পদাবলি
রোজাকে দরকার আবদুল হাই শিকদার সকল কিছু বক্র যখন কে করে সব সোজা?রমজানের পর্দা তুলে হাসেন তখন রোজা! ঘর দরোজা মলিন হলে করাতে হয় রঙ,তলোয়ারকে রাখতে তাজা ছাড়াতে
জোছনায় ইলেকট্রিক বাতি টিমটিমে। যমুনার কুচান তরঙ্গ দুপাশে- মাঝে চাতাল সরু বালিময়। নির্জীব তিনটা রেল লাইন- দু’টার বুক ফকফকা। অন্যটাতে খাপটিমারা গোটা চারেক ওয়াগন। এক মাথায় সিরাজগঞ্জ ঘাট ষ্টেশন- আরেক দিকে রেলওয়ে ফেরিঘাটের পল্টুন। লাইনের ডানপাশে পল্টুনের কাছে গোটা কয়েক ছাপড়া হোটেল আর পান দোকান- বাতি জ্বলছে- কোনটায় লোক দুয়েকজন আছে- কোনটা একেবারে ফাঁকা।
এই নির্জীব পতিত পরিবেশ এ-মাথা থেকে ও-মাথায় এক চক্করেই টের পেয়েছে আমান। তারপরও হৃদয় তার সুখদ আমেজে বিভোর।
পল্টুনের সামনে রেল লাইনের শেষ মাথায় বালিতে বসে আছে এক কিশোর। চোখ জোড়া স্থির আমানের উপর- তার প্রতিটা পা ফেলা পা তোলায়। ঝুর ঝুরে বালিতে পা রাখতে গিয়ে এই মাত্র যে টাল সামলাল- তাও ছেলেটার চোখের উপর দিয়ে।
আরেকটু মনোযোগী হলে অথবা সুখদ আমেজ থেকে মুক্ত থাকলে এই ছেলেটা তাকে সন্দিগ্ধ করে তুলত। কোন একটা দোকানে আলোকিত কাঠের বেঞ্চিতে বসতে হত স্থির হয়ে।
এখন ওই দোকানগুলোর টিমটিমে আলো এড়িয়ে যমুনা-পুলিনে নির্জনতায় নিঃসঙ্গ সে সুখস্মৃতিতে মগ্ন। ভাঙনমত্ত অশান্ত যমুনার তরঙ্গ রাশিতে রূপাগলা জোছনায় বিগত রাত্রে যাপিত সুখ তাকে প্রবহমান এক স্বপ্নে সওয়ার করে। অতীব মোহন ও দুর্লভ এই স্বপ্নমগ্নতা।
সহসা খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে তার স্বপ্ন-নৌকার গলুই। থমকে দাঁড়ায়- সজাগ হয়ে ওঠে চোখ-কান।
আধা মিনিট- আবার সেই হাসি আরেকটু প্রলম্বিত। ওয়াগনের আড়াল থেকে লাফিয়ে পড়ে জোছনার উপর যমুনার ইলিশের মত। আমানের চোখ দুই ওয়াগনের মাঝখানে সীমিত ফাঁকে। সেইখানে আচমকা দুলে ওঠে লতান একহারা শরীরের একটা ছায়া।
কাল রাত গভীরে খোলা জানালা গলিয়ে ঢুকে পড়া জোছনার আলো মেখে লতিয়ে উঠেছিল ছিপছিপে এক শরীর। চেঁচিয়ে উঠতে উঠতেই একটা নরম হাত অসম্ভব শক্ত হয়ে এঁটে বসে তার মুখে। তার ভীত ক্-এ-এ- শব্দটার থেতলান অনুরণনের উপর চাপা থরোথরো হাসি ঝরা-বকুলের মাদকতা নিয়ে ঝর-ঝরিয়ে পড়ছিল।
আবার যাপিত সুখের স্মৃতি-অন্তহীন দোলা... দুলতে দুলতে যমুনা পাড়ের নির্জনতা ছন্দময় শিহরণে সিক্ত হয়ে ওঠে তার আগেই-
ভাঙা তাতান গলায় : মেরে অঙনমে তেরা কেয়া কাম- কেয়া কাম হ্যায়...
