দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
অধ্যক্ষ, এম জায়েদ হোছাইন ফারুকী
পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ থাকতে কেন আমাদের মযহাব মানতে হবে এমন কথা মুষ্টিমেয় অপরিণামদর্শী আলেমের কণ্ঠ থেকে শুনা যায় অহরহ। কথাটি শুনতে অত্যন্ত সুন্দর, সঠিক ও বাস্তব পরিলক্ষিত হলেও এর অন্তর্নিহিত তথ্যগুলো মর্মবাণী আয়ত্বে আনতে হবে গভীর চিন্তার মাধ্যমে। কোরআন-হাদীস মানতে হলে কোরআন-হাদীস বুঝতে হবে। কোরআন হাদীস বুঝতে হলে অফুরন্ত জ্ঞানের মালিক হতে হবে, হতে হবে ব্যুৎপত্তি জ্ঞানের অধিকারী, হতে হবে জ্ঞান জগতের মহাসমুদ্রের মহাগবেষক ও মুজতাহিদ। জ্ঞান জগতের মহাপ-িতের সুষ্ঠু গবেষণার আলোকে প্রণীত নীতিমালা ছাড়া নিজ ইচ্ছামত কোরআন-হাদীস পড়েই আমল করা যাবে না। এই নীতিমালার নাম হচ্ছে ‘‘মযহাব’’ আর অনুকরণের নাম ‘‘তাকলীদ’’ বা আনুগত্য। কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশেই মযহাব মানা বা আনুগত্য করা ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য। সাধারণ আলিম ও সাধারণ লোকদের এর বিকল্প কিছু নাই। তাই বলা যায় মযহাব মানা অর্থই কোরআন-হাদীস মানা। অন্য কারো মত পথ মানা নয়। শুধু কোরআন-হাদীস দেখেই আমল করা যাবে বিষয়টি এমন নয়, সামনে অস্ত্র থাকলেই যে অস্ত্রোপচার করে রোগীর চিকিৎসা করা যাবে তাও কিন্তু না বরং রোগের কারণ, উৎপত্তি, ইতিহাস, ব্যবস্থা, চিকিৎসা পদ্ধতি, অস্ত্রোপচারসহ এ বিষয়ের উপর বিশাল জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। অন্যথায় রোগী মারাও যেতে পারে। ধর্মীয় বিষয়টি আরো স্পর্শকাতর। কারণ সুন্নাহর পা-িত্য, ভাষা, বিষয়, প্রেক্ষাপট, ছহীহ হাদীস (লক্ষ লক্ষ হাদীস হতে) সাহাবা নবী চরিত, ছাহাবা চরিত, ইতিহাস, বিজ্ঞান, তাবেয়ীগণের মতামত, আমল বিষয়ে পরিপূর্ণ পা-িত্যে সমৃদ্ধ হওয়া ছাড়া আমল শুরু করলে শুধু নিজের ইচ্ছার পুজারীই হবে না, ধ্বংস হওয়ার অনিবার্য কারণ হবে নিশ্চিতভাবে।
এক কথায় জ্ঞান না থাকার কারণেই মহাজ্ঞানী থেকে জানতে হবে। তাদের গবেষণালব্দ ‘‘মযহাব’’ মানতে হবে। তাকলীদ/আনুগত্য করতে হবে। আর এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআন-হাদীসে নির্দেশনাই দিচ্ছে। প্রকারান্তরে মযহাব মানাই হচ্ছে আল্লাহ ও রাসূলের নীতিমালার অনুসরণ করা।
০১। যেমন পবিত্র কোরআনে রয়েছে তোমরা আল্লাহ ও রাসূল এবং ওলামায়ে কেরামের আনুগত্য করো ।
০২। তোমরা যদি না জান তাহলে আলেমদের জিজ্ঞাসা করো। অর্থাৎ আলেমগণের আনুগত্য করো (সুরা- আম্বিয়া, ৭নং আয়াত) ।
