Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অবহেলায় মৃত্যুর মামলা

৮৬ ঘণ্টা পর নিভল বিএম ডিপোর আগুন দগ্ধ একজনের মৃত্যু, আরো দুই লাশ উদ্ধার ঘটনাস্থলে তদন্ত কমিটি সিআইডির টিম তৈরী পোশাক-মুরগির খাবার রাখার অনুমোদন নিয়ে কেমিক্যাল মজুদ

শফিউল আলম/রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ৯ জুন, ২০২২, ১২:০০ এএম

অর্ধশত মানুষের প্রাণহানি এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়ে ৮৬ ঘণ্টা পর পুরোপুরি নিভল সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীর বিএম কন্টেইনার ডিপোর আগুন। গতকাল বুধবার বেলা ১১টায় আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসার তথ্য জানান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা। এরপর ডিপোজুড়ে ধ্বংসস্তুপের ভেতরে লাশের খোঁজে তল্লাশি চালানো হয় দিনভর। ভয়াবহ আগুন ও বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত কন্টেইনার ডাম্পিং করা হচ্ছে। আগুন নেভানোর পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের নেতত্ব গঠিত তদন্ত কমিটি সদস্যরা। সেখান থেকে আলামত সংগ্রহ করেছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা।
স্মার্ট গ্রুপের সহযোগী এবং আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমানের মালিকানাধীন বিএম কন্টেইনার ডিপোতে তৈরি পোশাক, ভোগ্যপণ্য এবং পোল্ট্রিফিড বা মুরগির খাবার মজুদ ও হ্যান্ডলিংয়ের তথ্য দিয়ে পরিবেশ অধিদফতর থেকে ছাড়পত্র নেয়া হয়। অথচ সংশ্লিষ্ট কোন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েই সেখানে গড়ে তোলা হয় হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের বিপুল মজুদ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডিপোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ২৮টি কন্টেইনার রাখা হয়।

সবগুলোতেই ছিল হাইড্রোজেন পার অক্সাইড। এর মধ্যে কমপক্ষে ১৫টি কন্টেইনারে বিস্ফোরণ ঘটেছে। অনুমোদন ছাড়াই কেমিক্যালের মজুদ এবং আগুন লাগার পর সে তথ্য গোপন করার ফলে বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি হয়। অথচ ভয়াবহ এ ঘটনার পাঁচদিনের মাথায় পুলিশ ডিপো কতর্তৃক্ষের বিরুদ্ধে ‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ অভিযোগ এনে মামলা করেছে। মামলায় ডিপো কর্তৃপক্ষের আটজনকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেনÑ বিএম কন্টেইনার ডিপোর মহাব্যবস্থাপক নাজমুল আক্তার খান, উপ-মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) নুরুল আক্তার খান, ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) খালেদুর রহমান, সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্বাস উল্লাহ, জ্যেষ্ঠ নির্বাহী (প্রশাসন) নাছির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক আবদুল আজিজ, ডিপোর শেডের ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম ও সহকারী ডিপো ইনচার্জ নজরুল ইসলাম। তবে মালিকপক্ষের কাউকে এ মামলায় আসামি করা হয়নি। এ নিয়ে ডিপোর কর্মকর্তা এবং কর্মচারিদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, মালিকপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা সবকিছু করেছেন। অথচ তাদের বাদ দিয়ে কর্মকর্তাদের আসামি করা হলো।

বিএম কন্টেইনার ডিপোর চেয়ারম্যান বার্ট প্রঙ্ক। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন মোস্তাফিজুর রহমান। পরিচালক হলেন স্মার্ট জিনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমান। মুজিবুর সম্পর্কে মোস্তাফিজুর রহমানের ভাই। মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। গত সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় ঘুরেফিরে তার নাম আলোচিত হচ্ছে। মালিকপক্ষের অবহেলায় এমন বিপর্যয় ঘটেছে বলে শুরু থেকে অভিযোগ করে আসছেন ফায়ার সার্ভিসসহ অগ্নি নির্বাপণ কাজের নিয়োজিত সংস্থার কর্মকর্তারা। এরপরও মালিককে কেন আসামি করা হয়নি, সে প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক সাংবাদিকদের জানান এখন ডিপোর কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়েছে। তদন্তে মালিকসহ যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

