Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ২৭ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

কুয়াকাটা ভাঙন রোধে ১,২১১ কোটি টাকার প্রকল্প-প্রস্তাবটি কয়েক দফা সংশোধন ও ব্যয় বৃদ্ধির পরে পরিকল্পনা কমিশনে গেল

কালক্ষেপণ পরিহার করে দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ৯ এপ্রিল, ২০২২, ৯:৩১ এএম

পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার প্রায় ১২ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ-এর ছোবল থেকে রক্ষায় ১ হাজার ২১১ কোটি ১৩ লাখ টাকার ‘উন্নয়ন প্রকল্প-প্রস্তাবনা-ডিপিপি’ তিন দফায় পর্যবেক্ষন ও সংশোধনের পরে পরিকল্পনা কমিশনে গেল। প্রকল্পটি নিয়ে পরিকল্পানা কমিশনের ‘প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি’ এবং ‘কারিগড়ি মূল্যায়ন কমিটি’র যাচাই বাছাই ও পর্যবেক্ষনের পরে তা কবে নাগাদ একনেক-এর সভায় উঠবে তা এখনো অজ্ঞাত। তবে বঙ্গোপসাগরের ভাঙন কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্রটিকে বিপন্ন করে তুলেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী সব সময়ই কুয়াকাটার সম্পর্কে খোজ খবর রাখেন বলেও জানা গেছে। পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী ইতোমধ্যে দু দফায় কুয়াকাটা ভাঙন পরিস্থিতি সরেজমিনে পর্যবেক্ষন করেছেন।

মন্ত্রীর নির্দেশে গত বছর অক্টোবরে ‘কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকত রক্ষা ও উন্নয়ন প্রকল্প’টি কয়েক দফা সংশোধনের পরে পানি সম্পদ মন্ত্রনাপলয়ে দাখিল করা হয়। মন্ত্রনালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে গত ১ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত এক সভায় একটি শিশু বিনোদন পার্ক এবং গঙ্গামতির চর ও জিরো পয়েন্টে দুটি সিকিউরিট স্টেশন সহ আরো কিছু বিষয় অন্তভর্’ক্ত করতে ডিপিটি ফেরত দেয়ার পরে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে পুনরায় পানি উন্নয়ন বোর্ডে দাখিল করা হয়। কিন্তু ১ হাজার ২০৬ কোটি টাকার এ সংক্রান্ত ডিপিপি’টি পুনরায় সংশোধন করে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে জমা দেয়া হলেও পরবর্তিতে আরো দুফায় তা সংশোধনের নির্দেশ দেয়ায় সর্বশেষ জানুয়ারী মাসে তা বোর্ডে জমা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এর পরেও নানা কালক্ষেপনের পরে পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের চুড়ান্ত অনুমোদনের পরে গত মাসের শেষভাগে ডিপিপি’টি পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্যর কাছে পাঠান হয়েছে বলে জানা গেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের পর্যবেক্ষন অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরের আঘাতে বিপর্যস্ত পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটকে রক্ষায় আগের ডিপিপি সংশোধন করে সাড়ে ৯শ কোটি থেকে এখন ১ হাজার ২১১ কোটি ৩৩ লাখ ৩৮ হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছে। তবে তারও আগে মূল প্রকল্পব্যায় ধরা হয়েছিল ৬৪৫ কোটি টাকা। প্রকল্প প্রস্তাবনায় আরো বেশ কয়েকটি বিষয় অন্তভর্’ক্ত করায় ব্যায় বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে পরিকল্পনা কমিশনের কাজের গতি অনুযায়ী সব কিছু যাচাই বাছাই সহ পর্যবেক্ষন সম্পন্ন করে চলতি অর্থ বছরে ডিপিপি’টি একনেক-এর সভায় উপস্থাপনই দুরুহ হতে পারে বলে জানিয়েছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি দায়িত্বশীল সূত্র। সে ক্ষেত্রে কুয়াকাটা ভাঙন রোধ ও উন্নয়ন প্রকল্পটি একনেক’এর চুড়ান্ত অনুমোদন শেষে আগামী অর্থ বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী-এডিপি’তে অন্তভর্’ক্তির সম্ভবনাও খুবই ক্ষীন বলে মনে করছে ওয়াকিবাহল মহল। ফলে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের ভাঙন রোধে বাস্তব কর্মকান্ড আরো পিছিয়ে যাবার সম্ভবনার আশংকার কথা জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্র। তবে সব কিছুই নির্ভর করছে পরিকল্পনা কমিশন ও পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় আমলাতান্ত্রিক কালক্ষেপন কতটা পরিহার করে তার ওপর।

