Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৭ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

গম উৎপাদন এবারো লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি

কৃষকের কাছে ব্লাস্ট ও তাপ সহনশীল বীজসহ আবাদ প্রযুক্তি পৌঁছালে উন্নীত করা সম্ভব

নাছিম উল আলম : | প্রকাশের সময় : ৯ মে, ২০২২, ১২:০২ এএম

এবারো দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশে গম উৎপাদনে লক্ষ্য অর্জিত হল না। ভালো দাম ও রোগ বালাই সহনশীল বিপুল সম্ভবনাময় এ দানাদার খাদ্য ফসল আবাদে কৃষকদের কাছে কারিগড়ি জ্ঞান হস্তান্তরসহ আগ্রহ সৃষ্টির উদ্যোগ নেই। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে গমের আবাদ সম্প্রসারণের যে ব্যাপক সুযোগ রয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে উৎপাদন ২০ লাখ টনে উন্নীত করার চিন্তা ভাবনা চলছে।
রোগ প্রতিরোধক এবং তাপ সহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল বীজ ও আবাদ প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে কৃষকের কাছে পৌছানসহ কৃষকের মাঝে যথাযথ আগ্রহ সৃষ্টি করাই এ ফসলের সম্প্রসারণে এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদগণ। বছর চারেক আগে ‘ছত্রাকবাহী ব্লাস্ট’ রোগের সংক্রমনে দক্ষিণÑপশ্চিমাঞ্চলের ৫টি জেলায় বিপুল পরিমান উঠতি গম ফসল বিনষ্টের পরেই সরকারি তরফ থেকে আক্রান্ত জেলাগুলোতে পরবর্তী ৩ বছর আবাদ নিরুৎসাহিত করা হয়। ফলে কৃষকদের মাঝেও আগ্রহে যথেষ্ঠ ভাটা পড়ে। তবে আশার কথা, বিগত দুটি মৌসুমের মতো সদ্য সমাপ্ত রবি মৌসুমেও দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের কোথাও ছত্রাকবাহী এ রোগের সংক্রমন ঘটেনি।
কিন্তু এরপরেও গমের আবাদী জমির পরিমান সাড়ে ৩ লাখ হেক্টরও অতিক্রম করছে না। উৎপাদনও এখন ১২ লাখ টনের নিচে। অথচ এ ফসল নিয়ে যথাযথ নজরদারি করলে আগামী পাঁচ বছরে গমের আবাদী জমির পরিমান ৫ লাখ হেক্টরে উন্নীত করে ২০ লাখ টন গম উৎপাদন সম্ভব বলে মনে করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদগণ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর-ডিএই’র দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, গত বছর ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬৫ হেক্টর জমিতে আবাদ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে দেশে গমের আবাদ হয়েছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার হেক্টরের কাছাকাছি। উৎপাদন ছিল ১২.৩৪ লাখ টন। তার আগের বছর ৩ লাখ ৪২ হাজার ৩শ’ হেক্টরে আবাদের মাধ্যমে উৎপাদন ছিল ১২ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩০ টনের মত।
কিন্তু সদ্যসমাপ্ত মৌসুমে দেশে আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছিল গত বছরের চেয়ে আরো সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর কম, ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৫শ হেক্টরে। উৎপাদন লক্ষ্য নির্ধারিত ছিল ১২ লাখ ২৬ হাজার ৪শ’ টনের মত। কিন্তু সেখানে আবাদ হয়েছে কিছুটা বেশি, ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৭ হেক্টরে। যা গত বছরের প্রায় সমান। কিন্তু অতি সম্প্রতি গম কর্তনের পরে সারা দেশে সর্বমোট উৎপাদন পাওয়া গেছে ১১ লাখ ৬৭ হাজার ২৯৬ টন। যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ৬৬ হাজার টন কম। ডিএই’র মতে, এবার দেশে গমের গড় উৎপাদন পাওয়া গেছে প্রতি হেক্টরে ৩.৬৫ টন। আবহাওয়া অনুকূল থাকার পাশাপাশি উফশী জাতের মানসম্মত বীজ ও সঠিক পরিচর্যা হলে খুব সহজেই দেশে গমের উৎপাদন হেক্টরে ৪ টনে উন্নীত করা সম্ভব বলেও মনে করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদগণ।