পল্টুনের সামনে বালিতে গেড়ে বসা ছেলেটা অস্থির- লাফ দিয়ে উঠে। বুকের ভেতর থেকে ভীতি বেরিয়ে আসে প্রায় নিঃশব্দ উচ্চারণে : অহন কি অব?
মেয়েটার মুখে জ্বলন্ত সিগারেটের ধক্ ধক্ আলো। এক পা ওয়াগনের জয়েন্টে- টান লেগে সরে গেছে শাড়ি- নিরাভরণ উরুতে তাল ঠুকছে কণ্ঠের সাথে মিলিয়ে।
আমান নেমে আসে ঘাটের বাস্তবতায়- শোভন দ্রুততায় পা চালায় পল্টুনের দিকে। ছেলেটা আশ্বস্ত। বসে পড়ে ফের গোলাকার চ্যাপ্টা ব্যাগটার পাশে।
দোকানগুলো স্থির হয়ে ছিল আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠার অপেক্ষায়। ইঞ্জিনের হেড লাইট এসে পড়ে রেললাইনের শেষ পিলারে। গাড়ি এসে গেছে! মুহূর্তে ভরে যায় বালুময় চাতাল- ঠাঁই নেই পল্টুনেও।
আমান মিশে গেল ফেরিঘাটে- হাজারো মানুষের ভিড়ে।
ছেলেটার চোখ স্থির আমানের ওপর- হারান যাবে না মাস্টার সাবকে- বিবি সাবের হুকুম। ঢাকায় পৌঁছতে পারলেই কড়কড়ে একশ’ টাকা। স্বপ্ন ও সতর্কতা দু’য়ে মিলে চোখে খেলা করে তার অদ্ভুত এক আলো।
পল্টুনে টিকেট ঘরের সামনে লাইন। উঠে পড়ে আমান- ছেলেটাও উঠে। তার চোখ বাঁচিয়ে পিছু নেয়- হাতে একটা ছালার ব্যাগ।
আমান টিকেট কেটে বেরিয়েই ফেরির আলো দেখে। ফেরিতে উঠার পরও টের পায় না- ছেলেটা তাকে অনুসরণ করছে।
সীটে বেশ জায়গা- আরামেই শুয়ে যাওয়া যায়। সামনের সীটে এক তরুণী ইতোমধ্যে তার নাক ডাকছে মৃদু তালে। পাশে বৃদ্ধ- হয়ত বাবা- আধশোয়া। শাড়ি সরে তরুণীর পায়ের গোছায় নির্জন আলো অদ্ভুত ঢঙে চমকাচ্ছে। ঠিক এই রকম একটা আলোর পরশ পুলক তার হাতে এখনও স্থির।
ভাবী যখন বলেছিল, ভাই, এটা আমার ছোট বোন জলি, কলেজে পড়ে। তখন সাদামাটা দৃষ্টিতেই তাকিয়ে ছিল আমান- তাকাতেই তার চোখে দমকা বাতাস লাগে প্রাণ-তরঙ্গের। জলির চোখে অতলান্ত রহস্যময়তা- জীবনে এই প্রথম আমান কারও চোখে পাঠ করবার মত অর্থময় এক পৃথিবীর সন্ধান পায়।
অজানা মোহন এই ভুবনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবার জন্য মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানায় ভাবীকে। ভাবীর সাথে সম্পর্কটা যে টিউশনির সূত্র ধরে, এইটিই মিথ্যা বানিয়ে দিয়েছে ভাবী। আর জলি- জলি তাকে শরীরের নির্জন আলোর পথ বেয়ে রক্তিম উল্লাসে পৌঁছে দিয়েছে।
জলির প্রাণবন্যায় প্লাবিত আমান ঢাকা ফিরছে সেই সুখদ আমেজের ওজনহীন বোঝা নিয়ে।
আমানের বেঞ্চিটা এক কোণে- পেছনে লাগোয়া আরেকটা বেঞ্চি মাত্র। মাঝখানের পার্টিশন তিন-সাড়ে তিন ফুটের- পার্টিশনের নিচের দিকটাও তিন-চার ইঞ্চি পরিমাণ ফাঁকা। উপরের বালব ডিস্টার্ব করছে- এ দিকটায় আলো কম।
