বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
হারুন-আর-রশিদ
১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত প্রকৃত গণতন্ত্র পাকিস্তানে ছিল না বিধায় বঙ্গবন্ধু তার দীর্ঘ জীবনে সংগ্রাম করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেন এবং বিজয় অর্জন করেন ১৯৭০ এর নির্বাচনে। ভূট্টো-ইয়াহিয়া গংদের ষড়যন্ত্রের কারণে গণতান্ত্রিকভাবে বিজয় অর্জন করেও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় যেতে পারেননি। সেই সূত্র ধরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করি। সুতরাং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পেছনে সক্রিয় শব্দটি ছিল গণতন্ত্র। গণতন্ত্র যখন বিজয়ীর বেশে তার অবস্থানে পৌঁছতে ব্যর্থ হয় তখন পরাজিত গণতন্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সেই বিদ্রোহের খোরাক জোগায় যারা গণতন্ত্রকে বিজয়ী আসনে অলংকৃত করেন তারা। এটাই হলো আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র বা উপাখ্যান। কৃত্রিম বা মেকি গণতন্ত্র এবং প্রকৃত গণতন্ত্রের মধ্যে যোজন দূরত্ব। ২০১৬ সালে আমরা দুটি বড় দলের কাউন্সিলরদের সমন্বয়ে এপ্রিল মাসে বিএনপি এবং অক্টোবর মাসে আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন দেখলাম। দুটি দলই তৃণমূল নেতাদের কথা বলে। কিন্তু নেতৃত্বের মূলধারায় তারেক জিয়া এবং সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে পরিবারতন্ত্র গঠনের তোড়জোরই বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে।
দল দুটিতে তৃণমূলের কর্তৃত্ব নেই। এক কথায় যার অর্থ দলের প্রধান দুই ব্যক্তির অঙ্গুলির নির্দেশেই কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সকল পদে নেতা নির্বাচন করা হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে ৮১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের মাত্র ২১টি পদে নেতা নির্বাচন করা হয়েছে। অবশিষ্ট ৬০ জনের নাম পরে ঘোষণা করা হবে বলে জানানো হয়। এতে বোঝা গেল, কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়নি। পরে নাম ঘোষণা করা হবেÑ এর অর্থ দাঁড়ায় দলের সভাপতির অনুমোদন সাপেক্ষে পছন্দনীয় ব্যক্তিদেরই কমিটিতে স্থান দেয়া হবে। এখানে কাউন্সিলর নয়, একজন ব্যক্তির অঙ্গুলি নির্দেশে দল পরিচালিত হচ্ছে। বিএনপিতেও চেয়ারপারসনের পছন্দনীয় ব্যক্তিরাই কমিটিতে স্থান পায়। দুটো দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকায় জাতীয় নির্বাচনে এর প্রতিফলন ঘটছে না। সে কারণেই যোগ্য নেতারা বেরিয়ে আসতে পারেন না। ফলে গণতন্ত্র বেহাল দশায় পতিত হয়। রক্তারক্তি, হানাহানি, অভ্যন্তরীণ কোন্দল দল দুটির মধ্যে চিরচেনা ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অবশ্যই একটি কথা বলতেই হবেÑ আওয়ামী লীগের এবারের সাধারণ সম্পাদক ওয়ায়দুল কাদের অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তি। একজন পরিশ্রমী মানুষ। সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি দৌড়ের ওপরই ছিলেন। এই মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন। কাজও করেছেন। তার ফলও দেশবাসী কিছুটা পেয়েছে। বড় দুটো দলের তৃণমূল কর্মীদের সরাসরি নির্বাচনে যদি সকল জেলা-উপজেলা-থানা পর্যায় এবং সর্বশেষে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কমিটি গঠিত হয় তাহলে বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রের আসল চিত্রটা দেখতে পেত। কৃত্রিম বা মেকি এবং পরিবারকেন্দ্রিক গণতন্ত্র বা উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জিত গণতন্ত্রে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে না।
