Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ

বছরে ৩২শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কোচিং সেন্টার অনুসন্ধানের নামে হয়রানি-দুদক কর্মকর্তাদের পণ্ডশ্রম

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ১২ মে, ২০২২, ১২:০৩ এএম

বছরে ৩২শ’কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ১০৯ কোচিং সেন্টার। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে এসব ‘কোচিং’। বিদ্যমান বিধি-বিধানকে তোয়াক্কা না করে অনেকটা প্রশাসনের নাকের ডগায়ই কার্যক্রম চালাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। চটকদার বিজ্ঞাপনে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে শুধু বিক্রিই নয়-একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভুয়া পরীক্ষার্থী সরবরাহসহ শিক্ষাকেন্দ্রীক নানা অপরাধমূলক তৎপরতাও চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। বিপরীতে প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক, শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টরা গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। এমন সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ৫ বছর আগে কোচিং সেন্টারগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ঢাক-ঢোল পেটানো সেই অনুসন্ধান নিয়ে একজন পরিচালকসহ অন্তত ২০ জন দুদক কর্মকর্তাকে ব্যতিব্যস্ত রাখা হয় কয়েক বছর। এ সময়ের মধ্যে ঢাকার অন্তত ৩০টি কোচিং সেন্টারের রেকর্ডপত্র হস্তগত করে সংস্থাটি। সংশ্লিষ্ট অন্তত: ২শ’ ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের তৎকালীন পরিচালক নাসিম আনোয়ারের তত্ত্বাবধানে পৃথক ৩টি টিম এ অনুসন্ধান চালায়।

তৎকালীন সহকারী পরিচালক (বর্তমান উপ-পরিচালক) মোহাম্মদ ওয়াদুদ, উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলাম এবং উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম এসব টিমের নেতৃত্ব দেন। সহকারী পরিচালক মো. ফজলুল বারী, উপ-সহকারী পরিচালক মেফতাহুল জান্নাত, রাফী মো. নাজমুস সা’দাত, আতাউর রহমান সরকার, মো. রেজাউল করিম, আ ক ম শাহ আলম, খন্দকার নিলুফা জাহান, তৎকালীন সহকারী পরিচালক নূর ই আলম, উপ-সহকারী পরিচালক একরামুর রেজা এবং মানসী বিশ^াস এ টিমে যুক্ত ছিলেন। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে টিমগুলো জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করেছিলেন বলে জানা যায়। তৎকালীন কমিশনের চাপে এই অনুসন্ধান নিয়ে কর্মকর্তারা ছিলেন গলদঘর্ম। কিন্তু এই অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।

দুদক সূত্র জানায়, মালিবাগ চৌধুরি পাড়া নিবাসী জনৈক আবদুর রহমান বিশ^াস ২০১৭ সালের নভেম্বরে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগটি আমলে নিয়ে কমিশন অনুসন্ধানের জন্য সংস্থার ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে পাঠায়। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, সারাদেশে অবৈধ কোচিং বাণিজ্য এখন তুঙ্গে। বছরে কমপক্ষে ৩২শ’ কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য চলছে। শিক্ষার জন্য বছরে এ অতিরিক্ত অর্থ গুণতে হচ্ছে অভিভাবকদের। শুধু রাজধানী নয়-প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কোচিং সেন্টারগুলো শাখা-প্রশাখা খুলে বসেছে। এসব সেন্টারে পাঠদান করছেন প্রশিক্ষণবিহীন ও মানহীন শিক্ষকরা। কোচিং বাণিজ্য আইনত: নিষিদ্ধ হলেও কার্যত: প্রকাশ্যেই চলে এগুলোর তৎপরতা। এ জন্য তারা কোম্পানি আইনে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে নিবন্ধন নেয় কোচিং সেন্টারের মালিকরা। খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও বাসাবাড়িতে সাইনবোর্ডবিহীন কোচিং ব্যবসা খুলে। ব্যাচে ব্যাচে শিক্ষার্থীরা সেখানে পড়ছে। এসব কোচিং সেন্টারে ছাত্রীদের প্রতি যৌনহয়রানির মতো ঘটনাও ঘটছে। একই সঙ্গে বিশ^বিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষার্থী সরবরাহ এবং মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে অসদুপায় অবলম্বনে সহযোগিতার অভিযোগ ছিলো কোচিং সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে। মেডিক্যাল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেশের বহু জায়গায় ব্যবসা পেতে বসেছে চটকদার নামের কোচিং সেন্টার। ‘দ্য রিকগনাইজ নন-গভর্নমেন্ট সেকেন্ডারি স্কুল টিচার্স টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন্স-১৯৭৯’ আইনকে বুড়োআঙ্গুল দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে বেআইনি কোচিং বাণিজ্য। প্রতিপালন করছে না হাইকোর্টের নির্দেশনাও। একাডেমিক, বিশ^বিদ্যালয় ভর্তি, মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, ক্যাডেট কলেজে ভর্তি, বিসিএস, আর্মি-নেভি বিমানবাহিনীতে চাকরি কোচিংসহ বিভিন্ন নামে চলে প্রতিষ্ঠানগুলো।

