন্ত্রীর পদ থেকে সরে আসার পরও বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে এগিয়ে আসেনি। বিশ্বব্যাংক আমাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর অন্যায় চাপ দেয়। পদ্মাসেতুতে মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগকে সামনে এনে নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল চেয়ারম্যান আইনজ্ঞ লুইস মোরেনো ওকাম্পোকে ঢাকায় পাঠায়। ওকাম্পো ঢাকায় এসে প্রথমেই কাদের সাথে, কোন কোন সম্পাদকের সাথে বৈঠক করেছেন তা গণমাধ্যম জানে। ওকাম্পোর লম্ফঝম্ফ গণমাধ্যম দেখেছে, দেশবাসী দেখেছে। দুদকের সঙ্গে বৈঠকে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি ওকাম্পো আমার বিরুদ্ধে পদ্মাসেতুর কার্যক্রমে কোনো দুর্নীতি প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, তৎকালীন সেতু বিভাগের সচিব এবং আমাকে অ্যারেস্ট করার কথা বলে। আমাকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে বারবার অনুরোধ করেন। কিন্তু দুদকের তদন্ত এবং পদ্মাসেতুর কার্যক্রমে আমার কোনো অনিয়ম না থাকায়, বিশ্বব্যাংক তার অভিযোগের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে না পারায় তারা আমার প্রতি কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো সুযোগ পায়নি। সার্বিক বিবেচনায়, দেশের স্বার্থে, পদ্মাসেতুর স্বার্থে আমি নিজেই মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করি। তারপরও বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুর অর্থায়ন স্থগিত করার ঘোষণা দেয়।

পদ্মাসেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করা ছিল বিশ্বব্যাংকের একটি চরম ভুল সিদ্ধান্ত। শুধু ভুল নয়, বোকামিও বটে। এই ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুর মতো একটি বড়ো প্রকল্পে অর্থায়নের সুযোগ হারালো। বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক বিশ্বব্যাংকের বোর্ডসভায় আলোচনা না করে এবং বোর্ড সভার অনুমোদন না নিয়েই নিজ উদ্যোগে কারও অন্যায্য নির্দেশে প্রভাবিত হয়ে পদ্মাসেতুর অর্থায়ন স্থগিত করেন। বিশ্বব্যাংকের অধিকাংশ কর্মকর্তাই অর্থায়ন স্থগিতের বিষয় সমর্থন করেননি রবার্ট জোয়েলিকের সাথে চায়নায় বোয়াও ফোরামে এক অনুষ্ঠানে আমার সাক্ষাৎ ও পরিচয় হয়। তখন তিনি পদ্মাসেতুর অর্থায়ন বাতিল করার বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। তখন আমি নিশ্চিত হই যে, তিনি কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এমন অনৈতিক কাজ করেন। রবার্ট জোয়েলিকের মতো বিশ্বব্যাংকের হাতে গোনা কিছু কর্মকর্তার ষড়যন্ত্রের কারণে পদ্মাসেতু অর্থায়ন না করার দায় বিশ্বব্যাংককে নিতে হলো। আমি মনে করি, বিশ্বব্যাংক সৃষ্টির পর থেকে আরো ১০০ বছরেও পদ্মাসেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ পাবে না। বিশ্বব্যাংকের সেই রবার্ট জোয়েলিক এখন কোথায়? মিস গোল্ড স্টেইন এখন কোথায়? সেই লুইস ওকাম্পো কোথায়? ওকাম্পোর দুর্নীতিবাজ হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছে। এ খবর দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। অথচ, ওকাম্পো বাংলাদেশে এসে সততার নাটক করেছেন।

