পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
আড়াই হাজার বছরের পুরোনো মহাস্থানগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। নির্দেশনা ছিল পুরাকীর্তি বিনষ্টের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করার। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষার জন্য কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছেÑ তা জানাতে বগুড়া জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং মহাস্থানগড় মাজার উন্নয়ন কমিটির সভাপতি সশরীরে আদালতে হাজিরাও দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে হাইকোর্ট আরও কিছু আদেশ দেন। কিন্তু গত ১১ বছরেও উচ্চ আদালতের এ আদেশ প্রতিপালিত হয়নি। আদালত অবমাননা মামলায় অভিযোগ ছিল, হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মহাস্থানগড় মাজার কমিটি প্রাচীন এ নির্দশনস্থলে খোঁড়াখুঁড়ি করছিল।
রেসকোর্স ময়দান (হালের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান এবং বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দানের স্থানসহ উদ্যানের ৭টি ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণের আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এছাড়া একাধিক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে এ উদ্যানের বৃক্ষ নিধন বন্ধের নির্দেশনাও ছিল। উচ্চ আদালতের আদেশ অগ্রাহ্য করে গণপূর্ত বিভাগ উদ্যানে রেস্টুরেন্ট নির্মাণের লক্ষ্যে গাছ কাটে। এ ঘটনায় গতবছর আদালত অবমাননার মামলা করে মানবাধিকার এবং পরিবেশবাদী সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’। মামলায় ২০০৯ সালের রায় উল্লেখ করে বলা হয়, উদ্যানটির ঐতিহাসিক ও পরিবেশগত ঐতিহ্য রয়েছে। দেশের সব গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্র এই এলাকা। ফলে সম্পূর্ণ এলাকাটি একটি বিশেষ এলাকা হিসাবে সংরক্ষণের দাবি রাখে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ, গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো: শামীম আকতার এবং স্থাপত্য অধিদফতরের প্রধান স্থপতি মীর মঞ্জরুর রহমান মামলার বিবাদী।
একটি দু’টি নয়। এ রকম ‘আদালত অবমাননা’র ঘটনা রয়েছে ভুরিভুরি। এসবের পরিপ্রক্ষিতে দায়ের করা মামলার রায়ও রয়েছে অসংখ্য। কিন্তু কোনো রায়ই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কার্যকর হচ্ছে না রায়ে বিবাদীপক্ষকে দেয়া নির্দেশিত শাস্তি। ফলে নিশ্চিত হচ্ছে না আইনের শাসন। আইনজ্ঞরা বলছেন, আদালত অবমাননার রায় বাস্তবায়ন না করার এই প্রবণতা আইনের শাসন প্রশ্নে অত্যন্ত বিপজ্জনক।
তারা জানান, আইনের রক্ষক হচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টকে বলা হয়েছে ‘কোর্ট অব রেকর্ড’। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘সুপ্রিম কোর্ট একটি ‘কোর্ট অব রেকর্ড’ হইবে এবং ইহার অবমাননার জন্য তদন্তের আদেশ দান বা দণ্ডাদেশ দান বা দণ্ডাদেশ দানের ক্ষমতাসহ আইন-সাপেক্ষে অনুরূপ আদালতের সকল ক্ষমতার অধিকারী থাকিবেন।’