বেঞ্চির উপর কোণের দিকে ব্যাগ রেখে আমান আধশোয়া হয়। এখন চোখে আলো লাগে না- ঘুমান যায় নিশ্চিন্তে। হঠাৎ চোখ তার তরুণীর ঈষৎ অনাবৃত পায়ের গোছায়। সেই হৃদয় ছলকান তরঙ্গ- আগে যা কখনও হয়নি। ফেরির ইঞ্জিনের একঘেঁয়ে যান্ত্রিক শব্দ এক সময় নিঃশব্দ হয়ে ওঠে। নির্জন হয়ে পড়ে ফেরি- যমুনাবক্ষ এবং রাত্রিনিশীথ। শুধু ঈষৎ উন্মুক্ত গোছা- আলোর তরঙ্গ এবং আরও রহস্যময় নরম পেলবতায় ধীরে-ধীরে এবং ধীরে ডুবে যেতে থাকে আমান।
পেছনে লাগোয়া বেঞ্চিতে সেই ছেলেটা সজাগ। তার সতর্ক দৃষ্টি স্থির আমানের ব্যাগের ওপর। ফেরি ইঞ্জিনের একঘেঁয়ে শব্দের একটা টান আছে- সে এই টান অনুভব করে। একটা ট্রিপ মানে একশ’ টাকা শুধু নয়- ফেরির চলার শব্দে-ছন্দে বিগত রাতের সুখকর আমেজও। বিশাল যমুনার স্রোতবাহী পানির উপর দিয়ে তরতরিয়ে এগিয়ে চলা- ইঞ্জিনের এই একটানা শব্দ ঝংকারে এমন এক উল্লাসের স্বাদ পায় সে- যা তাকে অবিরত টানে।
মৃদু কলরব আর হৈচৈ-এ লাফিয়ে উঠে আমান। ভোরের প্রশান্ত আলো ঢেউ খেলছে- ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে সবাই উš§ুখ। রাতে যাকে তরুণী বলে মনে হয়েছিল এখন সে পরিষ্কার মধ্যবয়স্কা মহিলা। বুকের ভেতর বাহিত স্মৃতির কাছে চোখ তার প্রতারিত।
জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে ফেরি থেকে নেমে সবাই ছুটছে- যেন রেলগাড়িটা শুধু তাকে ফেলে রেখেই চলে যাবে। আমান টিকেটের নাম্বার মিলিয়ে ইঞ্জিনের লাগোয়া বগিতে এসে উঠল।
বুফে কারের ওয়েটারকে চায়ের অর্ডার দিয়ে টয়লেট থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে দেখল যাত্রীর সংখ্যা কম- একটা ডবল সীট তার দখলে। সামনের সীট দু’টাও খালি।
চা খেয়ে কাপটা নিচে রেখে একটা সিগ্রেট ধরায়। একজন রেল পুলিশ এসে সামনের সীটে বসে। পকেটে থেকে একটা কমদামী ফিল্টার সিগ্রেট বের করে- মুখে অনুরোধের হাসি মেখে তাকায় আমানের দিকে।
তারপর বলে, ভাই আপনার ম্যাচটা একটু-
নিশ্চয়-নিশ্চয়- বলে আমান লাইটারটা তুলে দেয়।
রেল পুলিশ সিগ্রেট ধরিয়ে এক গাল ধোঁয়া বাতাসের উল্টো দিকে ছুঁড়ে দিতে গিয়ে নিজেই ধোঁয়াচ্ছন্ন। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখের পানি মোছে- গলায় বেশ শব্দ করে কাশি ভাঙে। বিব্রত হাসি ফুটে মুখে।
বলে, সিগ্রেটটা ছাড়তে চাচ্ছি- পারছি না। ডিউটিটা এমন যে সারাক্ষণ টেনশন। বিশ্বাস করবেন না, এত যে চোখ-কান খোলা রাখি- তার মধ্যেও শালারা পার হয়ে যায়। আর কত সব অভিনব কায়দা যে বের করেছে- ভাবতেই পারবেন না।