০৩। যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার পিছনে লেগো না (সূরা বনি ইসরাইল, ৩৬ নং আয়াত)। আল্লাহর রাসূল (সঃ) এরশাদ করেন; তোমরা বড় দলের আনুগত্য করো (বোখারী) অর্থাৎ মযহাব মানার ক্ষেত্রে অনেক দল হতে পারে তখন কী করা যাবে? বিশ্বনবী (স.)-এর আদর্শ ও সাহাবায়ে কেরামের উজ্জীবিত, ইমামগণের নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। তাদের মধ্যে যে জামাতে আলেম সংখ্যা, লোক সংখ্যা বেশী সে দলের আনুগত্য করতে হবে।
সকল মোহাদ্দিসানের ইমাম, ছহীহ গ্রন্থের প্রবর্তক, হাদীস জগতের মহানায়ক ইমাম বোখারী (রঃ) পবিত্র কোরআনের এ আয়াতের অর্থে লিখেছেন; ‘খোদা ভীরুদের জন্য আমাদেরকে ইমাম বানাও’। এর অর্থ হচ্ছে পূর্বেকার ইমামগণ যাদের আমরা তাকলীদ বা আনুগত্য করি এবং পরবর্তীগণ আমাদের আনুগত্য করবে। প্রখ্যাত হাদীস বিশারদগণ যারা লক্ষ লক্ষ হাদীসের হাফেজ ছিলেন, তাঁরা সকলে কিন্তু মোকাল্লিদ ছিলেন। মযহাবের অনুসরণকারী ছিলেন, ইমাম বোখারী, তিরমিযি (রঃ), মুসলিম (রঃ), নাছায়ী (রঃ) এবনে মা’যা, শাফেয়ী (রঃ) ছিলেন, ইমাম আবু দাউদ (রঃ) হাম্বলী মযহাবের অনুসারী ছিলেন। পূর্ববর্তী কালের ৩য় শতকের বড় বড় হাদীস বিশারদগণ যেমন মযহাবের অনুসারী ছিলেন, তেমনি চৌদ্দশত শতাব্দীর মধ্য শতকের ইবনে তাইমিয়া (রঃ), ইবনুল কাইয়েম (রঃ), হাম্বলী মযহাবের অনুসারী। ইবনে হজর, সয়ুতী, ইমাম নববী শাফেয়ী (রঃ) মযহাবের অনুসারী, ইমাম তাহাবী (রঃ), হানাফী ও ইমাম ইবনে আবদিল বার (রঃ) মালেকী মযহাবের অনুসারী ছিলেন। শতাব্দীর সকল মোজাদ্দিদ, সংস্কারকগণ কোন না কোন মযহাবের আনুগত্য বা তাকলীদ করতেন। যেমন শাহ অলি উল্যা (রঃ), মোল্লা আলী কারী (রঃ) মোজাদ্দিদে আলকে ছানী (রঃ), আল্লামা থানবী, আহমদ রেজাখান, কাশমারি, ছাহাবান পুরী প্রমুখ শতাব্দীর চিন্তানায়কগণ হানাফী মযহাবের অনুসারী। শেষ শতাব্দীর মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব, ইবনে বাজ, শায়খ উছাইমীন হাম্বলী মযহাবের অনুসারী ছিলেন। আমাদের দেশে কোন কোন লোক বলতে চান যে সৌদী আরবে আলেমগণ কোন মযহাবের তাকলীদ করেন না। বিষয়টি মোটেই সঠিক নয়। বরং বিন বাজ, শায়খ মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব, শায়খ উছাইমীন সকলের ঘোষণা : আমরা ফিকহী মাছআলার হাম্বলী মযহাবের অনুসারী। আমরা চার মযহাবের ইমামকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখি এবং দ্বীনি ভাই মনে করে থাকি।
