Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

রাজনীতিবিদদের কি প্রত্যাখ্যান করল আমেরিকার জনগণ?

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১৮ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ অভিবাসীর দেশ আমেরিকা। আজকের যে আমেরিকান জাতি, তা গঠিত হয়েছে মূলত বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা মানুষদের নিয়ে। সত্যিকার অর্থে যারা আদি আমেরিকান তারা হচ্ছে ‘রেড ইন্ডিয়ান’। কলম্বাস যখন আমেরিকা নামক ভূভাগটি আবিষ্কার করেন, তখন তিনি এই রেড ইন্ডিয়ানদের সন্ধান পেয়েছিলেন। আমেরিকায় এখন এই আদি বাসিন্দা নেই বললেই চলে। কলম্বাস আমেরিকা নামক ভূভাগ আবিষ্কার করেছিলেন ঠিকই, তবে মানুষের বাসযোগ্য করে দিয়ে যেতে পারেননি। এটি বিরানই ছিল। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে আজকের যে আমেরিকান জাতি, তারা কোত্থেকে এবং কীভাবে এলো? জবাবটি খুবই সহজ। তারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে এখানে বসতি স্থাপন করেছে। বলা হয়, ইউরোপের সভ্য দেশগুলোতে যারা ভয়ঙ্কর অপরাধী এবং খুন, রাহাজানিসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল, শাস্তিস্বরূপ তাদেরকে আমেরিকার বিরানভূমিতে নির্বাসনে পাঠানো হতো। অর্থাৎ যারা ‘আউট ল’ তাদেরকে ‘বনবাসে’ দেয়া হতো। এ কারণে আমেরিকাকে একসময় বলা হতো, ‘আউট ল’দের দেশ। এই ‘আউট ল’রা এবং পরবর্তীকালের অভিবাসীরা যুগের পর যুগ ধরে আমেরিকাকে গড়ে তুলেছে। আমেরিকা এখন বিশ্বের সুসভ্য এবং উন্নত দেশগুলোর একটি। ডোনাল্ড ট্রাম্প যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেন তার জ্ঞাতি-গোষ্ঠীও কিন্তু ইউরোপ থেকে মাইগ্র্যান্ট হয়ে আমেরিকায় এসেছিলেন। তার দাদা ফ্রেডেরিক ট্রাম্প ছিলেন জার্মান। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়ে আসেন ১৮৮৫ সালে। তার মা ছিলেন স্কটিশ দ্বীপ লিউফিসের টং গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৩০ সালে তিনি আমেরিকায় আসেন এবং ডোনাল্ডের বাবা ফ্রেড ট্রাম্পকে বিয়ে করেন। ট্রাম্প নিজেও স্বীকার করেছেন তার পূর্ব-পুরুষরা ছিলেন জার্মান বংশোদ্ভূত। কেবল ট্রাম্প জন্মসূত্রে আমেরিকান। এই ট্রাম্পই এবারের নির্বাচনে অভিবাসীদের ওপর রুষ্ট হয়ে তাদের বের করে দেয়ার ঘোষণা দিয়ে সত্যিকার আমেরিকান নাগরিকদের নিয়ে একটি নতুন আমেরিকা গড়ার অঙ্গীকার করেন। অর্থাৎ আমেরিকান জাতি যে তার মতোই অভিবাসীদের নিয়ে গড়ে উঠেছে, এ বিষয়টি তিনি আমলে নেননি। এ অস্বীকার যে নিজেকেও অস্বীকার করা, এটা তিনি উপেক্ষা করে গেছেন। যে শ্বেতাঙ্গদের পুঁজি করে তার বিজয় নিশ্চিত করেছেন, তাদের পূর্ব-পুরুষরাও যে অভিবাসী হয়েই আমেরিকায় এসেছিলেন, তা বলেননি। আমেরিকান জাতির বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, বিশ্বের নানা জাতি, ধর্ম, বর্ণের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা। এখানে কে কাকে বিতাড়ন করবে? কেউ হয়তো শতবর্ষ ধরে বংশানুক্রমে নাগরিক আর কেউ হয়তো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রদেয় আজকের নাগরিক। আজ হোক বা শতবর্ষ আগে হোক, নাগরিক তো নাগরিকই। ট্রাম্প যে এটা বোঝেননি, তা মনে করার কারণ নেই। তিনি সুচতুরভাবে এই সরল বিষয়টিকে পুঁজি করেছেন। অনেকটা জুয়া খেলার মতো। যদি লেগে যায়-এর মতো। লেগে গেলে কোটিপতি। ট্রাম্পের লাক ভালো। তিনি জুয়ায় জিতেছেন। আমেরিকার মতো গণতান্ত্রিক দেশে প্রথমবারের মতো অরাজনৈতিক ও অনভিজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
দুই.
