Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রমজান : সাদরে বরণ করে নিতে আমি কতটুকু প্রস্তুত?

মুন্সি আব্দুল কাদির | প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০১ এএম

এগার মাস শেষে সকল অপেক্ষার পালা শেষে মাহে রমজান আমাদের খুব নিকটে। রহজানের হিমেল বারতা মাহে সাবানের চাঁদ জানান দিচ্ছে। মাস দিন ঘন্টা মিনিট পেরিয়ে মাহে রমজান তার রমতের খাজানা, ক্ষমার ঘোষনা, নাজাতের গ্যারান্টি নিয়ে এগিয়ে আসছে। সেতো কোন অজানা অচেনা স্থান থেকে এগিয়ে আসছে না। যিনি আমার আপনার স্রষ্টা, মালিক, রব, সবকিছুর মালিক, যার দয়ার কোন সীমা আমি আন্দাজ করতে অপারগ, যাকে নিয়ে ভেবে কুল কিনারা পাওয়া কারো সাধ্যের বাইরে, যার দান আর দয়া পেয়ে সবায় ধন্য এমন আলিশান রাজাধিরাজের দরবার থেকে আমাদের উপহার, পুরস্কার আর রহমত-ক্ষমা-নাজাতের বারতা নিয়ে সে আসছে।

সেতো এগিয়ে আসছে আমাদের সঞ্চিত এগার মাসের পাপ পংকিলতা থেকে মুক্ত করে আমার দেহ আর মন পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে, আমার বেশভুষা ঠিক ঠাক করে দরবারে আলিশানের উপযুক্ত করে জান্নাতের চির শান্তির জায়গায় পৌছার উপযোগী করে তুলতে। তার কত আশা যে সে এক্ষেত্রে সফল হবেই। সেতো জানে আমরা আশরাফুল মাখলুকাত। সকল সৃষ্টিকে কেবল এই মানুষের উপকার করার জন্য, তার খেদমত আঞ্জাম দেওয়ার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। রমজান সে তো রমজানের প্রয়োজন নেই। গাছ পালা, তরুলতা, পশুপাখি, পাহাড় পর্বত, নদী সাগর মহাসাগর, প্রাণীকুল, পৃথিবী-মহাকাশ কারোরইতো রমজানের প্রয়োজন নেই। মহান রবের সৃষ্টিজগতের কারোর এমনকি ফেরেস্তাদেরও রমজানের প্রয়োজন নেই। সে আসে কেবল আমার জন্য। তার আসা যাওয়া কেবল আমাকে কেন্দ্র করেই। তার আসা আমাকে আনন্দিত করে। তার যাওয়া আমাকে মুক্তির বারতা দেয়। সে চলে যাওয়ার পর আবার তার ফিরে আসার মাস দিন গগনা শুরু হয়। তাকে আমি হারাতে চাই না।

রমজান রহমতের বর সেঁজে আগুয়ান। বর কে গ্রহণ করার জন্য আমি কত কিছু করি; ফুলেল সাঁজে সাজানো গেইট, লালগালিচা বিছানো পথ, ফুলের মালায় জড়ানো সংবর্ধনা, কত জাত পদের মেহমানদারী। আরো কত কি! প্রত্যেকটি প্রস্তুতির নিবিড় পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা, তদারকি। কোন ঘাটতি আর ত্রæটি যেন না হয়। ত্রæটি হলে কত মানুষের কত কথা শোনতে হবে। কত সমালোচনা সয়ে যেতে হবে। বরের বাড়ির কত খোটা মেয়েকে সইতে হবে। কত চিন্তা আর পেরেশানী। রমজান নামক এই মহান বর আগুয়ান। কই আমার প্রস্তুতি, কই আমার চিন্তা।
কোন অনুষ্ঠানের আগে আয়োজকদের প্রস্তুতি যত ভাল হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা তত সুন্দর হয়। আবার আয়োজন যতই ভাল হোক। পরিচালন ব্যর্থতার জন্যও অনুষ্ঠান পন্ড হয়ে যায়। যার আয়োজন তত সুষ্ঠ তার পরিচালন সফলতার জন্যও পূর্ব প্রস্তুতি ভাল থাকে, আশানুরূপ থাকে। আয়োজনে যার ত্রুটি রয়েছে। আয়োজনে যে ভালভাবে খেয়াল দিতে পারেনি, তার পরিচালন ত্রুটি থাকাটাই স্বাভাবিক। আমার রমজান নামক মাস ব্যাপি অনুষ্ঠান সফলতার জন্য আমার প্রস্তুতি কত টুকু। পুরো রমজান সুষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্যই বা আমার পরিকল্পনা, আয়োজন, সিদ্ধান্ত, সফলতার আশা কতটুকু।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যাঁকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সারা জাহানের রহমত হিসেবে পাঠিয়েছেন। যাঁর উপর মহান মালিক নিজে দরুদ সালাম পেশ করেন। যাঁর উপর আল্লাহ তায়ালা কোরআনুল কারীম নাযিল করেছেন। তিনি মাহে রজব থেকে রমজানের প্রস্তুতি নিতেন। মাওলার কাছে দোয়া করতেন। সাবান মাসে রোজার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে সবচেয়ে বেশি নফল রোজা রাখতেন। এই পেয়ারা হাবীবের মাহে রমজানের প্রস্তুতি কি আমাদের অন্তরে নাড়া দেয় না! তাঁর আহবানে আমার মন কি সাড়া দিতে চায় না!
আমার মনের সাথে আমার দেমাগ দিয়ে একটু বুঝাপড়া আমার করে নিতে হবে, করা চাই। আমার মনের সাথে রবের যোগাযোগ নিথর। ভাল কাজে আমার মন সায় দিতে চায় না। একটু সায় দিলেও পাপিষ্ঠ আত্মার দুরন্তপনায় আমি থেমে যাই, আমার ভাল চিন্তাগুলো হারিয়ে যায়। হ্যাঁ আমার এই দুর্ভাবনা দুর করার জন্য রমজান আসছে। রমজান আল্লাহর প্রিয়দের আরোও প্রিয় বানাতে, আমার মত অধমকে পাপ পথে চলা থামিয়ে ভাল পথে চলা শুরু করাতে এই রমজান আসছে।