সদ্য সমাপ্ত রবি মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলের ১১ জেলায় ৫৫ হাজার ৫৫০ হেক্টরে গম আবাদের লক্ষ্য থাকলেও সর্বশেষ হিসেবে মোট আবাদ হয়েছে ৪৯ হাজার ৩৮৫ হেক্টরে। এরমধ্যে বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলায় ৭ হাজার ৪৭০ হেক্টরের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে চূড়ান্ত আবাদ হয়েছে ৭ হাজার ২৫০ হেক্টরে। যা গত বছরের প্রায় দ্বিগুন। আর বৃহত্তর ফরিদপুরের ৫টি জেলায় ৪৮ হাজার ৮০ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রকৃত আবাদ হয়েছিল ৪১ হাজার ৭৪৭ হেক্টরে। যা গত বছরের চেয়ে ৮ হাজার হেক্টর কম।
ফলে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় এবার প্রায় ২৩ হাজার টন এবং বৃহত্তর ফরিদপুরের ৫ জেলায় ১ লাখ ৩৩ হাজার ৪৭৫ টন গম উৎপাদন হয়েছে বলে ডিএই সূত্র জানিয়েছে। এবার বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় গড় উৎপাদন হেক্টরে ২.৯৮ টন হলেও ফরিদপুরের ৫ জেলায় তা ৩.২০ টনে উন্নীত হয়।
স্বল্প সেচ এবং সহজ বালাই ব্যবস্থাপনাসহ উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলক ভাবে কম ও ভালো দাম পাওয়ায় নিকট অতীতে দেশে গমের আবাদ দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটলেও ২০১৭ সালে ৫টি জেলায় ছত্রাকবাহী ‘ব্লাষ্ট’ সংক্রমনে বিপুল আবাদ বিনষ্ট হয়। এমনকি কয়েকটি এলাকায় ফসল আগুনে পুড়িয়ে সংক্রমন প্রতিরোধ করতে হয়েছে। যেসব এলাকায় ব্লাষ্টÑএর সংক্রমন দেখা দেয়, পরবর্তী ৩ বছর সে জেলায় গমের আবাদ নিরুৎসাহিত করে সরকার। ফলে অত্যন্ত সম্ভবনাময় এ ফসল আবাদ সম্প্রসারণের পরিবর্তে ক্রমশ পেছাতে শুরু করে। তবে বিগত দুটি মৌসুমের মত সদ্য সমাপ্ত রবি মৌসুওমেও ব্লাষ্টের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকায় পরিস্থিতি অনুকূলে হলেও অত্যন্ত সম্ভনাময় এ ফসলের আবাদ সম্প্রসারণে তেমন কোনো সমন্নিত উদ্যোগ নেই।
দেশে গম আবাদের ইতিহাশ খুব বেশি দিনের না হলেও খাদ্য ফসল হিসেবে তা ইতোমধ্যেই দ্বিতীয় শীর্ষস্থান দখল করেছে। সারা বিশ্বে গম উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম ২০টি দেশের মধ্যে। ১৯৮৫ সালে দেশে প্রায় ৭ লাখ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের গম আবাদের মাধ্যমে প্রায় ১২ লাখ টন এ দানাদার ফসল উৎপাদন হয়েছিল। কিন্ত এরপর থেকে গমের আবাদ সম্প্রসারণের পরিবর্তে তা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের অনেক জমিতেই গমের পরিবর্তে এখন ভুট্টা ছাড়াও এবার পেয়াঁজের আবাদ হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল।
আমাদের ‘কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট-বারি’ ও ‘গম গবেষণা ইনস্টিটিউট’এর বিজ্ঞানীগণ ইতোমধ্যে উচ্চ ফলনশীল ও পরিবেশ উপযোগী একাধিক গম-এর জাত উদ্ভাবন করেছেন। এমনকি আমাদের দেশের মতো কম শীত প্রধান অঞ্চলের জন্য ‘শতাব্দী’ নামের গম বীজও উদ্ভাবন করেছেন বারি’র বিজ্ঞানীগণ। বারি উদ্ভাবিত গম বীজের মধ্যে ‘কাঞ্চন, আকবর, অঘ্রানী, শতাব্দী ছাড়াও সৌরভ-বারি-১৯ ও গৌরব-বারি-২০’ নামের উচ্চ ফলনশীল গম বীজও রয়েছে। এসব বীজ থেকে হেক্টর প্রতি সাড়ে ৩ টন থেকে সাড়ে ৪ টন পর্যন্ত গম উৎপাদন সম্ভব বলে বারি’র দায়িত্বশীল সূত্রে বলা হয়েছে।
এছাড়া গম গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীগণও আরো একাধিক উচ্চ ফলনশীল গম বীজ উদ্ভাবন করেছেন। এমনকি ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাতের গম বীজও উদ্ভাবন করেছেন আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীগণ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