শায়খ উছাইমীন (রঃ) আরো বলেন; নিজের দেশের আলেমদের তাকলীদ করা সকলের জন্য আবশ্যক। নিজ দেশের আলেমগণ যে মযহাবের উহার করতে হবে তাকলীদ। ভিন দেশের (ভিন মহাদেশের) আলেমদের না, কেননা এর দ্বারা লাগাম হীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা সৃষ্টি হয়। তিনি আরো বলেন; যে বিষয়ে গবেষণার অবকাশ রয়েছে সে বিষয়ে কাউকে সুন্নাতের পরিপন্থী অথবা বেদআতী বলা যাবে না। এতে মুসলিম সমাজে বিচ্ছিন্নতা দেখা দিবে, হিংসা বিদ্ধেষ বাড়বে, পারস্পরিকভাবে ইসলামের শত্রুরা সুযোগ লাভ করেব। একপর্যায়ে তিনি আরো বলেন; যারা শরীয়তের বিধান বুঝতে পারদর্শী নয় তাদের তাকলীদ বা মযহাবের অনুসরণ করা ফরজ। (আল উসুল মিন ইলমিল উসুল, পৃ; ৮৭) সৌদী আরবের শীর্ষস্থানীয় আলেমে দ্বীন আবু বকর জাবের (রঃ) তার বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘‘আয়ছারুত তাফাছির’’ গ্রন্থে সুরা আম্বিয়া ৭নং আয়াতটিকে তাকলীদ/অনুসরণ ওয়াজিব হওয়ার উপর অকাট্য দলিল হিসেবে পেশ করেছেন। (পৃ: ৭৭০) সাধারণ লোকদের জন্য যে মযহাব মানা অপরিহার্য এতে আমাদের কোন দ্বিমত নেই (সানকীতি/আরকানুল ইসলাম- ৩৯৭)। অবশ্য বহু পূর্বেই চার মযহাবের যে কোন একটি মযহাব মানার উপর মুসলিম উম্মাহর (ওলামা) ‘‘এজমা’’ ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সুতরাং যে কোন লোক বা আলেম কোন না কোন মযহাবের অনুসারী সে আরব হোক বা অন্য মুসলিম দেশের হোক। যারা মযহাব মানে না বলে ঘোষণা দেয়; (১%) তারা ও প্রকারান্তরে তাদের দলীয় নেতা বা কোন হাদীস গ্রন্থকার কে অনুসরণ করে থাকে। যারই অনুসরণ করুক না কেন শেষ পর্যন্ত তাকলীদ করা তো হলো। তাকলীদ তো হতেই হবে। সাহাবায়ে কেরামের যুগেই তাকলীদ ছিল। ছিল তাবেয়ীন ও পরবর্তী যুগে। একটি বিষয় লক্ষণীয়, দেশের শতকরা কতজন কোরআন পড়তে জানে, হাদীস পড়তে জানে? হাদীস পড়তে জানে বুঝে হাজারে একজন হবে কিনা। তন্মধ্যে একজন হবে কিনা মুজতাহিদ আলেম? যাহা জানলে পরে ইজতেহাদ বা গবেষণার যোগ্য আলেম হতে পারে এদের সংখ্যা এক কোটিতে একজনও হবে কিনা? যদি তাই না হয় তাহলে নিজের প্রবৃত্তির গোলাম হয়ে কোরআন হাদীসের প্রকাশ্য অর্থ পড়েই আমল করা কখনও নিরাপদ নহে। নিরাপদ একটিই ১/৪ জনকে মেনে চলা। তন্মধ্যে যিনি সবার গুরু, যিনি গবেষণা জগতের জনক, সকল ফকীহ ও মোহাদ্দিসগণ যার মুখাপেক্ষী তার অনুসরণ করা শ্রেয়। তিনি ইমাম আযম আবু হানিফা (রঃ)। ইমাম শাফেয়ী (রঃ) তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কথা নিজের কণ্ঠে ঘোষণা দিতে গিয়ে বলেন; সারা বিশ্বের মানব জাতি হানাফী ফিকহ (মযহাব) এর মুখাপেক্ষী। ইমাম মালেক (রঃ) ইমাম আবু হানিফা (রঃ) সম্পর্কে ঘোষণা করেন; তিনি যদি কোন একটি পিলার সম্পর্কে ঘোষণা করেন সে উহা স্বর্ণ তাহলে তিনি এ ব্যাপারে