সংবিধানের এই এখতিয়ার বলে সংক্ষুব্ধদের মামলার প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট আদালত বিবাদীদের প্রতি অবমাননার আদেশ দেন। আদালত অবমাননাবিষয়ক ১৯২৬ সালের একটি আইন রয়েছে। এই আইন রহিত করে ২০১৩ সালে আরেকটি ‘আদালত অবমাননা আইন’ করা হয়। কিন্তু পরের আইনটি হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করে। যদিও এই বাতিল আদেশের বিরুদ্ধে সরকারপক্ষ আপিল করে রেখেছে। এ প্রশ্নে অধিকাংশ আইনজ্ঞ মনে করেন, পরের আইনটি অবৈধ ঘোষিত হওয়ায় আগের আইনটি (আদালত অবমাননা আইন-১৯২৬) এখন বহাল রয়েছে। আদালত অবমাননার শাস্তি বিদ্যমান আইন দ্বারাই নিশ্চিত করা সম্ভব।
আইনজ্ঞদের মতে, উভয় আইনেই আদালত অবমনাননার সংজ্ঞা অভিন্ন। আইনানুসারে আদালতের আদেশ, নির্দেশ এবং আদালতের মর্যাদা সম্পর্কে অবমাননা করাকে ‘আদালত অবমাননা’ বলা হয়। আদালত বা বিচারককে কটূক্তি বা মর্যাদাহানিকর উক্তি বা লিখিত বক্তব্য উত্থাপন করার মধ্য দিয়েও আদালতের অবমাননা করা হয়। আদালত চলাকালে বা আদালতের বাইরেও আদালত অবমাননার অপরাধ হতে পারে। ‘আদালত অবমাননা’ বলতে দেওয়ানি অবমাননা এবং ফৌজদারি অবমাননা উভয়টিকেই বোঝাতে হতে পারে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৮০নং ধারা অনুসারে কোনো দেওয়ানি, ফৌজদারি ও রাজস্ব আদালতের উপস্থিতিতে দণ্ডবিধির ১৭৫ ধারা অনুসারে আইনে দলিল দাখিল করতে বাধ্য এমন কোনো ব্যক্তি দলিল দাখিলে অবহেলা করে, ১৭৮ অনুসারে আইনত : শপথ নিতে বাধ্য; কিন্তু শপথগ্রহণ না করলে, ১৭৯ অনুসারে আইনত উত্তর দিতে বাধ্য এমন কোনো ব্যক্তি যদি উত্তর না দিয়ে সত্য গোপন করে, ১৮০ অনুসারে আইনত প্রযোজ্য অথচ কোনো ব্যক্তি যদি বিবরণ দিয়ে তা স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে, ২২৮ অনুসারে বিচারিক কাজে নিয়োজিত থাকাকালে কেউ যদি ইচ্ছে করে আদালত অবমাননা করে বা কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে, আদালত তখন সঙ্গে সঙ্গেই অপরাধীকে আটক করতে পারবেন। ওই অধিবেশনেই অপরাধ আমলে নিতে পারবেন এবং অপরাধীকে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড দিতে পারবেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৮০ ধারায় অবমাননাকারী এজলাসে উপস্থিত থাকলে আদালত এজলাস কক্ষ ত্যাগ না করে এক অধিবেশনেই উক্ত অপরাধ আমলে নেবেন এবং বিচার সমাপ্ত করবেন।
আদালত অবমাননার এই ব্যাপক বিস্তৃত সংজ্ঞা এবং এখতিয়ার থাকলেও আদালতের ভেতর এবং বাইরে অহরহই হচ্ছে আদালত অবমাননা। এ অভিযোগে মামলাও দায়ের হচ্ছে অনেক। মামলা দায়ের হলে বিবাদীদের প্রতি রুল জারি করেন হাইকোর্ট। জবাব না এলে সেই রুল পরবর্তীতে ‘চূড়ান্ত’ করা হয়। বিবাদীদের দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ডাদেশ দেয়া হয়। প্রশ্ন হচ্ছেÑ আদালত অবমাননার এই রায় মানছে কে?