মূলত বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান লুইস মোরেনো ওকাম্পোর নেতিবাচক রিপোর্টে বাংলাদেশের স্বপ্ন পদ্মাসেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে যায়। অথচ, ওকাম্পো আজ বিশ্বের বড় দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত। ওকাম্পোর দুর্নীতির চল্লিশ হাজার নথি ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। ওকাম্পোর নেতিবাচক রিপোর্ট পদ্মাসেতু নিয়ে বাংলাদেশকে বিতর্কিত ও সমালোচিত করেছে। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে আমার সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এই দুর্নীতিবাজ ওকাম্পোর পরামর্শেই বিশ্বব্যাংক গ্লোবাল সার্চ করে আমার সম্পর্কে কোন অনিয়ম পায়নি। বিশ্বব্যাংক আজ পদ্মাসেতুর অর্থায়ন করতে না পেরে বিশ্বব্যাপী লজ্জিত। ওকাম্পো আজ বিশ্বব্যাপী নিন্দিত ও বিতর্কিত। তার সাথে বাংলাদেশের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বৈঠক করে তার অপচেষ্টার সাথী হয়েছিলেন। দুদকের তৎকালীন একজন কমিশনার মিডিয়ায় একাধিকবার একথা প্রকাশ করেছেন। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। আজ সত্য প্রকাশিত হয়েছে।

পদ্মাসেতুর কোনো প্লান ছিল না। চূড়ান্ত ডিজাইন ছিল না। অর্থের সংস্থান ছিল না। কোনো দাতা সংস্থার কমিটমেন্ট ছিল না। দু’বছরে প্রস্তুতিকাজ সম্পন্ন করে ঠিকাদার নিয়োগও চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলাম। সেই ঠিকাদারই পদ্মাসেতু তৈরি করেছে। পদ্মাসেতুর কাজ যেভাবে আমি এগিয়ে নিয়েছিলাম, তাতে সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে পদ্মাসেতু চালু হতো। বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের প্রস্তুতি কাজ করতে যেখানে ১০ বছর লেগেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পদ্মাসেতুর সে পর্যায়ের কাজ আমি দু’বছরে শেষ করেছি। বিশ্বব্যাংক ও দেশীয় স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রে ২০১৩ সালে পদ্মাসেতুর চালু হওয়া বন্ধ করেছে। বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়নে এটি একটি বিরাট বাধা হিসেবে চিহ্নিত থাকবে।

পদ্মাসেতু বাংলাদেশের স্বপ্নের সেতু। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের এক প্রাণশক্তি। উন্নয়নের অন্যতম সিঁড়ি। পদ্মাসেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক, জাপানের জাইকা, এডিবি ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নের অঙ্গীকার পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয় বিশ্বব্যাংক। আমরা পদ্মাসেতু নির্মাণের প্রস্তুতি কার্যক্রম দুই বছরে শেষ করি। প্রতি ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনে, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে কারিগরি কমিটি ঠিকাদারদের প্রাকযোগ্যতা নির্বাচন (প্রি-কোয়ালিফিকেশন) নিয়োগ, কনসালট্যান্ট নিয়োগের কার্যক্রমের ধাপ অতিক্রম করেছিল। ঠিকাদারের প্রাক-যোগ্যতা বাছাইয়ের একপর্যায়ে বিশ্বব্যাংক কারিগরি কমিটিকে একটি প্রাক-যোগ্য Qualified দরদাতা China Constructioin Communication Company (CCCC)-কে বিশ্বব্যাংকের কালোতালিকাভুক্তির কারণে বাদ দিতে বলে এবং প্রি-কোয়ালিফিকেশন স্টেজে একটি Disqualified দরদাতা China Railway Construction Company (CRCC)-কে Qualify করতে বলে। কারিগরি কমিটি বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্তির কারণে প্রাক-যোগ্য Qualified দরদাতাকে বাদ দেয়। কিন্তু প্রাক-যোগ্য নির্বাচনে Disqualified দরদাতাকে Qualify করতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ, প্রাক-যোগ্য Disqualified দরদাতা প্রতিষ্ঠানটি অভিজ্ঞতার জাল সার্টিফিকেট প্রদান করেছিল। কারিগরি কমিটি বিশ্বব্যাংককে বিষয়টি জানিয়ে দেয়। ফলে এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক কারিগরি কমিটির কাছে একাধিকবার নানা কোয়ারি করে এবং প্রতিবার কারিগরি কমিটি বিশ্বব্যাংককে তাদের মতামত যুক্তিসহ প্রেরণ করে। ফলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠানটি বড়ো ধরনের ঘাপলা বের হয়ে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হলে এবং বিশ্বব্যাংক এ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে যাওয়ার আশংকায় তদবিরকৃত প্রাক-যোগ্য Disqualified দরদাতা প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রি-কোয়ালিফিকেশন প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়।