সীতকুণ্ড থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আশরাফ সিদ্দিকী বাদী হয়ে মঙ্গলবার রাতে মামলাটি করেন। থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ জানান, আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪(ক), ৩৩৭, ৩৩৮ ও ৪২৭ ধারার অভিযোগ আনা হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, সবকটি ধারা জামিনযোগ্য। এ ধারায় সাজা দুই বছর থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর। এসব ধারার মামলায় কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। মামলা রুজুর প্রায় একদিন পার হলেও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। থানার ওসি জানান, কোন আসামি গ্রেফতার না হলেও মামলার তদন্ত শুরু হয়েছে।

গত শনিবার ডিপোর প্রবেশপথে একটি কন্টেইনার থেকে আগুনের সূত্রপাত। আগুন লাগার শুরুতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন। কিছু সময় পর জ¦লন্ত কন্টেইনারে পানি পড়তেই ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। এরপর একের পর এক বিস্ফোরণে ২৬ একর আয়তনের বিশাল ডিপো রীতিমত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। এতে নয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের ২৫ জনসহ আহত হয়েছেন চার শতাধিক। তাদের মধ্যে দুই শতাধিক এখনো চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

গতকাল চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আরো একজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত মো. মাসুদ রানা (৩৭) আরএসটি অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ি গোপীনাথপুর গ্রামে। এ নিয়ে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ৪৪ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ৫২ জন। আহতদের মধ্যে ৬৩ জনের চোখে ক্ষতি হয়েছে। তাদের মধ্যে মারাত্মক ক্ষতি হওয়া ছয়জনকে ঢাকায় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়েছে। আরো একজনকে দেশের বাইরে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়া অনেকে চোখের সমস্যায় ভুগছেন। তাদের একজন মো. সজিব (২৫) প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরলেও চোখের সমস্যা নিয়ে ফের চমেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

আগুন নিভেছে : টানা প্রায় পাঁচ দিনের চেষ্টায় ডিপোর আগুন নেভানো হয়। গতকাল বেলা ১১টায় ডিপোতে দায়িত্বরত ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ১৮ বীর ইউনিটের লেফট্যানেন্ট কর্নেল মো. আরিফুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, আগুন পুরোপুরি নিভে গেছে। ডিপোতে আর কোথাও আগুন নেই। আগুন আর জ্বলছে না। কিছু কন্টেইনার থেকে তখনো ধোঁয়া বের হতে দেখা গেলেও সক্রিয় আগুন নেই বলে জানান তিনি। স্মার্ট গ্রুপ ও নেদারল্যান্ডসের দুই কোম্পানির যৌথ বিনিয়োগে বেসরকারি এই ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোটি গড়ে তোলা হয় ২০১১ সালে। স্মার্ট গ্রুপের আরেক কোম্পানি হাটহাজারীর আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেডে উৎপাদিত হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রফতানির জন্য রাখা ছিল কন্টেইনার ডিপোতে। ওই রাসায়নিকই আগুনকে ভয়ঙ্কর রূপ দিয়েছে বলে ফায়ার সার্ভিসের ধারণা।

আলামত সংগ্রহ : ডিপোতে যান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত সরকারি তদন্ত কমিটির সদস্যরা। তারা সেখান থেকে বেশকিছু আলামত সংগ্রহ করেন। ডিপোতে কোন কোন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ছিল তা নিশ্চিত হতে এসব আলামত সংগ্রহ করা হয়। কমিটির একজন সদস্য জানান, পোলট্রি ফিড, ভোগ্যপণ্য ও তৈরি পোশাক রাখার শর্তে বিএম ডিপোকে ছাড়পত্র দিয়েছিল পরিবেশ অধিদফতর। কিন্তু আগুন লাগার পর রাসায়নিকের কারণে একের পর এক বিস্ফোরণের ফলে সেখানে বিপুল পরিমাণ দাহ্য ও বিপজ্জনক রাসায়নিক মজুদের প্রমাণ পাওয়া যায়। হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের পাশাপাশি অন্য কোন ধরনের রাসায়নিকের মজুদ ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখছে তদন্ত কমিটি। একই সময়ে সিআইডি চট্টগ্রাম জোনের বিশেষ পুলিশ সুপার শাহ নেওয়াজ খালেদের নেতৃত্বে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরাও ঘটনাস্থলে যান। তারাও সেখান থেকে বেশকিছু আলামত সংগ্রহ করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মৃত্যুর মামলা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