দুদক টিমগুলো অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, শুধু বিশ^বিদ্যালয়ের কোচিং বাণিজ্য করছে ৩৩টি কোচিং সেন্টার। এর মধ্যে রয়েছে, ইউসিসি, ইউনিএইড (কিরণ, কবির, সুমন), ইউনিএইড (মনির, মল্লিক, জহির), ফোকাস, সানরাইজ, গার্ডিয়ান, ডিভাইন, এনইডিসিসি (জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়), সাইফুর’স, ইপিপি (শুধু ক-ইউনিট), ডিইউসিসি, ডি-হক স্যার, লীডস, হোপ, আইকন প্লাস, ভয়েজ, মেরিন, আইকন, কোয়ান্টা, দুর্বার, প্যারাগন, অ্যাডমিশন এইড, প্রাইমেট, প্লাজমা, এইউএপি, সংশপ্তক, এফ্লিক্স, এডমিশন প্লাস, এডমিয়ার, ইউএসি, ইউরেনাস, পিএসি এবং ইঞ্জিনিয়ার্স।

মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কোচিং রয়েছে ১৪টি। এগুলো হচ্ছে, উদ্ভাস কোচিং, রেটিনা, সানরাইজ, পিএসি, কর্ণিয়া, ডিএমসি, মেডিকো, দি রয়্যাল, গ্রহণী মিশন এইড, থ্রি-ডক্টর্স, ফেইম, প্রাইমেট, প্লাজমা, এভিস এবং মেডিকেয়ার। প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের কোচিং সেন্টার রয়েছে ৫টি। এগুলো হচ্ছে, উদ্ভাস, সানরাইজ, পিএসি, ওমেকা এবং মেরিন। এছাড়া ১৮টি একাডেমিক কোচিং সেন্টারের মালিক-কর্মকর্তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, সানরাইজ, ডিভাইন, উদ্ভাস, ম্যাবস, অপরাজিতা, আইডিয়াল একাডেমি, রিয়াল, সেন্ট তেরেসা, ফেইম, মবিডিক, ক্রিয়েটিভ, উদ্দীপন, ই-হক, বিইউপি, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড, দূরন্ত এবং অভিযাত্রিক।

ইংরেজি ও বিভিন্ন ভাষা শেখার কোচিং সেন্টার রয়েছে ১৯টি। এগুলো হচ্ছে, সাইফুর’স, এফএম মেথড, ইংলিশ ওয়ার্ড, ব্রিজ কাউন্সিল, সুগন্ধা, হোপ, টার্গেট, নজরুল, ওয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, হিলস, এজিসিসি, ওরি, গ্লোবাল, লীডার, ইংলিশ সেন্টার, এলফিক্স, বিজয়, সিডি মিডিয়া এবং লিবার্টি ইংলিশ। বিসিএস ও অন্যান্য চাকরির কোচিং করাচ্ছে ১৪টি কোচিং সেন্টার। এগুলো হচ্ছে, কনফিডেন্স, বীকন, ওরাকল, বিসিএস আপগ্রেড, ওয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, ইউনিটি, গ্লোবাল প্রফেশনাল একাডেমি এবং ডিফেন্স গাইড। মেরিন টেক্সটাইল ও ক্যাডেট কোচিংয়ের জন্য রয়েছে ৬ প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে ই.ম্যাক, ভয়েজ, মিরপুর ক্যাডেট কোচিং (ফার্মগেট শাখা), মেরিন গাইড, অ্যাডমিয়ার এবং বর্গ।