ট্রাম্পের বিজয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা আমেরিকানদের অজ্ঞতা, নাকি আউট ল’দের রক্তের ধারায় একজন উগ্র ব্যক্তিকে বেছে নেয়া, তা এখনই বলা মুশকিল। এর কারণ হচ্ছে, যে আমেরিকানরা নিজেদের সবচেয়ে সভ্য এবং উন্নত বলে দাবি করে, তারা কীভাবে এমন একজন উগ্রবাদী ব্যক্তিকে নির্বাচন করতে পারে, তা বিশ্লেষণযোগ্য। বলা হয়ে থাকে, আমেরিকানরা সবসময় নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে। নিজের অধিকারের চুল পরিমাণ বিচ্যুতি ঘটলে তা সহ্য করে না। নিজে সুখে থাকলে অন্য কেউ মরল না বাঁচলÑ এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা সুখে এতটাই নিমগ্ন যে বিশ্বের খবর রাখা দূরে থাক, নিজের দেশেরই খবর রাখে না। এর কারণ রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা থাকেন এবং নাগরিকরা যাদের নির্বাচিত করেন, তারা এই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অটুট রাখতে কোনো ধরনের ত্রুটি করেন না। অন্যকে মেরে-কেটে হলেও নিজের দেশের নাগরিকদের নিরাপদ ও সুখে রাখেন। রাষ্ট্র পরিচালকরা নাগরিকদের গণতন্ত্রের এমনই স্বাদ দিয়েছেন যে, তারা এই স্বাদ উপভোগ করতে করতেই দিন পার করেন। অর্থাৎ গণতন্ত্র আমেরিকার জনগণকে অনেকটা অজ্ঞতার মধ্যেই রেখে দিয়েছে। এ কারণে বিশ্বের কোথায় কী হচ্ছে, তার খবর রাখে না। তাদের শাসকরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হামলা চালিয়ে তামা বানিয়ে কোটি কোটি মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলেও এ নিয়ে তারা টুঁ শব্দ করে না। এটা যে তাদের ঐতিহ্যগত ‘আউট ল’ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি তাদের দেশ কোথায় কোন দেশে হামলা চালাচ্ছে, তা জানে কিনা, এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তারা কেবল নিজের মানবিকতার কথাই বোঝে, অন্যেরটা বুঝতে চায় না। সুখ যে চিন্তার প্রসারকে রুদ্ধ এবং অজ্ঞতার দিকে ঠেলে দেয়, আমেরিকানদের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। আমেরিকার নির্বাচনের পর দিন সেখানের মেরিল্যান্ডে বসবাসরত আমার এক আত্মীয়র সাথে কথা হয়। ফোন দিয়েই বললেন, বলেছিলাম না, ট্রাম্প জিতবে! নির্বাচনের আগের দিন তার সাথে একপ্রকার তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল। দৃঢ়চিত্তে বলেছিলাম, হিলারিই জিতবে। নির্বাচনের পর যখন তিনি ফোন দিয়ে বললেন, কী বলেছিলাম না! পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে জিজ্ঞেস করলাম, কারণটা কি? জবাবে বললেন, মাল্টি ডাইভারসিটিবিরোধী ট্রাম্পের বক্তব্য বেশ কাজে দিয়েছে। তিনি তার ভোটারদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, অভিবাসীরা তাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমেরিকানদের দেশে আর আমেরিকান থাকবে না। বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গদের মাঝে তার বক্তব্য ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। এটা অনেকটা ঘুম থেকে তাদের জাগিয়ে দেয়ার মতো। তিনি বলেন, আমেরিকার মানুষ নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে। বাইরে কী ঘটছে না ঘটছে এ নিয়ে তারা ভাবে না। এমনকি তাদের ধর্মের বাইরে যে আরও ধর্ম রয়েছে, এ বিষয়টিও তাদের অনেকে জানে না। আমি একটি সুপার শপে কাজ করি। অনেক কাস্টমার জিজ্ঞেস করেন, তোমার ধর্ম কি? যখন বলি আমার ধর্ম ইসলাম, তখন তারা বিস্মিত হয়। জিজ্ঞেস করে, এটা আবার কী ধর্ম! আচ্ছা, আমাকে তোমার ধর্ম সম্পর্কে একদিন বুঝিয়ে দিও তো! তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি তারা তিরস্কার করে বলে নাকি