দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. এই নামই একটি বিপ্লব একটি ক্লান্ত ইতিহাসের বিরল যাত্রা। জেনারেল ও ধর্মীয় শিক্ষার যুগপৎ কঠিনের বাস্তবতা তিনি নিজে। তিনি নিজে যেমন সমাজ পরিশুদ্ধির জন্য নিজের জীবনকে কুরবান করেছেন, সাথে সাথে এমন সব আলেম সৃষ্টি করলেন যাদের কাছে তিনি ‘ইসলাম ও দেশ’ এই আমানত রেখে যাওয়া নিরাপদ মনে করতেন। তিনি গড়ে তুললেন শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক ও মুফতি আমিনি রহ. এর মতো সিংহশার্দুলদের। শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. এর জীবনগল্পের পরতে পরতে বিস্ময় মহাবিস্ময়। কিভাবে অজপাড়াগাঁয়ের একটি সুবোধ ছেলে পরবর্তী যমানায় ইসলামী রেঁনেসার অগ্রদূত হলেন? কিভাবে রাজনীতি না করেও রাজনীতিবিদদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতেন? কিভাবে একজন মানুষের মাঝে একই সাথে বক্তা লেখক শিক্ষক রাজনীতিবিদ গবেষক চিন্তক গুণগুলোর সমাবেশ হয়েছিল? সেই সব ঘটনার জানার জন্য যারা উদগ্রীব হয়েছেন তারা নিচ থেকে পড়া শুরু করুন, আর বিস্ময়ে চোখ কপালে রাখেন। আর যাদের আগ্রহ নেই তারাও পড়ুন আশা করি আগ্রহ বেড়ে যাবে! ও আরেকটা কথা বলি; আমাদের বড় ছদরসাব হুজুর বলে যাকে স্মরণ করেন তিনি কিন্তু এই শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.ই।
গল্পের শুরুর গল্প: ইতিহাস তালাশ করে যতটুকু জানা যায় পূর্ব পুরুষরা আরব থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য এই দেশে আগমন করেন। হিজরি সাতশ শতাব্দিতে তারা এই দেশে আগমন করেন। বসতি গড়েন ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়ার গওহরডাঙ্গায়। তার প্রপিতামহ ইংরেজ বিরোধী বালাকোট আন্দোলনে শরিক হয়ে ‘গাজি’ উপাধিতে ভূষিত হন। আরব বংশোদ্ভুত এই পরিবারের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল ইশকে নবী। কাকতালীয় ভাবে শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. এর পিতামাতার নাম ছিল আবদুল্লাহ আমিনা। তাদের জীবনে সুন্নত ছিল সদাপালন ও আলোকোজ্জ্বল একটি বিষয়।
হকের সূর্যোদয়: ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরুর সময়টা ছিল মুসলিম জাহান তথা গোটা বিশে^র জন্য চরম বিপর্যয়ের ও বিপদের। খেলাফতের শেষ ধারাটাও আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ছে। মুসলিম সমাজে ও দেশে দেশে মানবরচিত জীবনব্যবস্থা গণতন্ত্র নামে অশারীরিক শিরক জায়গা করে নিচ্ছে। নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে চলছে মুসলিম সমাজ। এমন একটা চ্যালেঞ্জিং সময়ে মুন্সি মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ঔরসে আমিনা খাতুনের কোলজুড়ে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জের গওডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. নামে একটি ছেলে। সময়টা ছিল ১৮৯৮ সাল। কোন মাসের কত তারিখ- এর কোন ইতিহাস সংরক্ষিত পাওয়া যায়নি।