আমান বুঝতে পারে না কি বলতে চাচ্ছে রেল পুলিশ। সিগ্রেটটা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।
কী বুঝতে পারলেন না ত! পারবেন কী করে! আমরাই কী পারি! এই স্মাগলার বেটাদের মগজ শয়তানের একেকটা কারখানা- একেকবার একেক কৌশল। কিছুদিন ধরে এত বেড়ে চলেছে এদের উৎপাত যে- ডিউটি করে স্বস্তি পাই না।
আমান মনোযোগ দিয়ে শোনে শুধু। ওর এ ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই- তাই বলতে পারে না কিছু।
রেল পুলিশ উঠে পড়ে বলে, যাই এখন একবার টহল না দিলে বেটারা এমনভাবে ঘাপটি মারবে- খুঁজেই পাওয়া যাবে না।
একটু থেমে বলে, পা তুলে আরাম করে যান- মমিসিং পর্যন্ত কোন অসুবিধা নাই।
তারপর পা বাড়ায় এই বগিরই শেষ মাথায় এটেন্ড্যান্টদের খুপরির দিকে। আমান স্যান্ডেল খুলে রেখে পা তুলে বসে। সীট আর জানালার কোণে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে।
ছেলেটা এতক্ষণ দরজার কাছ থেকে কান পেতে রেখে চোরাচোখে দৃষ্টি রাখছিল এদিকে। এবার সে এগিয়ে আসে। আপাত স্বস্তির ঢেউ খেলছে তার মুখে। আমানের পেছনের সীটে বসে- আড়মোড়া ভাঙে। কিন্তু চোখ বন্ধ করতে পারলেও বন্ধ করা যাবে না। বিবি সাবের হুকুম-চোখছাড়া করা যাবে না। তাছাড়া অভ্যাস হয়ে গেছে। যায় চোখ খুলে- ফিরে চোখ বন্ধ করে ঘুমাতে ঘুমাতে।
ময়মনসিংহ পৌঁছে আমানের ঘুম ভাঙে যাত্রীদের সাড়াশব্দে। চোখ মেলে দেখে এখান থেকে উঠা যাত্রীদের নতুন নতুন সব মুখ। জানালাপথে বাইরে চোখ রেখে কেটে যায় পরের ক’ঘন্টা।
কমলাপুর নেমে রিকশা নিয়ে বাসায় পৌঁছে দশটায়। কাজের বেটি সাহেবের মা আগাম নাশতা তৈরি করে রেখেছিল। মেস জীবনে কাজের বেটির কাছ থেকে এ ধরণের সচেতনতা আশা করা যায় না। কিন্তু সাহেবের মা ব্যতিক্রম- আর তাই কাজের বেটি হয়ে ঢুকলেও সাহেবের মা এখন এই মেসবাড়ির কর্ত্রী। বোর্ডাররা সবাই মেনে নিয়েছে তার কর্তৃত্ব।
ঘুমে চোখ ভেঙে এলেও বাথরুম সেরে নাশতা করতে হল আমানকে। গোসল করে নিতে পারলে ভাল হত- পারল না- ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শরীর।
বিছানায় গড়িয়ে পড়ার আগেই সে সাহেবের মাকে ডেকে বলল, শুনেন- আমাকে ডেকে দেবেন দেড়টার দিকে।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে খেয়াল নেই। হঠাৎ সাহেবের মা’র ডাক শুনে বিছানায় উঠে বসে।
সাহেবের মা বলে, সাব এক পোলায় ডাকে আপনেরে।
