Inqilab Logo

বুধবার ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১, ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

কৃষি জমি রক্ষায় সতর্ক হতে হবে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৯ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক উন্নয়নশীল দেশ। সেই সঙ্গে ঘনবসতিপূর্ণ। অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। মোট জনসংখ্যার ৮৫ ভাগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। দেশের সমস্ত উন্নয়ন তৎপরতা এ কৃষিকে ঘিরেই ধীর পায়ে এগিয়ে চলছে। কৃষি থেকেই জাতীয় আয়ের ৬০ ভাগ অর্জিত হয়। কৃষি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি। বৈদেশিক রফতানিতে কৃষিপণ্যই বিশেষ অবদান রয়েছে। কৃষি ও কৃষকের সমৃদ্ধির ওপরই দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নির্ভর করে। কৃষির অগ্রগতির সাথে মোট জনগোষ্ঠীর খাদ্য সরবরাহ, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ইত্যাদির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি আটাত্তর লাখ বসতবাড়ি রয়েছে। এসব বাড়ির মানুষের জীবিকার প্রধান অবলম্বন কৃষি। গ্রামের গৃহস্থের বাড়িগুলোতে পরিকল্পিতভাবে শাক-সবজি, ফল, ঔষধি গাছ ও মসলার চাষ করে ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূর করার পাশাপাশি অর্থ উপার্জনের উৎস হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় শাক-সবজি, বাড়ির সীমানায় ফলবৃক্ষ ও ঔষধি বৃক্ষ রোপণ করতে পারলে অব্যবহৃত জমিগুলো কাজে লাগবে। পাশাপাশি এতে পরিবারের পুষ্টির প্রাপ্যতা ও আয় বৃদ্ধি পাবে এবং পরিবেশও উন্নত হবে। স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা ব্যয় লাঘব হবে। প্রতিটি অর্জনই গ্রামীণ দারিদ্র বিমোচনের উপকরণ হিসেবে কাজে করবে।
লক্ষ্য করলেই প্রতীয়মান হবে, কত দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে কৃষিজমির পরিমাণ। অবিশ্বাস্য গতিতে কৃষিজমির ওপর তৈরি হচ্ছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট, শিল্প-কারখানা আরও কত কিছু। কিছু দিন আগেও শহরঘেঁষা আধাগ্রাম বা একেবারে গ্রামীণ ক্ষেতগুলোর চারপাশে চোখ জুড়ানো ফসল ফলত। কমবেশি সব জায়গাতেই এই ছবিটি বদলে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ অবধারিতভাবেই বিস্তার ঘটাচ্ছে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের। নিছক বসবাসের জন্যও মানুষকে আরও বেশি মাত্রায় ব্যবহার করতে হচ্ছে কৃষিজমিকেই।
অনেকেই বলতে পারেন ভালোই তো, উন্নয়ন কি খারাপ? মানুষ কি চিরদিন একই অর্থনৈতিক পরিবেশে বাস করবে? তা ছাড়া, সভ্যতার অগ্রগতির পথে এমনটাই তো অবধারিত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এভাবে কৃষিজমির দ্রুত হ্রাস ঘটলে মানুষ আগামীদিনে খাবে কী? কোথায় থাকবে তার খাদ্য নিরাপত্তা? এদিকে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘিœত হলে সামাজিক নিরাপত্তা অক্ষুণœ থাকবে কি? মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে জনসংখ্যার চাপ কিন্তু প্রবল। এমনকি তর্কের খাতিরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে সক্ষম হলেও মোট জনসমষ্টির বিপুল চাপটা কিন্তু থেকেই যাবে। সুতরাং বাড়বেই খাদ্যের চাহিদা। অন্যদিকে, বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট বলেছেন, জমির উৎপাদন শক্তি বা সঠিকভাবে ‘ইউনিট’ প্রতি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, বর্ধিত চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর নাও চলতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই জমির উৎপাদিকা শক্তি বা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। অনেক ‘ইনপুট’ দিয়ে প্রান্তিক বৃদ্ধির