Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিনিয়োগ-বাণিজ্য বাড়াতে বাজেটে একগুচ্ছ পদক্ষেপ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১০ জুন, ২০২২, ১২:০২ এএম

বাংলাদেশের বিগত দশকের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা সামনের দিনগুলোতে অব্যাহত রাখার জন্য এবং টেকসই, সর্বজনীন ও পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্পখাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মানের উৎকর্ষ সাধনের কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গতকাল জাতীয় সংসদে ২২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় তিনি এমন মন্তব্য করেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উন্নয়ন দর্শন ছিল উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার মাধ্যমেক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত শিল্পসমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তোলা। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুসারে জিডিপিতে শিল্পখাতের অবদান ৪১ দশমিক ৮৬ শতাংশে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে শিল্প স¤প্রসারণে আমরা যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন কৌশল নির্ধারণ করেছি। বিবিএস এর হিসাব অনুযায়ী ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে জিডিপিতে শিল্পখাতের অবদান ছিল ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যা চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৩৫ দশমিক ৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, বিগত ১৩ বছর ধরে বাজেটে আমরা কৃষি এবং শ্রমঘন শিল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছি। বাংলাদেশের কৃষিখাতের উন্নয়নে ইউরিয়া সারের ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জে নির্মিত শাহজালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরিতে বাণিজ্যিকভাবে ইউরিয়া সার উৎপাদন শুরু হয়েছে। সর্বাধুনিক প্রয্ুিক্ত ও উচ্চতর ক্ষমতাসম্পন্ন, পরিবেশবান্ধব ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া ফাটিলাইজার প্রকল্প বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন আছে, যা সমাপ্ত হওয়ার পর দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা হবে ২ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। এছাড়াও সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে শক্তিসাশ্রয়ী ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি পরিবেশবান্ধব বার্ষিক ২৪ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া ফরমালডিহাইড উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

অর্থমন্ত্রী বলেন, এছাড়া শিল্পক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পুরোনো ঢাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রাসায়নিক কারখানা ও গুদামসম‚হ নিরাপদ জায়গায় দ্রæততম সময়ে স্থানান্তরের লক্ষ্যে শ্যামপুরস্থ উজালা ফ্যাক্টরি লিমিটেড প্রাঙ্গণে অস্থায়ীভিত্তিতে ‘রাসায়নিক দ্রব্য সংরক্ষণের জন্য গুদাম নিমার্ণ’ শীর্ষক প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় মোট ৫৪টি গোডাউন নির্মিত হবে। নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রæতি মোতাবেক পরিবেশ সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় বিসিক শিল্পনগরীসমূহে স্থাপিত লাল (রেড) ও কমলা (অরেঞ্জ) শিল্প কারখানাসম‚হে ইটিপি স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণ
আমাদের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে হলে প্রয়োজন অধিক হারে বিদেশি বিনিয়োগ। আর সে বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত মাত্রায় আকৃষ্ট করার অন্যতম প্রধান নিয়ামক হলো ব্যবসায়বান্ধব পরিবেশ। সরকার দেশে বিপুল বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বিনির্মাণ ও আইনি সংস্কারের মাধ্যমে বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বিনিয়োগ আকর্ষণে দেশ ও দেশের বাইরে সেমিনার ও ওয়ার্কশপ, রোড- শো, ট্রেড শো, আয়োজন ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করছে। এসব আয়োজনের মাধ্যমে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের চিহ্নিতকরণ, বিনিয়োগে তাদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা এবং বিভিন্ন সমস্যার ত্বরিত সমাধানে সরকারি পদক্ষেপসমূহ তুলে ধরা হচ্ছে। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশ ট্রেড এবং ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট সামিট অনুষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করা, রফতানি বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশের সা¤প্রতিক অর্জন বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যে এক্সপো-২০২০ দুবাই এ বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। গত ৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রী এক্সপো ভেন্যুতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত রেডিফাইনিং দ্য ফিউচার ফর ওমেন বিষয়ক হাই-লেভেল প্যানেলে প্রধান বক্তা হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। এর ফলে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বহুলাংশে উজ্জ্বল হয়েছে।