অভিযোগের এসব তথ্য আমলে নিয়ে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর অনুসন্ধান অনুমোদন করে ইকবাল মাহমুদ নেতৃত্বাধীন কমিশন। একইবছর ২৯ নভেম্বর দুদকের দক্ষ ও চৌকস ১৩ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় তিনটি টিম। টিমগুলো ২৬ ডিসেম্বর কোচিং সেন্টারগুলোর ৯ ধরণের রেকর্ডপত্র চেয়ে পৃথক চিঠি দেয়। চিঠিতে কোচিং সেন্টারের কোম্পানি সংক্রান্ত মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেলস, সার্টিফিকেট অব ইন করপোরেশন, কর্মরত শিক্ষকদের ঠিকানাসহ শাখা ভিত্তিক নামের তালিকা, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি প্রদান সংক্রান্ত রেজিস্ট্রার, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাচ, মাস ও বছর ভিত্তিক সংখ্যা এবং তাদের কাছ থেকে গৃহিত কোচিং ফি’র মাস ভিত্তিক বিবরণ, কোচিং সেন্টারের মালিক/পরিচালকদের নামীয় ব্যাংক হিসাব বিবরণী, কোচিং সেন্টারের আয়কর নথির রিটার্ন ও ভ্যাট প্রদান সংক্রান্ত কাগজপত্র, মালিক-পরিচালকদের ব্যক্তিগত আয়কর নথির রিটার্ন, ২০১৭ সালে কোচিং করা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা মানি রিসটি, বেতন আদায় রেজিস্ট্রার, কোচিং সেন্টারগুলো প্রধান কার্যালয়, সকল শাখা, ভবন ভাড়া চুক্তি, ক্রয় দলিল এবং কোচিং সেন্টার মালিকদের পাসপোর্ট এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি চাওয়া হয়।

দুদক টিমের এ চাহিদাপত্রের ভিত্তিতে ওইবছর ২৯ ডিসেম্বর কিছু রেকর্ডপত্র নিয়ে দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে হাজির হয় ৩০ কোচিং সেন্টার। তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই পরবর্তীতে আরো কাগজপত্র দিয়ে যাবেন মর্মে প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু পরে রহস্যজনক কারণে কোনো কোচিং সেন্টারই আর কোনো রেকর্ডপত্র দেয়নি বলে জানা যায়।

অনুসন্ধান সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, ওই অভিযানটি ছিলো ‘অভিযানিক প্রক্রিয়া’য়। অভিযান শেষে কমিশন শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতরে সুপারিশ পাঠায়। সুপারিশের ভিত্তিতে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের বদলি করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরো জানান, কোচিং সেন্টারের মালিকদের বিরুদ্ধে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং অর্জিত সম্পদ হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তর তথা মানিলন্ডারিয়ের রেকর্ডপত্র দুদক কর্মকর্তাদের হস্তগত হয়। কিন্তু ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বে তৎকালীন কমিশন জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা অনুমোদন করেনি। ফলে কোচিং সেন্টার বিষয়ক অনুসন্ধানের মাধ্যমে কোচিং সেন্টার মালিকদের শুধু হয়রানি করার অভিযোগ ওঠে। কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে মোটা অংকের অর্থ ঢেলে অনুসন্ধানটিকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যায় বলেও অভিযোগ রয়েছে। অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে আইনগত কোনো ব্যবস্থা না নেয়া পুরো অনুসন্ধানটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কর্মকর্তাদের কয়েকবছর ব্যাপী পরিশ্রমও পরিণত হয় পণ্ডশ্রমে।

সাবেক প্যানেল আইনজীবী ব্যারিস্টার আকবর আমীন বাবুল বলেন, অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ তোলা হলেও বেসরকারি ব্যক্তিপর্যায়ের মানিলন্ডারিংয়ের অপরাধ দুদকের এখতিয়ারভুক্ত নয়। তা জেনেও দুদক কেন এই অনুসন্ধানের পেছনে এতগুলো কর্মকর্তাকে ব্যস্ত রাখলো-এটি বোধগম্য নয়। কমিশন এমনটি করতে পারে না। এর মধ্যে তৎকালীন ভিন্ন কোনো ইনটেনশন ছিল কি না-সেই প্রশ্ন এখন তোলা যেতে পারে। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।

এ বিষয়ে দুদকের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক নাসিম আনোয়ার মঙ্গলবার টেলিফোনে জানান, অনুসন্ধানটির সর্বশেষ পরিণতি সম্পর্কে আমিও জানি না। অবসরে চলে আসার পর অনুসন্ধানটি কিভাবে ‘পরিসমাপ্ত’ হয়েছে, সেটিও বলতে পারছি না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