আমান দরজার দিকে তাকায়। ছেলেটা হাত তুলে সালাম দেয়- চিনতে পারছে না- কে। আবার তাকায়- মুখটা এবার চেনা চেনা লাগছে। মনে হয় কোথায় যেন দেখেছে। কিন্তু কোথায়- মনে করতে পারে না কিছুই।
ছেলেটা ঘাবড়ে যায়। রাতভর পেছনে পেছনে থেকে পাহারা দিয়ে আনল। আর এখন মাস্টার সাব তাকেই চিনতে পারছে না! ছেলেটা মরিয়া হয়ে ওঠে।
কন্ঠে গভীর আগ্রহ ফুটিয়ে বলে, আমারে চিনতাচেন না মাস্টার সাব! পরশু রাইতে যে দোকানথনে সিগারেট আইনা দিলাম-
পরশু রাতের কথা- আমানের মনে হচ্ছে এই ছেলেটাই সিগ্রেট এনে দিয়েছিল। তখন মনোযোগ দিয়ে দেখার সময় ছিল না তার। কারণ- জলি। আবেগে অস্থিরতায় মগ্ন কণ্ঠ : মনে থাকবে আমাদের কথা ঢাকায় গিয়ে? মনে থাকবে এই জোছনাভরা গহীন রাতের কথা?
আমানের চোখে স্বপ্ন নামে। তার পৃথিবী জুড়ে বরফ কুচির মত স্বপ্নের জোৎস্না রেণু ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এর মাঝখানে ছেলেটার উপস্থিতি তার কাছে এই মুহূর্তে উটকো আপদ।
আপদের মতই ছেলেটা এবার ঘরে ঢুকে পড়ল- কিন্তু কিছু বলছে না। বারবার তাকাচ্ছে পেছন দিকে। তার লক্ষ্য সাহেবের মা’র দিকে।
আমান দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি যান।
সাহেবের মা সরে যায় দরজা থেকে। ছেলেটা দু’পা পিছিয়ে দরজার বাইরে দৃষ্টি ফেলে নিশ্চিত হয়- সাহেবের মা আশেপাশে নেই।
তারপর আমানের কাছাকাছি এসে বলে, মাস্টার সাব
আমার দেরি হইয়া যাইতেছে- আপনের ব্যাগটা রাখছেন কই?
আমান অবাক, ব্যাগ-আমার ব্যাগ- আমার ব্যাগ কেন?
ছেলেটা অস্থির, কাম আচে মাস্টার সাব- দেরি হইলে সব গুবলেট হইয়া যাইব- বিবি সাবে আমারে মাইর্যা ফালাইব।
আমান জিজ্ঞেস করে, কেন- মারবে কেন?
ছেলেটা দ্বিধাহীন জবাব, বহুত ট্যাকা লোকসান হইয়া যাইব যে-
আমান অবাক, লোকসান হবে কেন- কি হয়েছে?
ছেলেটার সরল অনুনয়, মাস্টার সাব আপনের ব্যাগটা আমারে একটু দেন- সব কতা কইতে পারতাম না- আমার ক্ষেতি হইব-
আমান থমকে ওঠে, কি বলছ তুমি- আমার ব্যাগ দিয়ে তোমার কি দরকার?
ছেলেটা নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকে- তার মুখে ভীতির ছাপ। আমান উঠে গিয়ে ব্যাগটা বিছানার উপর রাখে। তারপর চেইন খুলে ব্যবহৃত জামা-কাপড়গুলো এক এক করে নামাতে থাকে। এক কোণে তলার দিকে একটা কালো কাপড়ের ছোট পুটলি। আমান থ’- এ পুটলি ত তার নয়! এটা কার- কোত্থেকে এল তার ব্যাগে?
পুটলিটা বেরিয়ে আসার সাথে সাথে ছেলেটার চোখ চক চক করে ওঠে। সে পুটলিটা নিয়ে নেবার জন্যে ছোঁ মারে।
তার তাগেই আমান পুটলি ধরে ফেলে জিজ্ঞেস করে, এটা কার- আমার ব্যাগে এল কি করে- কি আছে এর ভেতর?