পরবর্তীকালে নানা অজুহাতে বিশ্বব্যাংক ঠিকাদার প্রি-কোয়ালিফিকেশন নির্বাচনের অনুমোদনের বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখে। এ সময় স্থানীয় পত্রিকায় আমার কতগুলো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে, অসত্য রিপোর্ট করতে থাকে। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের প্রাক-যোগ্য নির্বাচনে Disqualified দরদাতা প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রতিনিধি পত্রিকার কাটিং অন্তর্ভুক্ত করে আমার বিরুদ্ধে বেনামি দরখাস্ত বিভিন্ন জায়গায় পাঠায় এবং তাও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মূলত বিশ্বব্যাংক নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ব্যর্থ হয়ে অর্থাৎ প্রাক-যোগ্য নির্বাচনে উরংয়ঁধষরভরবফ দরদাতাকে নিয়োগ দিতে না পারার কারণে, পদ্মাসেতুতে তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ আনে, পরবর্তী সময়ে যা অসত্য প্রমাণিত হয়।

বিশ্বব্যাংক বলেছিল, আমি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর পদ থেকে সরে গেলে সেতুর কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে। আমি সরে গেলাম। তার পরও স্থগিত কার্যক্রম সে আর শুরু করেনি। এটা ছিল একটা ষড়যন্ত্র। সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর হাতকে দুর্বল করার একটি পদক্ষেপ। বিশ্বব্যাংক যখন তার সমর্থিত ঠিকাদারকে প্রি-কোয়ালিফাইড করতে ব্যর্থ হয়, তখনই পদ্মাসেতু নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এই অবৈধ কার্যক্রমকে আড়াল করার জন্য আমার বিরুদ্ধে প্রাক-যোগ্য নির্বাচনে উরংয়ঁধষরভরবফ ঠিকাদারের স্থানীয় এজেন্ট দিয়ে ভুয়া বেনামি অভিযোগপত্র প্রদান শুরু করে এবং এসব ভুয়া অভিযোগ পত্রিকায় প্রকাশে প্রভাব বিস্তার করে। অনেক নামিদামি পত্রিকাও বিশ্বব্যাংকের এ ষড়যন্ত্র বুঝে হোক, আর না বুঝে হোক, তাতে হাত মিলায় এবং এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে যেন পদ্মাসেতু নির্মাণ কার্যক্রম বিলম্বিত হয়। বিশ্বব্যাংক তার ষড়যন্ত্রকে কাজে লাগানোর জন্য পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত জনৈক বিহারিকে পদ্মাসেতু নির্মাণের কো-অর্ডিনেটর নিয়োগ করে। ফলে আমার বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, পদ্মাসেতু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কবলে পড়েছে।

কানাডার আদালত পদ্মাসেতুর অভিযোগ মামলা হয়। আদালত যে রায় দিয়েছে তাতে আমার কথাই প্রতিষ্ঠিত হয়। পদ্মাসেতুর দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে পরিকল্পিত স্ক্যান্ডাল নিয়ে বাংলাদেশের পত্রিকার কাটিং এবং কিছু টেলিফোনের কথোপকথন আদালতে জমা দেওয়া হয়েছিল। কানাডার পুলিশ দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে কোনো প্রমাণ বা কারো সম্পৃক্ততা পায়নি। ফলে বিষয়টি আদালতের কাছে একটি গালগল্প স্টোরি ছাড়া কিছুই প্রতীয়মান হয়নি। বিচারক রায়ে এসব যুক্তিতর্ক টেলিফোনিক কলকে গালগল্প বলে খারিজ করে দেন। বাংলাদেশে দুদকও পদ্মাসেতুর বিষয়টি নিয়ে নিবিড় তদন্ত করে। আমি দুদকের ডাকে দুদক অফিসে যাই এবং জিজ্ঞাসিত বিষয়ে উত্তর দেই। দুদকের তদন্তেও আমি নির্দোষ প্রমাণিত হই।