কিছুটা সম্ভব হলেও বড়সড় বৃদ্ধির সম্ভাবনা একেবারে নেই। উপরন্তু খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহার যেমন ‘জেনেটিক্যালি মডিফায়েড ক্রপস’ বা ‘অ্যানিম্যাল ক্লোনিং’ কোনোটাই বিতর্কের বাইরে নয়। দ্বিতীয় একটি সবুজ বিপ্লবের খুব প্রয়োজন থাকলে মাটি বা পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে তা আদৌ সম্ভব কিনা সেটা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে বিজ্ঞানী মহলে। ভাবিত আজ যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াচ ইনস্টিটিউট’-এর মতো প্রথম সারির গবেষণা সংস্থাগুলোও।
এই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কৃষিজমি সংরক্ষণের কথা আমাদের ভাবতে হবে। আগামী দিনের সম্ভাব্য চাহিদা-জোগানোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজকের ভূমির ব্যবহারকে যদি একটু একটু করে সঙ্গতিপূর্ণ করে না তোলা যায় তবে ভবিষ্যতে মানুষ না পাবে প্রয়োজনীয় খাদ্য, না-বাঁচবে পরিবেশ। তখন কোথায় থাকবে এই তথাকথিত ‘উন্নয়ন’? কারণ, কাল যদি আমাদের মনে হয় খাদ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য আরও বেশি জমিতে ফসল উৎপাদন করতে হবে তখন সেই উৎপাদনক্ষম জমি কোথা থেকে পাওয়া যাবে? সেই জমি তো হিমালয় থেকে ঝরে পড়বে না, বঙ্গোপসাগর থেকেও ভেসে উঠবে না। জমি যা রয়েছে তাকে তো প্রয়োজন অনুযায়ী রবারের মতো টেনে বাড়ানোও যাবে না। এই জায়গাতেই লুকিয়ে রয়েছে কৃষিজমি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি।
এবার প্রথমেই বোঝার চেষ্টা করা যাক, ঠিক কীভাবে কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে যে জন্য তার আশু সংরক্ষণের প্রয়োজন। প্রধানত দুভাবে কৃষিজমি নষ্ট হতে পারে। ১) নানা কারণে জমির উৎপাদিকা শক্তি কমে গিয়ে বা জমির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মাটির গুণাগুণের সার্বিক অবনমনের মাধ্যমে তা ক্রমশ ফসল উৎপাদনের পক্ষে সহায়ক না হয়ে উঠতে পারে এবং ২) বসবাস, পরিকাঠামো উন্নয়ন, শিল্পায়ন প্রভৃতি কারণে ভূমির ব্যবহার বদলে গিয়ে কৃষিজমির চরিত্রও পাল্টে যেতে পারে। প্রথম প্রকারের ক্ষেত্রে মাটির যথাযথ পরীক্ষার পর, বৈজ্ঞানিক পন্থায়, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে চাষ করা প্রয়োজন। মাটির ভৌত ও রাসায়নিক বিষয়গুলো যাতে অক্ষুণœ থাকে সে দিকেও দৃষ্টি দেওয়া দরকার। দ্বিতীয় প্রকারের ক্ষেত্রেই সমস্যাটা খুব জটিল। কারণ, এক্ষেত্রে উন্নয়নের সঙ্গে কৃষিজমি এবং এ জমি ব্যবহারের প্রত্যক্ষ সংঘাতটা অনিবার্য। যদিও অর্থনীতির প্রশ্নে, ‘কৃষি’ এবং ‘উন্নয়ন’-এর মধ্যে সে অর্থে কোনো বিরোধ নেই। কৃষি আসলে একটি বহুমুখী উন্নয়ন প্রক্রিয়া। কোথায় কী ধরনের কৃষি হবে তা নির্ভর করবে সেই অঞ্চলে সেই সময়কার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, মানুষের চাহিদা এবং পরিবেশের ওপর।
যাই হোক, তা হলে সমাধানটা কোথায়? অবশ্যই জমির প্রকৃতি এবং জমির ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে ‘ল্যান্ড ব্যাংক’ তৈরি করা এবং উন্নয়নের ‘ইস্যু’-তে তা যথাযথভাবে কাজে লাগানো। অর্থাৎ, উর্বর কৃষিজমিতে যথাসম্ভব হাত না দিয়ে বিকল্প জমিতে শিল্প এবং আনুষঙ্গিক উন্নয়নমূলক কাজ করা এবং যে জমি যে কাজের জন্য সর্বাধিক উপযুক্ত সেই জমিকে সেই কাজেই ব্যবহার করা। ‘ল্যান্ড ব্যাংক’ তৈরি-ই একমাত্র সমাধান নয়। কারণ পরিবহনসহ পরিকাঠামো উন্নয়ন ও জরুরি ক্ষেত্রগুলোতে প্রয়োজনে কৃষি জমির ব্যবহার করতেই হবে। ঠিক ততটুকুই, যতটুকু না করলে নয়। আমাদের মনে হয়, এক্ষেত্রে সমীক্ষার ভিত্তিতে একটি মডেল তৈরির কথা ভাবা যেতে পারে। যেমন ২০০১ সালে দেশে কত জনসংখ্যা ছিল এবং ২০১৬ সালে তা কত হয়েছে? বৃদ্ধির হার কত? ২০০১ সালে অকৃষি জমির পরিমাণ কত ছিল এবং ২০১৬ সালে তা কত হয়েছে? বৃদ্ধির হার কত? জনবৃদ্ধির ফলে, এই সময়কালের মধ্যে কৃষি উৎপাদনের চাহিদা কত বেড়েছে? হ্রাসমান কৃষি জমি এই বর্ধিত চাহিদার কতটুকু পূরণ করতে পারছে এবং কতদিন পারবে? কী কী পদ্ধতি নিলে ক্রমহ্রাসমান কৃষিজমি, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বর্ধিত চাহিদাকে সামাল দিয়ে কত দিন চলতে পারবে? এই  বিষয়গুলো মডেলে রাখা প্রয়োজন।