রমজানে শয়তান বন্দি হয়ে যায়। কারণ আমি অধম যেন দুটি শত্রæর সাথে যুদ্ধ করতে না হয়। আমার মাওলা চান আমার পাপিষ্ঠ আত্মাকে আমি যেন লড়াই করে পরাভুত করে দেই। আমি যদি লড়াইয়ে নেমে যাই তবে আমার মহান মালিক আমার পাশেই থাকবেন। আমাকে সাহায্য করবেন। কারণ একমাত্র আমার বিজয় লাভের জন্যই শয়তানকে বন্দি করে দিয়েছেন। তিনি চান আমি যেন হেরে না যাই। আমি যেন এই রমজানে আমার পাপত্মাকে, আমার নাফসকে পরাজিত করতে পারি। শয়তানের বসবাসের স্থানকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে পারি। আমার মহান রবের প্রেম ভালবাসা যেন এই মনের মনিকোঠায় স্থান করে নেয়। আমার রবকে যদি আমার মনে স্থান করে দেই, বলুন কার এমন সাধ্য যে আমার উপর আক্রমণ চালাতে পারে।

হ্যাঁ প্রিয় ভাই, যুদ্ধে নামার আগে যুদ্ধের সামান যোগাড় করতে হয়ে। অস্ত্র কিনতে হয়, সংগ্রহ করতে হয়। বন্দুক, গোলা, ট্যাংক, যুদ্ধ বিমান, বোমা, ড্রোন সংগ্রহ করতে হয়। এগুলো পরিচালনার জন্য আগেই ট্রেনিং নিতে হয়। নিবেদিত প্রাণ সৈন্যের প্রয়োজন হয়। সকল দুর্বলতা যাচাই করে, দুর্বলতার সকল পথ বন্ধ করে সামনে আগাতে হয়। সব সময় খুব সজাগ থাকতে হয়। আমার পাপাত্মার, আমার নাফসের সাথে যুদ্ধ করার জন্য আমি কি সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে পেরেছি:

১. আমি আল্লাহর আদেশ নিষেধ, হালাল হারাম, ফরজ, ওয়াজিব সুন্নাত সম্পর্কে জানি কি না। অথবা এগুলো জানার, মানার জন্য আমার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি কি না?

২. আমি যতগুলো গুনাহের কাজে লিপ্ত, চিন্তা করে করে তার কোন তালিকা কি আমি প্রস্তুত করতে পেরেছি। এমন এগুলো ছেড়ে দেওয়ার পথ পদ্ধতি, সিদ্ধান্ত কি আমি নিতে পেরেছি?

৩. আমি যে রিজিক খেয়ে জীবন যাপন করি। আমি কি জেনে, চিন্তা করে দেখেছি, এই রিজিকগুলো হালাল কি না? আমার রোজগারের পথে কি কি হারাম উপাদান রয়েছে এবং এগুলো বর্জন করার পথ পদ্ধতি তালাশে আমি মনোযোগ দিতে পেরেছি কি না? আমার রোজগারের পথে হারাম কিছু থাকলে তা বর্জনের অথবা পেশা পরিবর্তনের কোন চিন্তা করতে পেরেছি কি না?

৪. অথবা আমার চাকুরী বা ব্যবসা হালাল। আমার কোন হেয়ালীপনায় বা আমার না জানার কারনে আমার রোজগারে কোন হারাম পথ পদ্ধতি প্রবেশ করে কি না। আমার রোজগারে হারাম বর্জনে আমি পাহারাদার কি না?
৫. সবকিছু জানার জন্য আমি কোরআন অধ্যয়ন করি কি না। আমার ঘরে সহজ সরল কোরআনুল কারীমের অনুবাদ আছে কি না? আমি কোরআনুল কারীম বুঝে পড়ি বা পড়ার চেষ্টা করি কি না?

