Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি

বোরো ক্ষেতে পোকার আক্রমণ

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ৯ মে, ২০২২, ১২:০১ এএম

দেশের বিভিন্ন জেলায় বোরো ধানের ক্ষেতে পোকার আক্রমণে দিশেহারা কৃষক। বগুড়া, যশোর, খুলনা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর এসব জেলায় পোকার আক্রমণে ক্ষেতের ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে অনেক কৃষক। ঝড়, শিলাবৃষ্টি এবং হাওরাঞ্চলে ভারতীয় ঢলের অকাল বন্যার পর পোকার আক্রমণ ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ে’র মতো অবস্থা।
কালবৈশাখী ঝড়ে বগুড়া, যশোর ও খুলনা এলাকার বিভিন্ন উপজেলায় কাঁচা ও আধাপাকা ধান মাটিতে নুইয়ে পড়েছে। এসব ক্ষেতে পোকা আক্রমণ করে ধানের শীষগুলো মেরে ফেলছে। কীটনাশক ব্যবহার করেও কোনো সুফল মিলছে না। অন্যদিকে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও গাজীপুরে বিআর ২৮ জাতের অগ্রিম ধানে পোকার আক্রমণে কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন।
নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের কৃষক চাঁন মিয়া বলেন, ‘এবার দুই একর জমিতে বিআর ২৮ জাতের ধান লাগাইছিলাম। এ জমিতে কমপক্ষে দেড়শ’ থাইক্যা একশ’ ষাট মণ ধান অওনের কথা। কিন্তু পোকার আক্রমণে সব শেষ অইয়া গেছে। জমিতে ধান নেই সব চুচা (চিটা) অইছে। যেইহানে দেড়শ’ মণ ধান অওনের কথা সেইহানে মাত্র ২৫-৩০ মণ ধান পাইছি। জমিতে যে খরচ অইছে তার অর্ধেকও উঠব না। এখন সামনের দিনগুলি কেমনে চলবাম, ধার দেনা কেমনে শোধ করবাম সেই চিন্তায় ঘম অয় না।’
তার পাশের দরিয়াবক্স গ্রামের কৃষক ইনসান আলী বলেন, ‘অনেক কষ্টে ১০ কাঠা জমি বন্ধক রাইখ্যা বিআর ২৮ জাতের ধান লাগাইছিলাম। কিন্তু পোকায় খাইয়া সব শেষ কইরা দিছে। ৮০-৯০মণ ধান অওনের কথা অহন মাত্র ১৫ মণ ধান অইছে। যে খরচ করছি তার তিন ভাগের এক ভাগও অয় নাই। অহন কেমনে যে চলবাম তা আল্লাই জানে।’
বগুড়া থেকে মহসিন রাজু জানান, বগুড়ায় আধাপাকা বা পেকে ওঠা বোরো ধান ক্ষেতে পোকার আক্রমণে খবর পাওয়া গেছে। পূর্ব বগুড়ার গাবতলী ও শাজাহানপুর এলাকায় কিছু নিচু এলাকায় পামরী পোকার উপদ্রপের কথা জানিয়েছেন চাষিরা। অন্যদিকে শেরপুর উপজেলায় এসব পোকাকে স্থানীয় কৃষকরা কারেন্ট পোকার আক্রমণ বলছেন। তবে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, মে মাসে সাধারণভাবে বোরো ধান পেকে ওঠে। এসময় পামরী জাতীয় পোকার উপদ্রপ দেখা দিলেও তাতে ধানের ফলনে তেমন একটা হেরফের হয় না।
বগুড়ার গাবতলী, শাজাহানপুর, শেরপুর অঞ্চলে ঈদের আগে, ঈদের দিনে এবং ঈদের পরে তিন দফায় হালকা, মাঝারি ও ভারিবর্ষণ হওয়ায় বেশকিছু নিচু এলাকার বোরোধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে পোকার সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে বলে বোরো চাষিরা জানিয়েছেন। এতে ফলনে ঘাটতির আশংকা জানিয়েছেন তারা।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের দায়িত্ব প্রাপ্ত তথ্য অফিসার মো: ফরিদুর রহমান, বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় ১৩ হাজার ৩২৩ হেক্টর, শাজাহানপুরে ১৮ হাজার ৭৩৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, বগুড়া জেলায় এবার ১ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের বিপরীতে ৮ লাখ ৭৭ হাজার ৯২৩ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হবে বলে তারা আশা প্রকাশ করছেন।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক দুলাল হোসেন বলেন, ব্লক সুপারভাইজারদের দেওয়া তথ্য মোতাবেক বগুড়ায় এরই মধ্যে ৫০ শতাংশ জমির বোরোধান কাটা মাড়াইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। বর্ষণ, ঝড় বাতাস ও পোকার আক্রমণে ফসলের যে সামান্য ক্ষতি হয়েছে সেটা কাউন্টেবল নয়।