জাপানি অর্থায়নে জাপানি কনসালট্যান্ট ফিজিবিলিটি স্টাডির রিপোর্টে প্রথমে পদ্মাসেতুতে সিঙ্গেল ডেকার সেতুর প্রস্তাব করেছিল। সিঙ্গেল ডেকার মানে মাঝখানে রেল যাবে এবং দুই পাশ দিয়ে গাড়ি যাবে। সিঙ্গেল ডেকার সেতু নির্মাণে সময় বেশি লাগে এবং ব্যয়ও বেশি হয়। আমি ডিজাইন কনসালট্যান্ট মনসেল এইকমের কাছে ডাবল ডেকার সেতু নির্মাণের প্রস্তাব রাখি। আমি চায়নায় সিঙ্গেল ডেকার নির্মিত বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু ড্যানইয়াং কুনসান মহাসেতু, বেইজিংয়ের তিয়ানজিং গ্র্যান্ড ব্রিজ, উইনান উইহে গ্র্যান্ড ব্রিজ, বেইজিং গ্র্যান্ড ব্রিজ, বেইজিং তিয়ানজিন ব্রিজ, হ্যাংজো বে ব্রিজ ও রান ইয়াং ব্রিজ পরিদর্শন করেছি। হ্যাং জো বে ব্রিজ (Hangzhou Bay Bridge) কানেকটিং-নিংবো (Shanghai and Ningbo) ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুর নির্মাণ পর্যায় থেকে কয়েকবার পরিদর্শন করি। ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ সাংহাই ইস্ট সি ব্রিজ (Shanghai East Sea Bridge) কানেকটিং ডিপ সি পোর্টও আমি পরিদর্শন করেছি। হংকং-ঝুহাই-মাকাও ব্রিজ (Hongkong-Zhuhai-Macau Bridge) যা সমুদ্রপৃষ্ঠে ১৬ কিলোমিটার এবং সমুদ্র ভূ-গর্ভস্থ ৩৯ কিলোমিটার সর্বমোট ৫৫ কিলোমিটার সেতুও আমি দেখেছি।
চায়না ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ডাবল ডেকার সেতুও আমি দেখেছি। আমি চীনের বিভিন্ন প্রদেশে বেশ কিছু ডাবল ডেকার ব্রিজ পরিদর্শন করেছি এবং নির্মাণ পর্যায় থেকে অবলোকন করেছি। আমি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ডাবল ডেকার সেতু চীনের ইয়াংসিগাং (Yangsigang Yangtze), সাংহাই-এর মিনপু ব্রিজ (Minpu Bridge), জিয়াংসু প্রদেশে ওউফেনজ্যাশন ব্রিজ (Wufengshan Bridge, Jiangsu Province) এবং টেনসিংজো ব্রিজ (Tianxingzhan Yangtze River Bridge, Jiangan District, Wuhan) এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে বেনপো ব্রিজ (Banpi Bridge, Seoul, South Korea) পরিদর্শন করি। এ সকল ব্রিজ পরিদর্শন করে ডাবল ডেকার ব্রিজ সম্পর্কে আমি সম্যক ধারণা লাভ করি। ডাবল ডেকার সেতু হলো, দোতালা সেতু। উপর দিয়ে গাড়ি যাবে এবং নিচ দিয়ে রেল যাবে। এ ধরনের ব্রিজ তৈরিতে সময় কম লাগে, দ্রুত শেষ করা যায়। কারণ, সেতুর অধিকাংশ কাজ দরদাতা নিজ ফ্যাক্টরি থেকে স্টিল স্ট্রাকচার তৈরি করে এনে শুধু সেতুতে সংযোজন করে। এসব ডাবল ডেকার ব্রিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি কনসালট্যান্ট ও সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল থেকে ট্রান্সপোর্ট মিনিস্টার্স কনফারেন্সে অংশগ্রহণ শেষে আসার পথে হংকং-এ মনসেল এইকমের অফিসে সংশ্লিষ্টদের সাথে বৈঠক করি। আমার এ অভিজ্ঞতা কনসালট্যান্ট যথার্থ বলে মনে করে এবং সে অনুযায়ী ড্রয়িং ও ডিজাইন করে। পুরো বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী বরাবর উপস্থাপিত হলে তিনি তা অনুমোদন করেন। বর্তমানে পদ্মাসেতু ডাবল ডেকারে নির্মিত হয়েছে।