সত্যি সত্যি না জানা থেকে বলে? বললেন, সত্যি সত্যি না জানা থেকে বলে। এবার বুঝুন, ওদের সাধারণ মানুষের জ্ঞানের বহর কতটুকু! শুধু তাই নয়, বিশ্বের অনেক খবরই ওরা রাখে না। জানতেও চায় না। আমাদের দেশের মানুষের মতো এত রাজনীতিসচেতন নয় যে সব খোঁজখবর রাখবে। কথা ঘুরিয়ে বললেন, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অন্যতম স্ক্যান্ডাল ছিল নারী কেলেঙ্কারি। এসব নারী কেলেঙ্কারি-টেলেঙ্কারি আমেরিকানদের কাছে কিছু না। এতে তারা কিছু মনে করে না। এটা তাদের কাছে ডাল-ভাতের মতো এবং স্বাভাবিক ঘটনা। মহিলাদের বিপুল ভোট পাওয়া থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তবে ট্রাম্প জিতে যাওয়ায় আমাদের মতো অভিবাসীদের একটু সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে ওবামা যে স্বাস্থ্যবীমা চালু করেছেন, তা বন্ধ করে দিলে বিপদে পড়ব। আমরা ৩০-৩৫ ডলারে স্বাস্থ্য বীমা করতে পারতাম। এটা এখন অনেক বাড়িয়ে দেয়া হবে। আর ট্রাম্প যে ট্যাক্স বৃদ্ধির কথা বলেছেন, তাতেও চরম বিপাকে পড়ব। আমেরিকার অদ্ভুত নিয়ম হচ্ছে, মাসে যাদের এক লাখ ডলারের উপরে ইনকাম, তাদের ট্যাক্স দিতে হয় না। এক লাখ ডলারের নিচের ইনকামওয়ালাদেরই ট্যাক্স দিতে হয়। তাও শতকরা ৫৪ ভাগ। ট্রাম্প এই ট্যাক্স বাড়ালে বিপদে পড়ব। তার বিরুদ্ধে যে আয়কর ফাঁকির অভিযোগ তোলা হয়েছিল, তা ধোপে টিকেনি-এই অদ্ভুত নিয়মের কারণে। অর্থাৎ কোটিপতি ব্যবসায়ীদের কোনো ট্যাক্স দিতে হয় না। তারাই আমেরিকার অর্থনীতি থেকে শুরু করে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে।
তিন.
ট্রাম্পের বিজয়ের অন্যতম কারণ হচ্ছে, তার অদ্ভুত ধরনের কথাবার্তা। আমেরিকার জনগণ প্রায় আড়াইশ বছর ধরে অনবরত বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও গণতন্ত্রের কথা শুনে আসছে। তারা নিশ্চিত নির্বাচনে যারাই প্রার্থী হন এবং ক্ষমতায় যান না কেন, তাদের সুখ ও গণতন্ত্রের কোনো ব্যত্যয় ঘটাবে না। তাদের নাগরিক ও মৌলিক অধিকারে তিল পরিমাণ ঘাটতি দেখা দেবে না। প্রার্থীদেরও প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলার তেমন কিছু থাকে না। প্রথাগত এই নিয়মের বাইরে প্রথমবারের মতো যখন কোনো প্রার্থীর মুখে কিছু বিচিত্র কথা আমেরিকানরা শুনল, তখন কথাগুলো তাদের কাছে নতুন মনে হয়েছে। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মতোই বিস্ময়কর লেগেছে। অনেকটা ফ্যান্টাসির মতো। পাগলাটে ধরনের। আমেরিকানদের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে, খুব সামান্য বিষয় নিয়ে মজা পেতে পছন্দ করে। অল্পতেই হেসে কুটিকুটি হয়। ট্রাম্পের কথাগুলোও তাদের কাছে এমন মনে হয়েছে। প্রচলিত গৎবাঁধা নির্বাচনী বক্তব্যের বাইরে ট্রাম্পের আগ্রাসী, অশ্লীল ও অশালীন কথাবার্তা তাদের কাজে মজার মনে হয়েছে। মনে করেছে, এ এক নতুন ব্যক্তি এবং নতুন কথার জনক। তাই একেই আমাদের প্রেসিডেন্ট করতে হবে। ভোটারদের এই ফ্যান্টাসি মনোভাব যে ট্রাম্পের বিজয়ের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে, তা এখন অনেকটাই স্পষ্ট। যারা ফ্যান্টাসিতে ভোগেনি এবং সচেতন, তারাই নির্বাচনের পর শত বছরের ঐতিহ্য ভেঙে ট্রাম্পের বিরোধিতা করে আন্দোলনে নেমেছে। এমনকি ট্রাম্পের পক্ষের কোনো গোষ্ঠীও কাউন্টার পার্ট হিসেবে ট্রাম্পের পক্ষে বিজয় মিছিল নিয়ে মাঠে নামেনি। হিলারি ও ওবামা যতই বোঝান না কেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পকে দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে, তাতেও বিরোধিতাকারীরা শান্ত হচ্ছে না। একটা সময় হয়তো এই প্রতিবাদ থেমে যাবে, তবে নির্বাচনের পরপরই আমেরিকার