মনে রাখতে হবে, সঠিক তথ্য ও প্রবণতার ওপর ভিত্তি করে, আগামীদিনে সঠিক পদক্ষেপের দিশা পাওয়াটাই এই ধরনের সমীক্ষাভিত্তিক মডেলের প্রধান উদ্দেশ্য। সুতরাং ‘ল্যান্ড ব্যাংকের’ সঙ্গে প্রয়োজন জমি ও জমিসম্পর্কিত বিষয়গুলোকে নিয়ে একটি ‘কম্বাইন্ড ডেটা ব্যাংক’ তৈরি করা, যাতে ইউনিয়ন স্তর থেকে রাষ্ট্রীয় স্তর পর্যন্ত জনসংখ্যা, জমির ব্যবহার ও কৃষি উৎপাদন সম্পর্কিত তথ্যাবলির কালানুক্রমিক চিত্রটি সুস্পষ্ট রূপে ধরা পড়ে এবং পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণের কাজে সহজে ব্যবহার করা যায়।
তবে এগুলোর সঙ্গে আরও কয়েকটি বিষয় যুক্ত না করলে আগামীদিনে সমাধানের রাস্তায় পৌঁছানো সম্ভব নাও হতে পারে। কৃষিজমিকে উন্নয়নের কাজে কৃপণের মতো ব্যবহার করলামÑ এটাই এককথায় কৃষিজমি সংরক্ষণের মূল কথা হতে পারে না। একদিকে বর্ধিত চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষিজমিকে যেমন আরও বেশি মাত্রায় আধুনিক, বৈজ্ঞানিক কৃষিব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে, অন্যদিকে নানা কারণে অব্যবহৃত অথচ কৃষিযোগ্য জমিগুলোকে প্রত্যক্ষ কৃষি বা স্থান বিশেষে কৃষি-বনায়নের কাজে ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনে যেখানে জমির তুলনায় জনসংখ্যা বেশি, জমির ওপর জনসংখ্যার চাপ বেশি, সে ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জমি পুনরুদ্ধার করে তা কৃষি বা কৃষি সম্পর্কিত কাজে ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে সুন্দরবন সন্নিহিত অঞ্চলের অনাবাদি নোনা জমি পাহাড়ি অঞ্চলের রুক্ষ-পাথুরে জমির কথা ভাবা যেতে পারে। ইসরায়েল, জাপান প্রভূতি দেশ ভৌগোলিকভাবে প্রতিকূল জমিকে কৃষিজমিতে রূপান্তরিত করতে সমর্থ হয়েছে।
শুধু সরকারি উদ্যোগই নয়, ব্যক্তিগত স্তরেও সচেতনতা ও কিছু সময়োপযোগী পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে। ভবিষ্যতে কৃষিজমির অনিবার্য হ্রাস ও খাদ্যের জোগানে ঘাটতির কথা মাথায় রেখে, বাড়ি সংলগ্ন ছোট জমি এমনকী টবেও, যেখানে যতটুকু সম্ভব খাদ্যোৎপাদন বিশেষ করে সবজি, ফল চাষ করা যেতে পারে। যারা কৃষিজমির এই সংকট সময়ে গ্রামে উর্বর জমিতে নিজের বাড়ি তৈরি করে কৃষিজমিটা প্রকৃতপক্ষে নষ্ট করছেন, তাদের দিক থেকে এই উদ্যোগটুকু অন্তত আশা করা সমীচীন বলে মনে করি। মনে রাখতে হবে, পরিবেশ ও সমাজ সচেতনতার প্রশ্নে, এই ধরনের কোনো উদ্যোগ ক্ষুদ্র হলেও তুচ্ছ নয়।
আগামীদিনের খাদ্যে যাতে ঘাটতি দেখা না দেয় এবং মানুষ যাতে সুস্থ, সবুজ পরিবেশে বাস করতে পারে, তার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি আজ থেকেই নিতে হবে। যে কোনো মূল্যে মানুষ ও কৃষিজমির কাম্য অনুপাতকে রক্ষা করতেই হবে। বজায় রাখতে হবে সার্বিক উন্নয়নের ধারাকেও। কীভাবে দুটির মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করা যায় তার জন্য সর্বস্তরে নিরন্তর মতবিনিময় ও আন্তরিক প্রয়াস জরুরি। কারণ, আগামীদিনে বেঁচে থাকতে গেলে প্রয়োজনীয় পরিমাণ কৃষিজমি ও সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নÑ দুটোই আবশ্যক। এ ব্যাপারে সরকারকে আরও তৎপর হতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট। বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত (১ম স্বর্ণপদক)।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