প্রকৃতিক সৌন্দর্যের লিলাভ’মি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকেই সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। যা সারা বিশে^ই অনেকটা বিরল। প্রতিদিন পটুয়াখালীর সর্ব দক্ষিনে বঙ্গোপসাগর ও তার কোলের কুয়াকাটায় হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসছে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের বিরল দৃশ্য দেখতে। অত্যন্ত সম্ভবনাময় এ পর্যটন কেন্দ্রে গত দুই দশকে পর্যটক আবাসন সুবিধা সহ নানামুখি উন্নয়ন হলেও একটি পরিপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার প্রধান বাঁধা হয়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগরের ভাঙন।

এমনকি ২০০৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কুয়াকাটার হলিডে হোমেসে পর্যটন মন্ত্রনালয়ের এক মূল্যায়ন সভায় আরো একটি মোটেল নির্মান ছাড়াও বৌদ্ধ মন্দির সংস্কার ও আধুনিকায়নে অর্থ বরাদ্ব সহ পর্যটন কেন্দ্রটিকে ‘একান্ত পর্যটন এলাকা’ হিসেবে ঘোষনা করেছিলেন। এরআগে ১৯৯৬-এর জুনে এখানে পর্যটন করপোরেশনের প্রথম ‘হলিডে হোমস’এর নির্মান কাজ সম্পন্ন হয়। পরবর্তিতে মোটের নির্মান সম্পন্ন করে তা বানিজ্যিক পরিচালনও শুরু হয়েছে।
কিন্তু পর্যটন কেন্দ্রটির মুল অকর্ষন সী-বীচের পূর্বের রাবনাবাদ ও পশ্চিম প্রান্তের আন্ধারমানিক চ্যানেলের শ্রোত গতি পরিবর্তন করায় ঢেউ-এর আঘাতে ১৯৯৮ সাল থেকে এখানে বছরে এক মিটার করে সী বীচ বিলীন হতে শুরু হয়। বিষয়টি নিয়ে সে সময় পানি উন্নয়ন বোর্ড বা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের তরফ থেকে তেমন কোন উদ্বেগ ছিলনা।

২০১০ সাল থেকে ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড কিছু উদ্যোগ গ্রহন করলেও তা টেকসই হয়নি। অনেকটা অপরিকল্পিত ভাবে কয়েক দফায় জিও টিউব, জিও ব্যাগ ও সিসি বøক ফেলে মূল সী বীচটি সাগরের ঢেউ থেকে রক্ষার কোটি কোটি টাকা ব্যায়ের পরেও কোন ইতিবাচক ফল হয়নি।
তবে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশে গবেষনা প্রতিষ্ঠান ‘আইডবিøউএম’ সরেজমিনে এবং নেদারল্যান্ডের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে এ লক্ষে ব্যাপক সমিক্ষা সম্পাদনের মাধ্যমে নতুন নকশা প্রনয়ন করেছে। আইডবিøউএম-এর প্রস্তাবনায় কুয়াকাটা উপক’লীয় বণ্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ থেকে সী বীচ পর্যন্ত প্রায় ৭০টি গ্রোয়েনের মাধ্যমে ভাঙন রোধের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এলক্ষে মূল সী বীচ রক্ষায় দু প্রান্তের রাবনাবাদ ও আন্দামানিক চ্যানেল পর্যন্ত প্রায় ১১ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার এলাকায় সিসি বøকের সাহায্যে গ্রোয়েনগুলোতে জিও টেক্সটাইল-এর ওপর ৪৫ সেন্টিমিটার থেকে ১ মিটার সাইজের সিসি বøক সন্নিবেশের মাধ্যমে ভাঙন রোধে আশাবাদী পানি উন্নয়ন বোর্ড।