অন্যদিকে যশোরের আট উপজেলার মধ্যে ছয় উপজেলায় বোরো ধানের খেতে বিভিন্ন ধরনের পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে। কীটনাশক ব্যবহার করেও কোনো সুফল মিলছে না। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন চাষিরা।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধানের শীষ বের হওয়ার সময় সাদা লম্বা লেদা পোকা শীষগুলো ছিদ্র করে ফেলছে। ফলে ওই ছড়াতে আর ধান না হয়ে শুকিয়ে সাদা চিটা হয়ে গেছে। ওই পোকার আক্রমণ থেকে বোরো ধান রক্ষায় কৃষক বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবহার করেও কোনো সুফল পায়নি। পোকার আক্রমণে ক্ষতির মুখে পড়েছে অধিকাংশ কৃষক। এতে প্রতি বিঘা জমিতে আট থেকে দশ মণ করে ধান কম পাচ্ছে কৃষক।
অভয়নগর উপজেলার বগুড়াতলা গ্রামের কৃষক শেখ নূর আলম বলেন, বোরো মৌসুমে এবার সাড়ে তিন বিঘা (৪২ শতকে বিঘা) জমিতে ব্রি-২৮ ধান লাগিয়েছিলাম। ব্লাস্টের লক্ষণ দেখার শুরু থেকেই কয়েকবার ওষুধ ছিটিয়েছি। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। ওই জমিতে অর্ধেকও ফলন হয়নি। উপজেলার শ্রীধরপুর গ্রামের কৃষক আনোয়ার মল্লিক জানান, আমি ৭৯ শতক জমিতে হিরা-২ হাইব্রিড ধান লাগিয়েছি। ব্লাস্টে অর্ধেকের বেশি জমির ধান নষ্ট হয়েছে। বাঘারপাড়া উপজেলা মণিরামপুর উপজেলার কৃষকদেরও একই অভিযোগ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, যশোর জেলায় ২০২১-২২ অর্থবছরে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ হেক্টর। আবাদ হয়েছে এক লাখ ৫৮ হাজার ৫০৫ হেক্টর। যার মধ্যে উফশী জাতের আবাদ করা হয়েছেÑ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ হেক্টর ও হাইব্রিড জাতের আবাদ হয়েছে ২৬ হাজার ৮৮০ হেক্টর। এর মধ্যে পোকার আক্রমণ হয়েছে ৩৭ হেক্টর জমিতে। কৃষক বলছেন, বাস্তবে পোকার আক্রমণ হয়েছে শতাধিক হেক্টর জমিতে।
খুলনার কয়রা উপজেলার জদুর বিল, হেতালখালির বিল, আবাদের বিল ও মধ্য মহারাজপুর বিলে ধানের ক্ষেতে ছড়ি থেকে শীষ বের হওয়ার সময় পোকায় আক্রমণ করে। সাদা লম্বা লেদা পোকা ধানের শীষগুলো ছিদ্র করে ফেলে। ফলে ওই ছড়িতে ধান না হয়ে শুকিয়ে সাদা (চিটা) হয়ে যায়। পোকার আক্রমণ থেকে বোরো ধান রক্ষায় বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবহার করেও কোনো সুফল পায়নি কৃষক। পোকার আক্রমণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন অধিকাংশ কৃষক। এতে প্রতি বিঘা জমিতে অন্তত আট থেকে দশ মণ করে ধান কম পাওয়ার কথা স্থানীয় কৃষকরা জানান।
ময়মনসিংহে এবারও বোরো ধানে বাম্পার ফলন হয়েছে। দিগন্তজুড়ে ফসলের মাঠে শুধু ধান আর ধান। তা দেখে কৃষকের মুখেও হাসি। কিন্তু হঠাৎ করে বোরো ধানের শীষ মরে সাদা হয়ে যাওয়ায় কৃষকের এ হাসি মøান হয়ে যায়। পোকার আক্রমণে অনেক জমিতে অর্ধেক পরিমাণও ধান পায়নি কৃষক। এতে করে চাষের যে খরচ তাও তুলতে পারেনি অনেকে।
জেলার গৌরীপুর উপজেলার ভাংনামারী ইউনিয়নের ভোলার আলী গ্রামের কৃষক আ. জলিল, মোহাম্মদ আলীসহ আরও অনেকেই জানান, হাড় ভাঙা পরিশ্রমে এবার ধানের বাম্পার ফলন আশা ছিল। কিন্তু ধান পাকতে শুরু করার আগ মুহূর্তে শীষ মরা রোগ ফসলের ব্যাক ক্ষতি করেছে। পরিচর্যা করেও এর রোগ ঠেকানো যায়নি। ফলে যে পরিমাণ ধান পেয়েছি তাতে খরচই উঠেনি। ধানের পোকার আক্রমণের বিষয়ে গৗরীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ লুৎফন নাহার জানান, ধানের শীষে পোকা একটি ছত্রাকজনিত রোগ। বিআর ২৮ জাতে এর আক্রমণ বেশি। এতে খুব একটা ক্ষতি হয়নি।



 

Show all comments
  • Yousman Ali ৯ মে, ২০২২, ৭:১৩ এএম says : 0
    আল্লাহ কারিম
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কৃষক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