পদ্মাসেতুর প্রস্তুতি কাজ করতে গিয়ে আমি জাপান গৃহীত ডিজাইন দেখেছি। আমি কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোক নইÑ আমি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেনি, লেখাপড়া করেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনুসন্ধানী মন এবং জানার আগ্রহ নিয়ে আমি বিশ্বের বড় বড় সেতু এলাকা পরিদর্শন করেছি। এমনকি আমি নর্থ আমেরিকার সেনটিনিয়াল পানামা ব্রিজ সম্পর্কেও খোঁজখবর নিয়েছি। এটি প্যান-আমেরিকান হাইওয়ে ক্যারিয়ার হিসেবে প্রতিস্থাপনের জন্য নির্মিত হয়েছিল, যা ২০০৪ সালে চালু করা হয়। চায়নার থ্রি গরজেস প্রকল্প একাধিকবার পরিদর্শন করেছি। ৩০ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারে নির্মিত এ ব্রিজ আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যসহ বহু দেশের প্রকৌশলীগণ পরিদর্শন করেছেন শুনেছি, একবার বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার সম্মেলন শেষে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশসহ বিশ্বনেতাদের সঙ্গে প্রকল্পটি পরিদর্শন করেছেন। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকাকালীন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নির্মাণ এ প্রকল্পটি পরিদর্শন করেছি। আমি আগেই বলেছি, চীনের বেশ কয়েকটি সিঙ্গেল ডেকার ব্রিজ পরিদর্শন করেছি। চীনের ডাবল-ডেকার ব্রিজ, ইয়াংসিগাং ব্রিজ, মিনপু সেতু, ওউফেলজ্যাশন সেতু এবং টেনসিংজা সেতু আমি দেখেছি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ডাবল-ডেকার ব্রিজ বেনপো সেতুও আমি দেখেছি। এসব থেকে আমি অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। তার আলোকে কারিগরি কমিটিকে ডিজাইনে কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না, তা ভাবতে অনুরোধ করেছিলাম। এই ডিজাইনের বিষয়ে আমি প্রকল্প পরিচালক (পিডি) রফিক সাহেবকে নিয়ে ডিজাইন কনসালট্যান্ট মনসেল এইকম-এর সাথে বসেছিলাম। তাদের সাথে আমার ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছি। হংকং-এ গিয়ে এ বিষয়ে তাদের সাথে মিটিংও করেছি। সেতু দ্রুত বাস্তবায়নের কৌশল নিয়েও তাদের সাথে কথা বলেছি। ডাবল ডেকার ব্রিজ স্টিল স্ট্রাকচারের বিষয়ে কথা বলেছি। উহানের আদলে এ ধারণা নিলে ৩ বছরে পদ্মাসেতু করা সম্ভব তাও তাদের বলেছি। ডিজাইন প্রতিষ্ঠান মনসেল-এইকম একজন চায়নিজ বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক, যিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডিজাইনার, তাকে দিয়ে ডিজাইন তৈরি করাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তা উপস্থাপিত হয় এবং তা তিনি অনুমোদন করেন।