দলিল প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারবেন। ইবনে হাজর (রঃ) সয়ুতী (রঃ) আল্লামা জাহাবী প্রমুখ হাদীস ব্যাখ্যা কারও হাদীসের নীতিমালা প্রণয়নকারী মহান ব্যক্তিবর্গ ইমাম আবু হানিফা (রঃ)কে একজন তাবেয়ী হিসেবে শত-সহস্র দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছেন। যেহেতু আনাস বিন মালেক (রাঃ)সহ কয়েকজন সাহাবীকে তিনি দেখেছেন, সুতরাং তিনি তাবেয়ী। ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম মালেক তাবয়ে তাবেয়ীন এবং ইমাম আহমদ একজন তাবয়ে তবায়ে তাবেঈন। ছহীহ হাদীস গ্রন্থগুলির প্রণেতাগণের উস্তাদ হলেন ইমাম বোখারী (রঃ), যাঁকে ইমামুল মোহাদ্দেসীন বলা হয়। তাঁর উস্তাদ ইমাম আহমদ (রঃ) তাঁর উস্তাদ ইমাম শাফেয়ী তাঁর উস্তাদ ইমাম মোহাম্মদ (রঃ), তাঁর উস্তাদ হলো ইমাম আবু হানিফা (রঃ)।সুতরাং বর্তমানের কোন আলেমের কথা শুনে শুধু হাদীস দেখে আমল করা অথবা তার তাকলীদ বা আনুগত্য করার চেয়ে লক্ষ কোটি গুন উত্তম হলো সবার শ্রেষ্ঠ ইমাম, ইমামে আযম আবু হানিফার (রঃ) আনুগত্য করা বা তাকলীদ করা। এ মহান ব্যক্তিবর্গের মযহাব বাদ দিয়ে কারো আনুগত্য করা মেনে চলা কোন অবস্থায় নিরাপদ নয় বরং মহাবিপজ্জনক। এসব অপরিণামদর্শী মুষ্টিমেয় আলিমধারীগণ বলেন; ছহীহ হাদীস দেখে দেখে আমল করবো, মযহাবের দরকার নেই। কিন্তু তারা আদৌ লক্ষ্য করে না যে সকল মযহাবগুলি ছহীহ হাদীসের উপরই প্রতিষ্ঠিত। যে যা ছহীহ হাদীস দেখুক বলুক না কেন ঐ হাদীসটি কোন না কোন মযহাবে সংরক্ষিত রয়েছে বা হাদীস দ্বারা ফিকহী মাছআলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ জন্যই চারজন সম্মানিত ইমাম বলেছেন; ‘‘ছহীহ হাদীসই আমার মযহাব বা নীতিমালা’’ একথা বলার কোন অবকাশ নেই যে, তাঁরা ছহীহ হাদীসগুলি বাদ দিয়ে মাছআলার জবাব প্রণয়ন করেছেন দুর্বল বর্ণনার হাদীস অথবা কিয়াস দ্বারা (নাউজুবিল্লাহ), এমন ও ভাবনা করা যায় না যে কতিপয় এই আলেমগণ ছহীহ হাদীস গুলি নতুনভাবে লাভ করেছেন। মযহাবের ইমামগণ এ হাদীসগুলি পাননি (নাউজুবিল্লাহ)।
একটি ‘‘ছহীহ হাদীস’’ ও এ পৃথিবীতে এ মুহূর্তে পাওয়া যাবে না যা ৪ মযহাবের কোন না কোনটিতে উল্লেখ নাই।
সুতরাং ছহীহ হাদীসের ধুয়া দিয়ে বিশ্বের ৯৯% মুসলিম উম্মাহকে বিভ্রান্ত করে মযহাবের আনুগত্য থেকে ফিরানোর অপচেষ্টা সম্পূর্ণ ‘‘এজমায়ে উম্মাহর’’ পরিপন্থি। যথাসম্ভব এ থেকে নিবৃত থেকে মুসলিম উম্মাহকে কোরআন সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান দান করাই হবে অবশ্য কর্তব্য। মহান আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।