আদালত অবমাননা মামলা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, আদালত অবমাননা মামলার রায় বাস্তবায়ন না করার প্রবণতা উদ্বেগজনক। বিশেষ করে গত এক দশকে আদালত অবমাননা মামলার রায় কার্যকর হয়েছেÑ এমন দৃষ্টান্ত বিরল। উচ্চ আদালতে কি পরিমাণ আদালত অবমাননার মামলা রয়েছেÑ সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার জেনারেল দফতরের একটি সূত্র জানায়, বিভিন্ন পর্যায়ে আদালত অবমাননা মামলার সংখ্যা ৩৫ হাজারের কম নয়। এ সংখ্যা দিন কে দিন বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে আদালত অবমাননা মামলার রায় বাস্তবায়ন না করার প্রবণতাও।
আইনজীবীরা, প্রায় সব আদালত অবমাননার মামলার বিবাদীরা হচ্ছেন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, সরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা কিংবা প্রধান নির্বাহী। আদালত অবমাননার মামলা দায়েরের আগে হুঁশিয়ারি দিয়ে প্রথম ধাপে আইনজীবীরা লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। নোটিশ অনুযায়ী প্রতিকার না পেলে মামলা ফাইল করা হয়। উচ্চ আদালত মামলার শুনানি গ্রহণ বিবাদীদের প্রতি রুল জারি করেন। রুলের বিষয়ে বিবাদীদের কাছে নোটিশ যায়। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, নোটিশ পেয়ে বিবাদীরা নির্বিকার থাকছেন। উচ্চ আদালতের রুলের বিষয়ে থাকেন ভ্রুক্ষেপহীন। বিবাদীরা আদালতে তাদের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দিলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জবাব দাখিল করেন না। কালক্ষেপণের কূটকৌশল হিসেবে জবাব প্রদানের জন্য বারবার আদালতের কাছে সময় নেন। এতে অবমাননার মামলাগুলো দীর্ঘসূত্রিতায় পর্যবসিত হয়। আদালত ৪ সপ্তাহ থেকে ৮ সপ্তাহ সময় বেঁধে দিলেও মাসের পর মাস রুলের জবাব আসে না। মামলার শুনানি হয় না। দীর্ঘ সময় পর রুলের শুনানি শেষে রায় দেন আদালত। সেই রায় বাস্তবায়ন নিয়ে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে তুচ্ছতাচ্ছিল্য।
আইনজীবীরা জানান, রুলের বিবাদীরা সরকারের প্রভাবশালী পদস্থ কর্মকর্তা। তারা উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি তারা দেখাচ্ছেন দারুণ অবজ্ঞা। চরম অশ্রদ্ধা দেখালেও আদালতকেও অবমাননাকারীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে দেখা যায় না। বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে ‘আইনের শাসনের জন্য বিপজ্জনক’ বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, গত ৭/৮ বছর ধরে সরকারি দফতরের কর্মকর্তারা আদালত অবমাননার রায়ের কোনো আদেশ মানছেন না। শত শত মামলার রায় পড়ে রয়েছে। রায় হলেও বিবাদীদের শাস্তি হচ্ছে না। করোনাকালীন স্বাস্থ্য সেবা খাত, পরিবেশ দূষণ, বায়ু ও শব্দদূষণ, ওষুধের মূল্য, নিরাপদ সড়ক, সাগর-রুনী হত্যা মামলাসহ অন্তত : ২০টি আদালত অবমাননা মামলার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি বলেন, বিচার বিভাগের দুর্বলতা এখানেই। আদালত অবমাননা মামলার রায়ে যদি কাজই না হয়, তাহলে এমন বিধান এবং আইন রেখে লাভ কি? আদেশ অমান্যের শাস্তি না হলে অপরাধ বাড়ে। শাস্তি না হলে অপরাধীরা ভয় পায় না। অপরাধও নিয়ন্ত্রণ রাখা যায় না। অপরাধের যদি শাস্তিই না হবেÑ মানুষ ভয় পাবে কেন? তিনি বলেন, আইন অমান্যের প্রবণতা মানুষের মাঝে বেশি। এটি মানুষের বৈশিষ্ট্য। বহু বছর ধরে আদালতের হাতে থাকা আদালত অবমাননার হাতিয়ারটির শক্ত প্রয়োগ হচ্ছে না। রায়গুলো কাগুজে বাঘ হয়ে থাকছে। শত শত কোর্ট কনটেম্পট হয়ে আছে। কোনো প্রতিকার নেই।
বহু আদালত অবমনাননা মামলার এই আইনজীবী শঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, এতে সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি আদালতের বিবেচনা করা উচিত। আদালত যদি এ বিষয়ে ‘রিল্যাক্টিং’ থাকে তাহলে আইনের শাসনের যে স্পিড সেটি দুর্বল হয়ে পড়বে। আদালতের অবস্থান দুর্বল হলে আইনের শাসনও দুর্বল হয়ে পড়বে। আদেশ মানতে কঠোরভাবে বাধ্য না করা না হলে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। আর এর চূড়ান্ত দায়টি এসে পড়বে রাষ্ট্রের ওপর। তবে রায় কার্যকর করার উদ্যোগটি যদি সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকেও নেয়া হয়Ñ তাতে হয়তো আদালত অবমাননা মামলার হার কমে আসবেÑ যুক্ত করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।