Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গরুর ২০৫৪ খামার বন্যাকবলিত

৩১৭ কোটি ১২ লাখ ২৭ হাজার টাকার ক্ষতি কোরবানির ঈদে পশুর হাটে নেতিবাচক প্রভাবের শঙ্কা

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২২ জুন, ২০২২, ১২:০১ এএম

সামনে ঈদুল আজহা। ভারতীয় গরু আসা বন্ধ হওয়ার পর দেশি গরু কোরবানির চাহিদা মেটাচ্ছে কয়েক বছর ধরে। কিন্তু এবার বন্যায় চরম বিপর্যয়ে পড়েছে গরুর খামারিরা। বন্যায় মানুষের খাবার মিলছে না; আর গরু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন খামারিরা। যেসব গৃহস্থ দু-চারটি করে গরু প্রতিপালন করছেন কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য; তারাও গরু নিয়ে বিপাকে পড়ে গেছেন। চলমান বন্যায় দেশের ৫ বিভাগের ১৪টি জেলার ৯৮টি উপজেলার ৫৭০টি ইউনিয়নের ২ হাজার ৫৪টি গরুর খামার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে খামারিদের ক্ষতি হয়েছে ৩১৭ কোটি ১২ লাখ ২৭ হাজার ৯০০ টাকা। এছাড়া সুনাগমঞ্জের ১১টি উপজেলার ৮৮টি ইউনিয়নে ৯৮ কোটি টাকার ক্ষতি। তবে ব্যক্তিমালিকানার গরু খামারিদের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি বলে জানা গেছে।

বানের পানির তোড়ে নিঃস্ব হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। অনেকের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু নেই। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে বানভাসিদের। সব হারিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। গ্রামে গ্রামে পাকাঘর ছাড়া কাঁচা কোনো ঘরের অস্তিত্ব নেই। আধাপাকা ঘরগুলো দাঁড়িয়ে থাকলেও ঘরের বেড়া অথবা আসবাবপত্র বলতে কিছুই নেই। বানের পানিতে আসবাবপত্র, হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি এবং মাছ ধরার জাল ভেসে গেছে। তবে সবাই মানুষের খোঁজখবর নিলেও গবাদি পশুর খোঁজখবর কেউ রাখছে না। এর মধ্যে এখনো অনেক জেলার তথ্য পাওয়া যায়নি। অনেকে আবার গবাদি পশু নিয়ে অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র গেছেন। সেখানে একই জায়গায় মানুষ ও গবাদি পশু থাকছে। সে সব জায়গায় মানুষের যেমন খাবারের প্রয়োজন তেমনি পশুর জন্যও খাদ্য প্রয়োজন।

গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশের ৫টি বিভাগের সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মানিকগঞ্জ, ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলায় বন্যার পানিতে অনেক গবাদি পশু-হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগল ও ভেড়া পানিতে ভেসে গেছে। এদিকে বন্যাকবলিত এলাকায় প্রাণিসম্পদের সেবাসমূহ নিশ্চিতকরণ ও নিবিড় তদারকি জোরদারকরণের লক্ষ্যে ২টি টিম গঠন করেছে অধিদপ্তর। গত ২০২১ সালে ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি কোরবানিযোগ্য গবাদি পশুর মধ্যে সারাদেশে ৯০ লাখ ৯৩ হাজার পশু কোরবানি হয়েছে। গত বছরের মতো এবারও গবাদি পশুর পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। চলতি বছর কোরবানিযোগ্য গবাদি পশুর সংখ্যা ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার।

গত কয়েক মাস ধরে দেশের বাজারে গবাদি পশুর খাবারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় গোশতের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার বন্যার কারণে কোরবানির পশুর দাম বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে বন্যার কারণে অনেকেই কাক্সিক্ষত পশু কোরবানি দিতে পারবেন না বলে আশঙ্কা রয়েছে।

এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা জানান, এখন পর্যন্ত আমরা সারা দেশের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র হাতে পাইনি, এটি প্রাথমিক। প্রতিদিনই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। তবে আমাদের পক্ষ থেকে বানভাসি মানুষের খাবারের পাশাপাশি গবাদি পশুর খাদ্যও সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসন এবং ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের কাছে আহ্বান জানানো হয়েছে। বন্যায় দেশের ১২টি জেলার ৭৪টি উপজেলার ৩১৬টি ইউনিয়নের ১৫ হাজার ৬০টি গরুর খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে খামারিদের ক্ষতি হয়েছে ২৬১ কোটি ৮৩ লাখ ৫৪ হাজার ৪০০ টাকা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের বিষয়ে মন্ত্রণালয় এবং সরকারের শীর্ষ মহলে আলোচনা করা হচ্ছে। ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হলে তা খামারিদের জন্য সহায়ক হবে। আসন্ন কোরবানিতে পশুর সমস্যা হবে না। সেগুলো প্রস্তুত আছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৫ বিভাগের ১৪টি জেলার ৯৮টি উপজেলার ৫৭০টি ইউনিয়নের গবাদি পশুর ক্ষতি হয়েছে। তার মধ্যে সিলেট বিভাগে ১ হাজার ১০৯টি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে ১২৩ কোটি ৪৯ লাখ ৫২ হাজার টাকা। গরু ২ লাখ ২৬ হাজার ৪৭৩টি, মহিষ ২৯ হাজার ৫১০টি, ছাগল ৫৮ হাজার ৯৪৩টি, ভোড়া ২০ হাজার ৫৬৪টি, হাঁস ৩২ লাখ ৮০১টি, মুরগি ৬১ লাখ, ৩১ হাজার ৮টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রংপুর বিভাগে ৫টি জেলার ২২টি উপজেলার ৯৮টি ইউনিয়নের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২৫ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ টাকা। গবাদি পশুর মধ্যে গরু ৪৮ হাজার ৮১০টি, মহিষ ৭৬২টি, ছাগল ২৫ হাজার ২৭৭টি, ভোড়া ৫২৩০টি, হাঁস ৪৭ হাজার ৫৬৪টি, মুরগি ৯৪ হাজার ৪৮৯টি।