আমি প্রস্তাব রেখেছিলাম, স্ট্রাকচারাল ডিজাইন এমনভাবে করতে হবে, যাতে করে বড়ো ধরনের ভূমিকম্প হলেও ব্রিজের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। এক্ষেত্রে জাপানি বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিতে অনুরোধ করি। কারণ, জাপানিরা ভূমিকম্প সহনীয় ডিজাইন এক্সপার্ট। আমি তখন অভিজ্ঞতার আলোকে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে বলেছিলাম- পদ্মাসেতুর পাইলিং করতে গিয়ে যদি শক্ত মাটি পাওয়া না যায়, নরম মাটির স্তর আসে, তাহলে কনক্রিট ফাউন্ডেশন দেওয়ার বিধান রাখতে অর্থাৎ নরম মাটি এলে তা কেমিক্যাল দিয়ে কংক্রিটে রূপান্তর করা সম্ভব। চায়নার উদাহরণও আমি দেখিয়েছি। আমি এক্ষেত্রে Three Gorges Dam project on Yangtze River, Xiaolangdi Project on yellow River, Baoshan Steel Inc., Shanghai, Metro line, Shanghai, Shanghai Plaza Project, Shanghai Out – Huangpur Tunnel, Shanghai – Honk Kong New World Plaza, Xiang’an Subsea Tunnel, Xiamen Ges Wicheng Road, Wuxi, China" আমার দেখা ও জানার অভিজ্ঞতার কথা তাঁকে বলেছি। আমি আরো বলেছি, পাইলিং করতে গিয়ে মাটির গভীরে গ্যাস পাওয়া গেলেও ফাউন্ডেশন করা সম্ভব, এ বিষয়টি আমি চায়নার একটি টিভি চ্যানেলে স্ববিস্তারে দেখেছি। এ উদাহরণ চায়নায় রয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি এলে কাজ যাতে বিলম্বিত না হয়, ব্যয় না বাড়ে- এ শর্ত রাখতে আমি কারিগরি কমিটির প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে অনুরোধ করেছিলাম এবং চুক্তির আগে চায়নায় গিয়ে সরেজমিনে দেখতে বলেছিলাম। এক্ষেত্রে ঠধৎরধঃরড়হ-এর পরিবর্তে খঁসঢ়ংঁস চুক্তির ঢ়ৎড়ারংরড়হ রাখতে বলেছিলাম, যাতে পরবর্তীকালে সেতু নির্মাণের ব্যয় না বাড়ে। কিন্তু অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী আমার মতামতের গুরুত্ব বিবেচনায় নেননি।

আমার আশঙ্কা অনুযায়ী, নির্মাণ পর্যায়ে যখন দেখা গেল, মাটির তলদেশে শক্ত মাটি নে,- তরল মাটি যা পাইলিংয়ের উপযুক্ত নয়। এক্ষেত্রে কী করণীয় সে ব্যাপারে কোরিয়ান সুপারভিশন কনসালটেন্ট তখন পর্যন্ত ছিল অনভিজ্ঞ। তখন বর্তমান ঠিকাদার, যারা নির্মাণ কাজে অভিজ্ঞ, তারা কেমিক্যাল ব্যবহার করে মাটি শক্ত করে পাইলিং করার পরামর্শ দেয়। আমি শুনেছি, তারা ৬টির পরিবর্তে ৮টি পাইলের প্রস্তাব করেছিল। তাদের এ পরামর্শ আমার আগের পরামর্শের সঙ্গে ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু কোরিয়ান কনসালটেন্ট বিডারের একথা শুনেননি। কনসালটেন্ট গবেষণার নামে দুই বছর সময় ক্ষেপণ করল। শেষ পর্যন্ত MAUNSELL-AECOM এর ডিজাইনার আমাকে যে ইঙ্গিত দিয়েছিল সেই পরামর্শ অনুযায়ীই বর্তমানে স্ক্রিন গ্রাউটিং পদ্ধতিতে কেমিক্যাল ব্যবহারের পথ বেছে নিল। ৬টি পাইলের পরিবর্তে ৭টি পাইল ব্যবহার করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, একজন বিডারকে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বাদ দিয়ে পদ্মাসেতুর ঠিকাদার, আমার রেখে যাওয়া প্রি-কোয়ালিফাইড বিডারদের মধ্যে থেকে নির্বাচন করা হলো, কিন্তু সুপারভিশন কনসালটেন্ট নিয়োগে নতুনভাবে প্রি-কোয়ালিফিকেশন আহবান করা হলো। অথচ, এসএনসি-লাভালিনকে বাদ দিয়ে অন্যদের মধ্য থেকে সুপারভিশন কনসালটেন্ট নির্বাচন করা সমীচীন ছিল। নতুনভাবে প্রি-কোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহবানের ফলে কোরিয়ার মতো তুলনামূলকভাবে অনভিজ্ঞ সুপারভিশন কনসালটেন্ট নিয়োগ পেল। যদি নতুন প্রি-কোয়ালিফাইড টেন্ডার আহবান না করে পূর্বের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন প্রি-কোয়ালিফাইড বিডার মনসেল-এইকম (গধঁহংবষষ -অঊঈঙগ) নির্বাচিত হতো তাহলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। এক্ষেত্রে ঠিকাদার নিয়োগে এক নীতি এবং সুপারভিশন কনসালটেন্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্য নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে সময়ক্ষেপণ ও নির্মাণ ব্যয় দুটোই বেড়ে গেছে।

