Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তিস্তার ধু-ধু বালুচরে এখন সবুজের সমারোহ

রবিশস্য চাষে রঙ্গিন স্বপ্ন দেখছেন চরাঞ্চলের কৃষকরা

রংপুর থেকে হালিম আনছারী | প্রকাশের সময় : ১৬ এপ্রিল, ২০২২, ৭:১৭ পিএম

প্রমত্তা তিস্তার ধু-ধু বালুচরে এখন সবুজের সমারোহ। যতদুর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। রুপালী চর এখন সবুজে ঢেকে গেছে। চাষাবাদ হচ্ছে ভুট্টা, বাদাম, পেঁয়াজ, মরিচ, মিষ্টি কুমড়া, তিল, কাউনসহ বিভিন্ন প্রকার রবিশস্য। এসব রবিশস্য চাষে রঙিন স্বপ্ন দেখছেন তিস্তা পাড়ের কৃষকরা। প্রায় প্রতিটি ফসলের ভালো ফলন হওয়ায় বিগত দিনের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত কৃষকরা।

সরেজমিন তিস্তা নদীর বিভিন্ন চর এলাকা ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জনা গেছে, গত বর্ষা মৌসুমে তিস্তার চরে আমন ধান চাষ হয়নি। আমনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এলাকার চাষিরা তিস্তার চরে বিভিন্ন ধরনের রবিশস্য চাষ করেছেন। আবহাওয়া ভালো থাকায় কমবেশি সবখানেই প্রতিটি রবিশস্যের ফলন ভালো হয়েছে। কৃষকরা জানান, ধান, গম চাষ করলে যে লাভ হয়, এর চেয়ে দ্বিগুণ লাভ হয় রবিশস্যে। বিশেষ করে ভুট্টা চাষে বেশ লাভবান হচ্ছেন তারা। প্রতি বিঘায় ৪০ থেকে ৪৫ মণ পর্যন্ত ভুট্টা হয়। যার মূল্য প্রায় ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা। আর ব্যয় হয় বিঘা প্রতি ১০-১২ হাজার টাকা। ভুট্টা ঘরে তোলার সময় পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সব ভুট্টাচাষি বেশ লাভবান হবেন। তারা আরও জানান, আগে তিস্তার চরাঞ্চলগুলো পতিত ছিল। অন্য ফসলের আশানুরূপ ফলন না হওয়ায় এসব জমিতে ফসল ফলানো হয়নি। এখন আধুনিক পদ্ধতিতে এসব চরে নানামুখী রবিশস্য চাষ করা হচ্ছে। এতে ভালো ফলন এবং দামও পাওয়া যাচ্ছে।

রংপুর ছাড়াও পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট এবং নীলফামারী জেলার বিভিন্ন উপজেলার নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলগুলোও ঘুরে একই দৃশ্য দেখা গেছে। চরাঞ্চলের কোথাও এতটুকু পতিত জমি নেই। সর্বত্রই কোন না কোন ফসল ফলানো হচ্ছে। আর এ কারণেই চরাঞ্চল এখন সবুজে ছেয়ে গেছে।

গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তিস্তার চরাঞ্চলগুলোতেও এ বছর রবিশস্যের ব্যাপক চাষ হয়েছে। পরিবেশ অনুকূলে থাকায় এই উপজেলার প্রতিটি চরাঞ্চলেও বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬টি ইউনিয়ন নদী বিধ্বস্ত। এই ৬টি ইউনিয়নের চরাঞ্চলের কৃষকরা তাদের জমা-জমিতে বিভিন্ন প্রকার রবি শস্যের চাষ করেছেন। রবি শস্যকে ঘিরে নদী গর্ভে নিঃস্ব হওয়া হাজার হাজার মানুষ এখন নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন । উপজেলা কৃষি অফিস জানিয়েছে, তিস্তার করাল গ্রাসে হাজার হাজার মানুষ আবাদী জমি, বসতবাড়ী হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। এই নিঃস্ব পরিবার গুলো বাঁচার তাগিদে তাদের বংশীয় ঐতিহ্য ত্যাগ করে রিকসা, ভ্যান চালনা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে বিভিন্নভাবে শ্রম বিক্রি করে চলেছে। তিস্তার নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় জেগে উঠা ছোট বড় চরগুলো তাদের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এসব চরে ্অনেকেই এখন রবি শস্য চাষ করে জীবিকার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছেন। এক্ষেত্রে এসব চাষীদের বিনামুল্যে সার-বীজ দিয়ে সহায়তাও করা হয়েছে। গত বন্যায় আমন ক্ষেত নষ্ট হওয়ায় যে সমস্ত জমি পতিত ছিল সেগুলোতে আগাম জাতের রবিশস্য চাষ করতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। কৃষকরাও উদ্বুদ্ধ হয়ে আগাম জাতের বিভিন্ন রবিশস্য চাষ করে বেশ লাভবান হয়েছেন। কৃষি বিভাগ আরও জানিয়েছে, তিস্তার বুক চিরে জেগে ওঠা চরগুলোতে পলি মিশ্রিত মাটি থাকায় এগুলোতে ভুট্টা, কাউন, মিষ্টি কুমড়া, বাদাম, মিষ্টি আলুর ফলন বেশ ভালো হওয়ায় কৃষকরা এসবের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। কম খরচে অধিক ফলন পাওয়ায় এবং লাভজনক হওয়ায় ভুট্টা আবাদের দিকেই বেশি ঝুঁকছেন কৃষকরা। ভুট্টার পর এসব জমিতে তোষা পাট লাগানো হচ্ছে। উপজেলা কৃষি অফিসার জানিয়েছেন এখানকার রবি শস্যের প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ ভাগই চরাঞ্চলে চাষ হচ্ছে। কৃষকের হাতে উপযুক্ত সময়ে কৃষি উপকরণ ও পরামর্শ পাওয়ার কারণে লাভজনক আবাদ ভুট্টার চাষ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।

লালমনিরহাট কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, 'জেলার প্রায় ৪৫ হাজার কৃষক ভুট্টা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। বিশেষ করে চরের কৃষকরা বেশি লাভবান হচ্ছেন ভুট্টা, কাউন, মিষ্টি কুমড়া ও বাদাম চাষে। এসব রবিশস্য চাষে তেমন খরচ নেই। অল্প খরচে অধিক ফলন পাওয়ায় এসব রবিশস্য চাষে ঝুঁকে পড়েছেন চরাঞ্চলের কৃষকরা।

নীলফামারী জেলার ডিমলা এবং রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলগুলো ঘুরেও একই দৃশ্য দেখা গেছে। সরেজমিনে এসব চরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, তিস্তা নদীর বুক চিরে জেগে ওঠা হাজার হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের রবি শস্য চাষ করা হয়েছে। কোথাও এতটুকু জমি পতিত নেই। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের সাথে নুড়ি পাথর, কাকনযুক্ত বালি ও মাটি বয়ে আসায় দ্রুত তিস্তার তলদেশ ভরাট হয়ে গিয়ে অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। বালুর সাথে পলি মাটির স্তর পড়ে এসব চরকে আবাদী করে তুলছে। পলি মিশ্রিত এসব চরে ভুট্টা, কাউন, মিষ্টি কুমড়া, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, বরবটি, মিষ্টি আলু, বাদাম, করলা, বেগুন, পুঁই শাক, লাউ শাকসহ বিভিন্ন রবিশস্য চাষের ধুম পড়ে গেছে। বর্ষা মওসুমের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এসব চরে রবিশস্য চাষে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন চরাঞ্চলের কৃষকরা। আর তাই যতদুর চোখ যায় এসব চরাঞ্চল শুধু সবুজ আর সবুজ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