রাজশাহী বিভাগে ২টি জেলার ৮টি উপজেলার ৩৬টি ইউনিয়নের ১০৫টি খামার ক্ষতিগ্রস্ত। এতে ৬৩ কোটি ৭০ লাখ ৬০০ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে গরু ২৮ হাজার ১২২টি, মহিষ ১৫৩টি, ছাগল ১৪ হাজার ৩০৪টি, ভেড়া ৪ হাজার ১৯০টি, হাঁস ৮৫ হাজার ৮২৪টি এবং মুরগি ১৪ হাজার ৪৯৬টি। ময়মনসিংহ বিভাগে দুই জেলার ১৪টি উপজেলার ৮১টি ইউনিয়নের ৫৮২টি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে ১৬ কোটি ২৫ লাখ, ১৬ হাজার টাকা। গরু ১ লাখ ২৯ হাজার ৯৬৮ টি, মহিষ ৯০টি, ছাগল ৭৩ হাজার ৬৩৭টি, ভেড়া ৭৮৪৪টি, হাঁস ২ লাখ ২৫ হাজার ১২০টি, মুরগি ২ লাখ ২২ হাজার ৫৩২টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঢাকা বিভাগে ১টি জেলার ১০ উপজেলার ৪৬টি ইউনিয়নের ২৫৮টি খামার ক্ষতিগ্রস্ত। আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৮৯ কোটি ৬২ লাখ ৯৫ হাজার টাকার গবাদি পশু। এর মধ্যে গরু ২ লাখ ২৫ হাজার ৭৬০টি, মহিষ ১৫০টি, ছাগল ৬৮০টি, ভেড়া ১৪৫টি, হাঁস ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৬১টি। এছাড়াও সুনামগঞ্জের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ১১টি উপজেলার ৯৮ কোটি টাকার আনুমানিক ক্ষতি ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, বন্যায় মানুষের পাশাপাশি খামার মালিকরাও রয়েছেন বিপদের মধ্যে। শেষ খবর যাওয়া পর্যন্ত ২ হাজার খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকের গবাদি পশু চুরি হয়ে গেছে, ভেসে গেছে পানির স্রোতে, অনেক পশু মারাও গেছে। অনেকে আবার গবাদি পশু নিয়ে অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে গেছেন। সেখানে একই জায়গায় মানুষ ও গবাদি পশু থাকছে। সেসব জায়গায় মানুষের যেমন খাবারের প্রয়োজন তেমনি পশুর জন্যও খাদ্য প্রয়োজন। এক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে প্রাণি বা গবাদিপশুর খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। পানিবাহিত রোগ থেকে পশুকুল রক্ষায় প্রতিটি আশ্রয় কেন্দ্রে (যেখানে পশু রয়েছে) ভেটেনারি ডাক্তারকে দায়িত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরো বলেন, খামারিদের কথা চিন্তা করে যেসব জায়গায় আশ্রয়কেন্দ্র নেই সেসব জায়গায় গবাদি পশুর জন্য আশ্রয় কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা। এসব পশু বিক্রি বা কোরবানি হাটে তোলা পর্যন্ত ভালো রাখার ব্যবস্থা করা। ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের স্বল্প বা বিনা সুদে আর্থিক সহায়তা দিতেও সরকারের কাছে দাবি করছি।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের মতো এবারও গবাদি পশুর পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। চলতি বছর কোরবানিযোগ্য গবাদি পশুর সংখ্যা ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার। এসব গবাদি পশুর মধ্যে গরু ও মহিষের সংখ্যা ৪৬ লাখ ১১ হাজার ৩৮৩টি। গরু-মহিষের এ সংখ্যার মধ্যে হৃষ্টপুষ্ট গবাদি পশু রয়েছে ৪২ লাখ ৪০ হাজার ৪৯৩টি আর গৃহপালিত গবাদি পশুর সংখ্যা ৩ লাখ ৭০ হাজার ৮৯০। ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৭৫ লাখ ১১ হাজার ৫৯৭, যার মধ্যে হৃষ্টপুষ্ট ছাগল-ভেড়া রয়েছে ৩৩ লাখ ৪৮ হাজার ৭৪০ আর গৃহপালিত গবাদি ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৪১ লাখ ৬২ হাজার ৮৫৭। এছাড়া উট, দুম্বা ও অন্যান্য পশুর সংখ্যা ১ হাজার ৪০৯টি।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জিনাত সুলতানা বলেন, আসন্ন কোরবানির জন্য আট বিভাগের ৬ লাখ ৮১ হাজার ৫৩২টি খামারে এসব গবাদি পশু রয়েছে। এ বছর খামারিদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবাদি পশু বিক্রির জন্য উপযুক্ত। এর মধ্যে ঢাকার ৬ লাখ ৩৭ হাজার ১৯৬টি, চট্টগ্রামের ১৫ লাখ ১২ হাজার ১১৪, রাজশাহীর ২৭ লাখ ২৮ হাজার ৪৬০, খুলনার ৮ লাখ ৭৯ হাজার ২৫১, বরিশালের ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৫৪৩, সিলেটের ১ লাখ ৬৬ ৩৫৩, রংপুর থেকে ১০ লাখ ৩ হাজার ২৮১ ও ময়মনসিংহের ২ লাখ ৯ হাজার ৩৪৪টি। ২০২১ সালে ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি কোরবানিযোগ্য গবাদি পশুর মধ্যে সারাদেশে ৯০ লাখ ৯৩ হাজার পশু কোরবানি হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