নির্বাচিত কোনো প্রেসিডেন্টের বিরোধিতা করার এই আন্দোলন ইতিহাস হয়ে থাকবে। আমেরিকার গণতন্ত্রের গায়ে কলঙ্কের ছাপ হয়ে থাকবে। ট্রাম্প শপথ নেয়ার পর কি করবেন, তা এখনই স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। নির্বাচনী সমাবেশে যেসব বিতর্কিত কথা বলেছেন এবং তার কিঞ্চিতও বাস্তবায়ন করেন, তবে আগামী বিশ্ব যদি একটি তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ পর্যন্ত যে দুটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, সেগুলোর মূল কারণ যদি খুঁজতে যাওয়া হয়, তবে তা এত তুচ্ছ মনে হবে যে, প্রশ্ন উঠতে পারে, এ নিয়েও বিশ্বযুদ্ধ লাগতে পারে? এবার তো তার চেয়ে বড় কারণ হয়ে উঠেছে, ট্রাম্পের মতো একজন উগ্রবাদী ও আগ্রাসী মনোভাবের মানুষের পরাশক্তি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। আমেরিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার ফ্যান্টাসির কারণেই হোক বা মজা করেই হোক, যাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করল, তারা কতটা সঠিক বা বেঠিক কাজ করেছে, তা বুঝতে হয়তো খুব বেশি দিন লাগবে না। তবে কিছু আলামত ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। অনেকে ট্রাম্পকে বিশ্বের জন্য হুমকি বলে প্রেডিক্ট করেছেন। নির্বাচনের ফলাফলের দিন যখন ট্রাম্পের বিজয় সুনিশ্চিত হয়ে উঠছিল, তখন আমেরিকার সচেতন কৃষ্ণাঙ্গদের অনেকেই বলেছেন, আমেরিকায় একজন ‘নব্য হিটলার’-এর আগমন ঘটছে। এ কথা আমার আত্মীয় জানান। ট্রাম্পের বিজয়ের ক্ষেত্রে তিনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তার এ কথাটি একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তিনি তার আশপাশের আমেরিকান বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জেনেছেন, রাজনীতিবিদদের ওপর ‘ফেডআপ’ হয়ে তারা ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে পেয়ে তারা তাকে ‘রিলিফ’ বা স্বস্তিদায়ক হিসেবে নিয়েছেন। তিনি বলেন, আমেরিকার জনগণের মধ্যে যদি রাজনীতিবিদদের প্রতি এই বিতৃষ্ণা জন্মে, তবে তা পুরো পৃথিবীর জন্যই শঙ্কার বিষয়। আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে তো এ প্রবণতা আগে থেকেই রয়েছে। আমরা প্রথাগত রাজনীতি ও রাজনীতিবিদ থেকে বের হওয়ার জন্য ওয়ান-ইলেভেনের মতো ঘটনা ঘটতে দেখেছি। সামরিক শাসনও দেখেছি। এসব শাসন ব্যবস্থা যে একেবারে জনগণের সমর্থন পায়নি, তা নয়। পেয়েছে বলেই তারা বছরের পর বছর দেশ শাসন করেছেন। এসব ঘটনা ঘটার পেছনে তো রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতাই দায়ী ছিল। তাদের ভুল রাজনীতি ও কর্মকা- এসব ঘটনার উদ্ভব ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। আমেরিকার জনগণের মধ্যে যদি রাজনীতিবিদদের প্রতি এই ভীতশ্রদ্ধ মনোভাব কাজ করে, তবে তা গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য খুবই বিপদের কথা। এ থেকে রাজনীতিবিদের শিক্ষা নেয়ার বিষয় রয়েছে। একঘেয়েমি এবং একই ধারার প্রথাগত রাজনীতি যে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না, ভুল করে হলেও আমেরিকার ভোটাররা এবারের নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমে তা বুঝিয়ে দিয়েছে। তা না হলে এমন ‘আধা পাগলা’ একটি লোক বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারতেন না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমেরিকার এবারের নির্বাচনের পরিবর্তন থেকে শেখার অনেক কিছুই রয়েছে। কারণ শেষ পর্যন্ত রাজনীতিবিদদেরই দেশ পরিচালনা ও গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব নিতে হবে।
চার.