নিরুত্তর ছেলেটার ভাবভাব দেখে মনে হয়, বোমা মারলেও কথা বেরুবে না। আমান উঠে গিয়ে ওর মুখোমুখি দাঁড়ায়- পুটলিটা হাতে ধরা।
কি ব্যাপার- কথা বলছ না কেন? এটা তোমার? তুমি রেখেছ? কখন রাখলে? কেন রাখলে? কি আছে এর ভেতর?
আমানের এতগুলো প্রশ্ন যেন ছেলেটার কানেই ঢুকেনি। সে তাকিয়ে আছে জানালার দিকে- পলকহীন।
আমান আবার ধমকে ওঠে, কথা বলছ না কেন?
এবার কথা বলে ছেলেটা, মাস্টার সাব পুটলি দিয়া দেন- আমার সময় নাই- বিবি সাব মাইর্যা ফালাইব আমারে ঠিক সময় মতন পৌঁছায়া দিবার না পারলে-
আমান বিছানায় বসে পড়ে পুটলি খুলতে যায়।
ও অস্থির আর্ত কণ্ঠে চাপা চিৎকার দিয়ে ওঠে, দোহাই মাস্টার সাব আপনের- পুটলি খুইলেন না- সর্বনাশ হইয়া যাইব।
আমানের হাত থেমে যায়। বিস্ময় এবার ক্রোধে রূপান্তরিত হয়।
সে জিজ্ঞেস করে, কি আছে এর মধ্যে বলছ না কেন?
ছেলেটা অনুনয়ের স্বরে বলে, মাস্টার সাব আপনে ত বুঝবারই পারতাছেন। অহন দিয়া দেন- আমি যাই-
আমান বলে, তোমাকে ত এভাবে ছাড়া যাবে না। তোমাকে- তোমাকে পুলিশে-
কথা শেষ করতে দেয় না ছেলেটা- বলে ওঠে, মাস্টার সাব আমারে ধারাইয়া দিলে আপনের কোন লাভ হইব না- আপনেই তো ব্যাগে কইরা আনছেন- আনছেন না?
মিনিটখানেক স্তব্ধ হয়ে থাকে আমান- তারপর জিজ্ঞেস করে, কে ঢুকিয়েছে এটা আমার ব্যাগে?
ওর সাফ জবাব, তা আমি কইবার পারি না মাস্টার সাব- বিবি সাবে শুধু আমারে কইল- মাস্টার সাবের পিছ পিছ যা- চোখে চোখে রাখবি। মাল আছে মাস্টার সাবের ব্যাগে-
একটু থেমে বলল, আমার দোষ কি কন? মাল ঠিকমত পৌঁছায়া দিবার পারলে বিবি সাব দিব একশ’ ট্যাকা। ধরলে ত আমগরেই ধরে পুলিশে- তবু পেট বাঁচাইতে হয়- কাম করতে হয়। আপনেই কন মাস্টার সাব আমার দোষ কি?
তার ব্যাগ ভাবী গুছিয়েছিল- ব্যাগ গোছাতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল? আশ্চর্য! বিশ্বাস করা কঠিন- সে ধরাও পড়তে পারত পুটলিসুদ্ধ ব্যাগ নিয়ে। অসম্ভব! এটা হয় কী করে?
এখনও কানে বাজছে ভাবীর কণ্ঠ : আমার খুব সাধ- আপনার সাথে একটা সম্পর্ক করি। আপনি ত আমাদের দেখলেন- যদি আপত্তি না থাকে আপনার-
হাসতে হাসতে বলছিল ভাবী- তার সেই হাসি মুখ- পেছনে আরেক মুখ গভীরতর স্বপ্নমগ্নতার ছায়া হয়ে সারাক্ষণ দুলেছে আমানের চোখে। এখন সেই স্বপ্নছায়া অবিকৃত থাকছে না- ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হচ্ছে বীভৎস ভয়াল ক্রুরতায়- এক সর্বনাশা সম্পর্কহীনতায়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।