দুরন্তপনার শৈশবে পড়ন্তবেলার আয়োজন: আমরা আগেই বলেছি শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. এর জীবনটায় বিস্ময়ে ভরপুর। তিনি শৈশবে আর দশবারোটা ছেলের মতো দুরন্তপনায় লাগামহীন হয়ে উঠেননি। তাঁর মধ্যে নম্রতা, বিনয়, চিন্তাশীলতা ও লাজুকতার মতো মহৎগুণগুলো একত্রিত হয়েছিল। বেশি কথা বলতেন না। একাকী বসে কী যেন ভাবতেন। কথা বললে বয়সের তুলনায় অস্বাভাবিক মনে হতো। তিনি ছিলে একজন বাস্তবিক অর্থে সুবোধ পালক। যে বেশি দুষ্টও না আবার একেবারে হাবাগোবাও নয়। সত্যকে জানার অদম্য ইচ্ছা তাকে অন্যান্য শিশু-কিশোর থেকে স্বাতন্ত্র্যবোধ দান করছিল।
এ বি সি দিয়ে জীবন শুরু: তাদের পরিবার ছিল সর্বাধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একটি পরিবার। তাই তার শিক্ষার ভার দেওয়া হয় একজন হিন্দু পণ্ডিতের উপর। তিনি তাকে এ বি সি দিয়ে শুরু করেন। তার কাছে পড়ালেখা শেষ হলে তার পিতা তাকে টুঙ্গিপাড়া ও বরিশালের সুটিয়াকাঠিতে পড়িয়ে আনেন। তারপর তাকে ভর্তি করা হয় নওয়াপাড়া স্কুলে। এভাবে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর শেষ করেন। একদম অল্প সময়েই তিনি প্রাথমিক ধাপগুলো অতিক্রম করে একটি বিস্ময়ের জন্ম দেন। অতপর তার পিতা তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে বাঘুড়িয়া হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে থাকাকালে নিজ ক্লাস সারা স্কুলে তিনি প্রথমস্থান অধিকার করেন। তার তিনি কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় পড়ালেখা করেন। ১৯১৯ সালে পিতার অনেকে অনুরোধে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু ইচ্ছে ছিল পরীক্ষায় ফেল করবেন। তাহলে আর ভর্তি করাবে না। এই সুযোগে আরবী পড়বেন। তাই, তিন ঘণ্টার পরীক্ষা একঘণ্টায় দিয়ে বের হয়ে এলেন। কিন্তু পরবর্তীতে পাঁচ বিষয়ে লেটারসহ এক নম্বর স্থান অধিকার করেছেন।
ইলমের ঘ্রাণে মোহিত হৃদয়: শৈশব থেকেই তার ইচ্ছে আরবি পড়ার। কিন্তু পারিবারিক সিদ্ধান্তের বাইরে তিনি যাননি। তাই তিনি স্কুলে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আরবি শেখতেন। সেই সময় তিনি নিজ আগ্রহে উর্দু ও ফার্সি শেখার শুরু করেন। নওয়াবপাড়া স্কুলে পড়াকালীন সময়ে আরবীর প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েন। তিনি নিজেই বলেন নওয়াবপাড়া পড়াকালীন আমার ভিতরে কুরআন হাদিস বুঝার ইচ্ছাটা প্রবল আকার ধারণ করে। যার ফলে আমি স্কুলের পড়ালেখা বাদ দিয়ে আরবি পড়া শুরু করে। কলকাতা আলিয়ায় পড়াকালীন তিনি হযরত আবদু রউফ দানাপুরী রহ. এর সাথে সম্পর্ক করে। তিনি ‘আসসাহুল সিয়ার’ গ্রন্থের লেখক। কলকাতায় থাকাকালে একদিন তিনি হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. এর সাথে সাক্ষাত করেন। এই সাক্ষাতই তার হৃদয়ে ইলমে দীনের আলো দিনে দিনে বাড়াতে থাকে। থানবী রহ. তার জন্য দোয়া করেন। পরবর্তীতে জীবনে ফরিদপুরী রহ. নিজেই বর্ণনা করেন, ‘থানবী রহ. এর সাথে সাক্ষাত লাভ করার পর ইলম অর্জনের আগ্রহ এতোই বেড়ে যেতে যে, তা অবদমিত করা যেতো না। তাই কুরআন হাতে জঙ্গলে চলে যেতাম। (চলবে)
লেখক : শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।