তিনি বলেন, দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের অনুমোদন প্রদান করা হয়েছে, যার মধ্যে ২৮টি বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। বিভিন্ন সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১৯৬টি প্রতিষ্ঠানকে জমি বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে, যাদের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া, বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলসম‚হে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পিপিপি কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম অধিকতর শক্তিশালী ও গতিশীল করার জন্য ‘পিপিপি আইন (সংশোধিত), ২০২২’ প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পিপিপি প্রকল্পে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বিকাশ সংক্রান্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ভবিষ্যতে বৃহৎ এবং সামাজিক অবকাঠামো প্রকল্পসম‚হ পিপিপি’র আওতায় বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পিপিপি কর্তৃপক্ষ এর আইনি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো সহজতর করা হচ্ছে।

বাণিজ্য বৃদ্ধি-বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের বহুমাত্রিকতা ও উৎকর্ষ বৃদ্ধির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। স্বাধীনতার পর প্রথম অর্থবছরে যেখানে মাত্র ২৫টি পণ্য ৬৮টি দেশে রফতানি করে ৩৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়েছিল, সেখানে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ২০৩টি দেশ ও অঞ্চলে ৭৫১টি পণ্য এবং সেবা রফতানি করে ৪৫ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। বাংলাদেশের রফতানি আয়ের সিংহভাগ তৈরি পোশাক খাত হতে অর্জিত হয়, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা মোট পণ্য রপ্তানির ৮১ দশমিক ১৬ শতাংশ।

অর্থ বিভাগ হতে এসইআইপি প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীদের দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান চলমান রয়েছে। তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে ইতোমধ্যে এ খাত সংশ্লিষ্ট ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৫৭ জনকে ঝঊওচ প্রকল্প কর্তৃক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। সুনির্দিষ্ট দক্ষতার চাহিদার সাথে সমন্বয় করে প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করায় এ প্রশিক্ষণ তৈরি পোশাক খাতের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, রফতানি বাণিজ্যে গতিশীলতা আনয়ন ও প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য স¤প্রতি যুগোপযোগী রফতানি নীতি ২০২২-২০২৪ প্রণয়ন করা হয়েছে। রফতানি নীতি (২০২১-২০২৪) অনুযায়ী রফতানি বহুমুখীকরণে সম্ভাবনাময় পণ্যসমূহকে ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত’ ও ‘বিশেষ উন্নয়নমূলক খাত’ হিসেবে চিহ্নিতকরণ, ‘বর্ষ-পণ্য’ ঘোষণা এবং এ সকল পণ্যের বাজার স¤প্রসারণেকর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বিশেষ সুবিধাদি দেয়া হচ্ছে। পণ্য বহুমুখীকরণের জন্য বিভিন্ন নীতি সহায়তার অংশ হিসাবে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জন্য ৪৩টি পণ্য ও সেবা খাতে রফতানি প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। এর বাইরেও রফতানি বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। যেমন, ২০২২ সালে ‘আইসিটি পণ্য ও সেবা’-কে ‘বর্ষপণ্য’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এক্সপোর্ট কমপিটেটিভনেস ফর জবস (ইসিফোরজে) প্রকল্পের মাধ্যমে মিরসরাইতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে ১০ একর এবং বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি, কালিয়াকৈরে প্রায় ৫ একর জমির উপর নির্মাণ করা হবে আন্তর্জাতিক মানের দুটি অত্যাধুনিক টেকনোলজি সেন্টার। আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও শিল্পোন্নয়নের জন্য একাডেমিয়ার সাথে ইন্ডাষ্ট্রির সেতুবন্ধন অত্যন্ত প্রয়োজন। এরূপ সেতুবন্ধন সৃজনশীল চিন্তাগুলোকে উদ্ভাবনে রূপান্তরের জন্য কৌশলগত দিকনির্দেশনা প্রদান করতে পারে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে এফবিসিসিআই ইনোভেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। প্রস্তাবিত ইনোভেশন সেন্টারের মূল উদ্দেশ্য হবে কানেক্টিং আইডিয়াস, যার মাধ্যমে তরুণদের সৃষ্টিশীল ধারণাগুলোকে বাস্তবে রূপদানে সহায়তা করা হবে। সরকার তরুণদের নতুন ধারণা বিকাশে সবসময় গুরুত্ব প্রদান করে আসছে এবং সে লক্ষ্যেই এফবিসিসিআই প্রস্তাবিত ইনোভেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠায় সরকার উৎসাহ ও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাজেট

১৩ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