প্রকল্পের আওতায় পর্যটন আকর্ষন গড়ে তুলতে কুয়াকাটা সৈকতে ‘ওয়াকিং বে’ ছাড়াও পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য ‘লাইফ গার্ড স্টেশন’, বসার স্থান, ট্রইল, পার্কিং ল্যান্ডস্কেপ ও টয়লেট নির্মানের প্রস্তাব করা হলেও পরবর্তিতে বোর্ড থেকে সাড়ে ৯শ কোটি টাকার ডিপিপি’র ওপর পর্যবেক্ষন সহ পূণর্গঠনের নির্দেশ দেয় হয়। সে আলোকে কুয়াকাটা ভাঙন রোধের পাশাপাশি পর্যটন কেন্দ্রটিকে অকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে আরো কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে প্রকল্প ব্যায়ও সাড়ে ৯শ কোটি থেকে ১ হাজার ২০৬ কোটিতে উন্নীত হয়। পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সচিব সেখানে আরো একটি শিশু বিনোদন কেন্দ্র ও সিকিউরিট গার্ড স্টেশন নির্মানের নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে প্রকল্প ব্যায়ও এক হাজার ২১১ কোটি ৩৩ লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে।
ইতোমধ্যে পূণর্গঠনকৃত প্রকল্প-প্রস্তাবনায় কুয়াকাটা সৈকত সংলগ্ন উপক’লীয় বণ্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের ১২ কিলোমিটার বিটুমিনাস কার্পোটিং করে মেরিন ড্রাইভ রোডের আদলে সড়ক নির্মানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া বন বিভাগের ইকোপর্কের অভ্যন্তরে ৯শ মিটার ওয়াকিং সেল সহ ওয়াকওয়ে নির্মিত হবে ২.৬ কিলোমিটার। প্রকল্পের আওতায় গঙ্গামতির কাছে মেরিন ড্রাইভ রোডে দুটি নান্দনিক সেতুও নির্মিত হবে। যার একটি হবে ঝুলন্ত, অপরটি পিসি গার্ডার। নেদারল্যান্ডের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সহ প্রকল্পটির বাস্তবায়ন তদরকি করবে দেশীয় আধা সরকারী গবেষনা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘আইডবিøউএম’।
তবে বিভিন্ন মহল থেকে কুয়াকাটাকে বঙ্গোপসাগরের ছোবল থেকে রক্ষায় কালক্ষেপনের কোন সুযোগ নেই বলে দাবী করে যত দ্রæত সম্ভব প্রকল্পটি বাস্তবায়নের তাগিদ দেয়া হয়েছে। নচেত হতশ্রী কুয়াকাটার ক্ষত ক্রমে আরো বাড়বে বলে জানিয়ে অদুর ভবিষতেই তা হয়ত নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যেতে পাড়ে বলেও শংকা প্রকাশ করা হয়েছে।

তবে সরকার কুয়াকাটায় ভাঙন রোধে সহ একটি নিরাপদ ও আদর্শ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে খুবই আন্তরিক বলে জানিয়েছেন পানি ম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল (অবঃ) জাহিদ ফারুক শামিম। পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী ইতোমধ্যে দু দফায় কুয়াকাটা সফর করে সরেজমিনে ভাঙন রোধে সব ধরনের নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরিশাল জোনের প্রধান প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম সরকার। আগামী অর্থ বছরেই এ ভাঙন রোধ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বলেও জানান তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