নিজের টাকায় আমরা পদ্মাসেতু নির্মাণ করছি, এটা গর্বের। তবে আমাদের যে এতো অর্থ নেইÑ তাও ঠিক। পদ্মাসেতু নির্মাণের জন্য আমাদের অনেক বিনিয়োগ রিসিডিউল করতে হয়েছে। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে গেলে আমার পরিকল্পনা ছিল ডিজাইন বিল্ট ফাইনানসিং-এ পদ্মাসেতু নির্মাণ করার। এ সম্পর্কিত সার-সংক্ষেপ প্রধানন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করি। তিনি অনুমোদন দেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেন। সে সময় পদ্মাসেতু ডিজাইন বিল্ট ফাইনানসিং করা সম্ভব হলে সরকারি অর্থের উপর চাপ পড়ত না। ডিজাইন বিল্ট ফাইনানসিংয়ে গেলে খরচ কম হতো। কারণ এক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব অর্থ বিনিয়োগ করতে হতো না। আমরা Bidders Financing ev PPP-তে পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন করতে পারতাম।

দেশের গণমাধ্যম পদ্মাসেতুর দুর্নীতির অসত্য ও ভুয়া খবরকে উপজীব্য করে আমার বিরুদ্ধে ঢালাও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বেনামি চিঠির ভিত্তিতে বারবার একই বিষয়ে প্রতিবেদন করেছে। চ্যানেলগুলোয় খবরের কাগজগুলোর রিপোর্টকে উপজীব্য করে টকশোতে বুদ্ধিজীবীরা অবিবেচকের মতো অশোভন কথা বলেছে, শোনা কথার ওপর নির্ভর করে বিবেচনাহীনের মতো অসত্য কথাকে ছড়িয়ে দিয়েছে। পত্রিকা প্রতিবেদন তৈরির সময় সত্য-মিথ্যা যাচাই করেনি। কীভাবে, সঠিক পথে পদ্মাসেতুর কাজ এগিয়েছে তা তারা জানারও চেষ্টা করেনি। এ বিষয়ে তাদের ন্যূনতম জ্ঞানও ছিল না। তবু এমনভাবে কথা বলেছে যেন তারা বিশেষজ্ঞ। আবার পত্রিকাগুলো কারিগরি কমিটির মূল্যায়নের অনিয়মের বিষয়ও কিছু বলেনি। বাতাসের ওপর ভর করে আমার বিরুদ্ধে নানা অসত্য রিপোর্টকে পুঁজি করে পদ্মাসেতু নির্মাণের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করেছে। নানা কারণে প্রভাবিত হয়ে বিশ্বব্যাংকের ষড়যন্ত্রে হাত মেলাতে গিয়ে একবারও ভাবেনি পদ্মাসেতু দেশীয় সম্পদ। এর বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হলে দেশের ক্ষতি হবে।

আমি প্রায় তিন বছর যোগাযোগমন্ত্রী ছিলাম। তিন বছর আমি প্রচুর পরিশ্রম করেছি। সরকারি প্রকল্পের জন্য প্রচুর বৈদেশিক সাহায্য মবিলাইজ করেছি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগ, সেতু বিভাগ এবং বর্তমান রেল মন্ত্রণালয়ের উন্নয়নে নানা কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছি। আমি যখন দায়িত্ব নিই, তখন সেতু বিভাগের বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল আদায় করা ছাড়া কোনো কাজ ছিল না। আমি দায়িত্বে এসে সেতু বিভাগের কার্যক্রমে গতি সঞ্চার করি।

মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মাসেতু নির্মাণ, ঢাকা-এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, ঢাকা ও চট্টগ্রামে টানেল নির্মাণ, গুলিস্তান লেচু শাহের মাজার হতে দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণ, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পয়েন্টে দ্বিতীয় পদ্মাসেতু নির্মাণসহ ১১টি প্রকল্প গ্রহণ ও কিছু কিছু প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন শুরু করি। আমি যোগাযোগমন্ত্রী থাকলে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পয়েন্টেও দ্বিতীয় পদ্মাসেতু এতদিনে বাস্তবায়িত হতো। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বিডারস ফাইনান্সিং-এ সেতু নির্মাণের সারসংক্ষেপ অনুমোদন দিয়েছিলেন। সড়ক বিভাগের অধীনে ১৬০টি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়, যার মধ্যে ৪৪টি অগ্রাধিকার প্রকল্প। অনুরূপভাবে রেলওয়ের উন্নয়নে ৪৪টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর অনেকগুলোর কাজ বাস্তবায়নাধীন ছিল।

জোর দিয়ে বলতে পারি, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে আমি তিন বছরে যে কাজ করেছি, যেসব প্রকল্প হাতে নিয়েছি, সেসব প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, অগ্রগতি হয়েছে, সে কাজ ১০০ বছরের ভেতরে পাঁচ বছর মেয়াদি কোনো সরকার উদ্যোগ নিতে পারেনি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে আমি সেসব প্রকল্প গ্রহণ করেছি, বাস্তবায়ন করেছি তা হবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য একটি মাইল ফলক এবং একটি ঐতিহাসিক দলিল।

আজকের এই শুভ দিনে, ঐতিহাসিক দিনে প্রধানমন্ত্রী, আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন। তাঁকে মোবারকবাদ জানাই। পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন হওয়ায় দলমত নির্বিশেষে সকলকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

লেখক : প্রাক্তন যোগাযোগমন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক, বিশিষ্ট শিক্ষা উদ্যোক্তা ও লেখক।



 

Show all comments
  • Abdul Kauym ১৮ জুলাই, ২০২২, ২:০৭ এএম says : 0
    Good
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammod Joynal Abedin ২৫ জুন, ২০২২, ৬:৫৫ এএম says : 0
    খুবই সুন্দর সরাসরি চোখে দেখার অনুভূতি অন্য রকম?
    Total Reply(0) Reply
  • M Nazrul Islam ২৫ জুন, ২০২২, ৬:৫৫ এএম says : 0
    · দুর্নীতি বন্ধ হলে বছরে আরো দুটি করে পর্দা সেতুর সমান উন্নয়ন কাজ করা যেতে পারে।
    Total Reply(0) Reply
  • Rumana Mahmud Chowdhury ২৫ জুন, ২০২২, ৬:৫৫ এএম says : 0
    স্বপ্নের পদ্মা সেতু দিয়ে প্রথম শরীয়তপুর যাবো ইনশাআল্লাহ
    Total Reply(0) Reply
  • Sadhek Hossan Khan ২৫ জুন, ২০২২, ৬:৫৬ এএম says : 0
    শেখ হাসিনার একক কৃতিত্বের জন্যেই আজ কোটি মানুষের স্বপ্ন পদ্মা বহুমুখী সেতু বাস্তব রুপদান সম্ভব হয়েছে। ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
    Total Reply(0) Reply
  • Mamun Abdulla ২৫ জুন, ২০২২, ৬:৫৬ এএম says : 0
    বহু বছর পর একটা জাতির স্বপ্নের উন্মোচন।ধন্যবাদ মাননীয় পিএম
    Total Reply(0) Reply
  • Eaman Rahman ২৫ জুন, ২০২২, ৬:৫৬ এএম says : 0
    গর্বের পদ্মা সেতু। গৌরবের পদ্মা সেতু। সক্ষমতার পদ্মা সেতু। দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র এর বাধা পরিয়ে আমাদের এই পদ্মা সেতু। ধন্যবাদ বদলে যাওয়া বাংলাদেশের কারিগর প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। শুভকামনা সবসময় আপনার জন্য।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পদ্মাসেতুর জানা-অজানা কথা
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