৬. আমি ইসলামকে পরিপূর্ণ ভাবে জানা ও মানার তাগিদে হাদিস অধ্যয়নে সচেষ্ট কি না? আমার সংগ্রহে হাদিস গ্রন্থ বা গ্রন্থ সমূহ আছে কি না? এই রমজানের আগে আমি কোরানের কোন অনুবাদ, তাফসীরের অনুবাদ, হাদিসের অনুবাদ সংগ্রহে সচেষ্ট হয়েছি কি না?

৭. আমি যদি ইসলাম জানার জন্য ইউটিউভের দারস্ত হই। তবে আমি ভাল কিছুর পাশাপাশি শয়তানিরও দ্বারস্ত হব। আমার মধু সংগ্রহের চেষ্টায় কিছু বিষ ও মিশে যাবে। এতে উপকারের পরিবর্তে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি। শয়তান এখানে আমাকে পরাস্ত করে দেবে। আর এই বিষ মেশানো ইলমে আমার আমলের ভান্ডার খালিই থেকে যেতে পারে। আমার হয়তো জানা হবে কিন্তু মানা কঠিন হয়ে যাবে। বর্তমানে তাই যত জানা হয় তত মানা হয় না। জানার পথ পদ্ধতি ভিন্ন সহিহ নয়। তাই ইসলাম জানার জন্য কোরআনুল কারীম, তাফসিরুল কোরআন, হাদিসে রাসুল, ইসলামী সাহিত্য বই কিনে অধ্যয়নের চেষ্টা করি। এতে লাভবান বেশি হব।

৮. আমি এই রমজানে ভার্চুয়াল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলো বর্জনের সিদ্ধান্ত কি নিতে পেরেছি? দাওয়াতী প্রয়োজন বা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া, ফেসবুক, টুইটার, টিকটক, শেয়ারইট যে খানে বেহায়পনা আর উলঙ্গপনা সম্ভাবনা আছে এই সাইটগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত কি নিতে পেরেছি?

৯. আমার ঘরে যে টেলিভিশন নামক একটি যন্ত্র রয়েছে। তা কি আমি বন্ধ করতে পেরেছি। হ্যাঁ এখানে ভাল কিছু দেখা যায়। কিন্তু ভাল থেকে খারাপের সংখ্যা কি কম? একটু ভাবুন, আমি ভাবি। কোনটি আমার উপকার। আমি উপকার গ্রহণ করি। ক্ষতিকর দেখা বন্ধ করি।

১০. সামনে রমজান, অফিস থেকে আগেই চলে আসব। অবসর বেশি। এই সময়ে শয়তান আগ থেকে পাপের কিছু অতিরিক্ত পথ জারি করে বন্দি হয়। এই সময়ে খেলা একটু বেশি থাকে। শয়তান আমাকে আটকে রাখার ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছে। আমি কি খেলা দেখার জন্য রমজানের আগ থেকেই অপেক্ষমান। না কি খেলা দেখা বর্জনে বদ্ধপরিকর?

১১. আলেম সমাজের মধ্যে এই রমজানে তারাবিহের নামাজ আদায়ের পদ্ধতি বা অন্য কোন ছোট খাট বিষয়ে মাসয়ালা মাসায়েলেরর মতবিরোধ দেখা দেয় এবং এ বিষয়ে একে অপরে দোষারুপ, কাদা ছুরাছুরি এমন কি গালাগালি লাঠালাঠি শুরু হয়। আমরা সাধারণ মানুষও এতে জড়িয়ে পড়ি। বিভিন্ন দলে বিভক্ত হই। এটা শয়তানের রমজান ব্যর্থ করে দেওয়ার একটি অপকৌশল। শয়তান রমজান আসার আগেই এই কাজটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেরে নেয় এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের এই কাজে নিয়োগ দেয়। যে সমস্ত আলেমগন এই কাজে লিপ্ত হয় আল্লাহ তাদেরকে বুঝ দান করুন। আমরা সাধারণ মানুষ যেন এই দলাদলিদে যুক্ত হয়ে রমজানকে বরবাদ না করে দেই আমি কি এই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি?

হ্যাঁ প্রিয় ভাই, উপরে আলোচনা সবগুলোই আমার এক একটি অস্ত্র। এগুলো সংগ্রহ করা এবং দোষ নামক ত্রæটিগুলো ছেড়ে দেওয়া আমার দায়িত্ব। আমি কি রমজানকে সাদরে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিছু কিছু সিদ্ধান্ত কি আমি এখন থেকে নিতে পেরেছি? কিছু কাজ কি এখন থেকেই বর্জন করতে পেরেছি? কিছু অভ্যাস কি এখন থেকেই গ্রহণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি? সিদ্ধান্ত আমার, আমাকে আমার পথ বেছে নিতে হবে, আমাকেই আমার পথে চলতে হবে। তবে মাহে রমজানের রহমত, বরকত, ক্ষমা, নাজাত পেয়ে আমি ধন্য হতে পারব।

লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক, প্রাবান্ধিক।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রমজান


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