আমেরিকার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার যে ভিত্তি, তা অত্যন্ত দৃঢ় এবং অলঙ্ঘনীয় রূপ লাভ করেছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির এই ছাঁচে যারাই পড়েছে, তাদেরকে এর নীতি ও আদর্শকে ধারণ করেই এগিয়ে যেতে হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প অরাজনৈতিক ও যতই আগ্রাসী এবং রক্ষণশীল হোন না কেন, আমেরিকার গণতান্ত্রিক রীতিনীতির ছাঁচের বাইরে গিয়ে তার পক্ষে কাজ করা খুব কঠিন। তবে নির্বাচনে যেসব নীতির কথা বলেছেন, পুরোপুরি না হলেও তার কিছুটা তিনি নিশ্চয়ই বাস্তবায়ন করবেন। তা করতে হবে আমেরিকার গণতান্ত্রিক রীতিনীতির মধ্যে থেকেই। বারাক ওবামাও নির্বাচনী প্রচার অভিযানে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বিশেষ করে ইরাক, আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার এবং গুয়ানতানামো কারাগার বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তার কোনোটাই তিনি করতে পারেননি। এর কারণ তিনি আমেরিকার মূল পলিসির বাইরে যেতে পারেননি। ট্রাম্পের ক্ষেত্রেও যে এর খুব একটা ব্যত্যয় ঘটবে না, তা এক প্রকার নিশ্চিত। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি যেহেতু এখনও দৃঢ় ভিত্তি লাভ করেনি এবং আমরা যদি সত্যি সত্যি গণতান্ত্রিক হতে চাই, তবে এখানে ব্যাপক পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের রাজনীতিবিদরা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি দ্বারা পরিচালিত হয় না, তারা গণতন্ত্রকে নিজেদের মতো করে পরিচালনা করে। এর ফলে সিংহভাগ রাজনীতিবিদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা বরাবরই রয়ে গেছে। তারা রাজনীতিবিদদের কথাকে মুখের কথা হিসেবে বিবেচনা করে। বিশ্বাস করতে চায় না। এর কারণ হচ্ছে তারা বলে একরকম, করে আরেক রকম। গণতান্ত্রিক অধিকারকে সঙ্কুচিত করে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেয়। প্রায়োগিক গণতন্ত্রের পরিবর্তে মৌখিক গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে যে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে, এসব বিশ্লেষণে ট্রাম্পের বিজয়ের ক্ষেত্রে যে রাজনীতিবিদদের প্রতি আমেরিকার জনগণের এক ধরনের অনীহা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তা খুব কমই আলোচিত হয়েছে। অথচ এ দিকটি উপেক্ষা করার বিষয় নয়। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আমেরিকা জুড়ে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে ট্রাম্পের ভোটাররা ভুল করেছেন এবং পাগলামি করে তাকে নির্বাচিত করেছেন। বিষয়টি তেমন নয়। এটা যে রাজনীতিবিদদের মারাত্মক ভুলের ফসল, তা যতদিন যাবে, ততই পরিষ্কার হয়ে উঠবে।  
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