কেন্দ্রীয়ভাবে রুটলেবেল থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে পরিশ্রমী নেতাদের বাছাই করে নেতৃত্বে আসন দিলে দেশের চেহারার পরিবর্তন করতে ৪৫ বছর প্রয়োজন পড়ে না। ১০ বছরেই দেশের আমূল পরিবর্তন সম্ভব। মালয়েশিয়ার মাহাথির বলেছিলেনÑ আমার দশজন মানুষ দরকার, যারা সৎ এবং কর্মনিষ্ঠ। তিনি এই দশজন লোক বাছাই করে নিতে পেরেছিলেন বলেই ২০ বছরে মালয়েশিয়ার মাথাপিছু আয় ২৭ হাজার ইউএস ডলারে উন্নীত করতে পেরেছিলেন। দারিদ্র্যতা শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। গণতন্ত্রের কথা বলবেন আবার পারিবারিকতন্ত্র বা রাজতন্ত্র কায়েম করবেনÑ এটা হতে পারে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকল দলের সমান অধিকার থাকে। দেশে যতগুলো রাজনৈতিক দল আছে সবারই সমান অধিকার পাওয়ার সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। এটা গণতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য। বর্তমান শাসক দল যেভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দুই দিনব্যাপী অত্যন্ত নিরাপদ বেষ্টনীতে বর্ণিল সাজে জাতীয় কাউন্সিল সমাপ্ত করেছে, সেভাবে দেশের আরেকটি বড় বিরোধী দল বিএনপি কি সেই সুযোগ পাবে? প্রশ্নবোধক এই বাক্যটি করলাম এ কারণে যে, অতীতে বর্তমান সরকার বহু ক্ষেত্রেই বিএনপিকে উন্মুক্ত স্থানে সভা-সমাবেশ করতে অনুমতি দেয়নি। তার সর্বশেষ উদাহরণ ৭ নভেম্বর পালন করতে গিয়ে বিএনপিকে কতটা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে সেটা তো দেখা গেল।
গণতন্ত্র শুধু শাসক দলের জন্য নিরাপদ থাকবে, অন্যদের ক্ষেত্রে ভীতিজনক পরিস্থিতির ধুয়া তুলে সভা-সমিতি থেকে বঞ্চিত করা গণতন্ত্রের কোনো ধারা-উপধারায় এমন কথা লেখা আছে কিনা, সেটা আমার জানা নেই। কিন্তু দেশের রাজনীতিতে সেটাই দুই যুগ ধরে চলছে। যে ক্ষমতায় যায় সেই বিরোধী দলকে শাসায়। রিমান্ড, হাজত, ক্রসফায়ার, মামলা, হামলা, গুমÑ এসব অস্ত্র প্রয়োগ করেই বিরোধী দলকে বাকশক্তিহীন করা হয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়নের সমস্যাটা ১৯৪৭ সাল থেকেই শুরু হয়েছে। ৬৯ বছর পরও তার সুরাহা ঘটেনি। গণতন্ত্রের অবস্থা এরকমÑ সালিশ মানি কিন্তু তালগাছটা আমার। গণতান্ত্রিক বিশ্বে গণতন্ত্রের এমন কাহিল দশা খুবই বিরল ঘটনা। গণতন্ত্রের চলমান বেহাল দশা থেকে জনগণ এবং রাষ্ট্র পরিত্রাণ চায়। গণতন্ত্র শুধু জাতীয় নির্বাচন নয়, ব্যক্তি, দল এবং সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে এর অবাধ চর্চা থাকা একান্ত প্রয়োজন। একটি সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচনের জন্য সর্বক্ষেত্রে সার্চ কমিটি বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন নিয়োগকালে সব দলের মতামত নিয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। শাসক দলের নিজের সিদ্ধান্তে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাজালে সেটা বিতর্কিত হবে। গণতন্ত্র সবার। তাই সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর রূপরেখা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে। দলের মধ্যে গণতন্ত্র না থাকলে জাতীয় নির্বাচনে গণতন্ত্র থাকবে না। এটাই সহজ কথা।
বাংলাদেশ বহু সমস্যায় জর্জরিত। বাংলাদেশের আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে জলবায়ুর ভয়াবহ সংকটে এখন দেশ। বিশ্বের সবচেয়ে গণবসতি রাষ্ট্র বাংলাদেশ। প্রথম আলো ২৪ অক্টোবর ২০১৬ লিড নিউজ ছাপিয়েছেÑ দেশে মিনিটে চারজনের বেশি মানুষ বাড়ছে। সেই হিসাবে ঘণ্টায় বাড়ছে ২৫৩ জন। আর দিনে বাড়ছে ৬ হাজার ৭০ জন। বছর শেষে মোট জনসংখ্যার সঙ্গে নতুন যুক্ত হচ্ছে ২২ লাখ ২১ হাজার ৮০০ মানুষ। বছরে মোট জন্ম ও মোট মৃত্যুর হিসাব থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই তথ্য দিয়েছে সরকারের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোট)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, দেশে বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১০ লাখ। তাদের হিসাবে ২০৫০ সালে দেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ২১ কোটি ৮৬ লাখ। যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য উদ্ধৃত করে বিশ্বব্যাংকের এক দলিলে বলা হয়েছেÑ এই শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ২৩ কোটি ৩৫ লাখ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জমি ও সম্পদের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আয়তন অনুপাতে এত জনসংখ্যা পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রে নেই। এই বাড়তি জনসংখ্যার খাদ্য আবাসন ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতিকে সব সময় চাপের মধ্যে রাখবে। বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের অর্থনীতি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব শামসুল আলম গণমাধ্যমকে বলেছেনÑ এশিয়া অঞ্চলে চীন, ভারত এবং বাংলাদেশ তিনটি দেশই জনবহুল। তারপরও দেখা যায়, ভারতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৪৬ জন মানুষ বাস করে। চীনে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৪২ জন। আর বাংলাদেশে ১ হাজার ২০০ জন। সেই হিসাবে পাকিস্তানে জনসংখ্যার চাপ কম। তারা ভালো অবস্থায় রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থা শোচনীয় বলা যায়। আমাদের জমি এক ইঞ্চিও বাড়েনি। উল্টো প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষকরা জমিহারা হচ্ছে। আমাদের দেশে প্রতি মিনিটে ৫ দশমিক ৮টি নবজাতকের জন্ম হচ্ছে। অন্যদিকে প্রতি মিনিটে ১ দশমিক ৬ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। মিনেটে স্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি ৪ দশমিক দুই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। বর্তমানে জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১০ লাখ। জনসংখ্যার এই চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে সেটা ভাবতে হবে শাসক দলকে এবং আগামী নির্বাচনে যারা ক্ষমতায় আসবে, তাদের এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে মোকাবিলা করতে হবে।
বর্তমানে দেশে প্রায় চার কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে আছে। এই ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্রে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনা আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। যে-ই ক্ষমতায় আসুক এ বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবে মোকাবিলা করতে হবে। বর্তমানে মাত্র ৮০ লাখ মানুষ বহির্বিশ্বে কর্মরত। এই সংখ্যা আগামী ৫ বছরে দ্বিগুণ করতে হবে। কারণ বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের অভাব-জনসংখ্যার আধিক্য অনুপাতে। এটা লাঘব করা কঠিন। যে দলই ক্ষমতায় আসুক তারা নিজের ভাবনাই ভাবেন বেশি। তাদের ভাবনা একটি- সেটি হলো ক্ষমতা। এটা তাদের কাছে সোনার হরিণ। এই সোনার হরিণকে নিয়েই সারা বছর তাদের রাজনীতি। ভৌগোলিক চৌহদ্দি, মানুষের বসবাসের ঠিকানাÑ কোথায় এত মানুষ থাকবে, বন জঙ্গল কেটে আবাসন বৃদ্ধি- যা জলবায়ু ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি, নদী, বন, পাহাড় এগুলোও রক্ষা করতে হবে। মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য।
আমাদের শাসক সম্প্রদায় ক্ষমতার অংক কষে কীভাবে আগামী দিনগুলোতে মসনদে বসা যায় কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয় ও কর্মকর্তাবৃন্দ সপ্তাহে, মাসে বা বছরে একবারও কি স্বচক্ষে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা মানুষগুলোর ভোগান্তির দৃশ্য দেখেন। এ জায়গাটায়ই গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ। প্রেস মিডিয়ায় গণতন্ত্র উদ্দীপ্ত, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণতন্ত্র চাঙ্গাভাব, সভা-সমিতিতে গেলে দেখা যায়- বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জয়জয়কার। বাংলাদেশ গণতন্ত্রের উর্বর ভূমি। এই ভূমিতে চাষ করলেই গণতন্ত্রের কায়দাকানুন উৎপাদন করা যায়। আসল গণতন্ত্রটা খুঁজতে হয় হাটবাজারে যেখানে এখন চাল প্রতি কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে গেছে, লবণের কেজি ৫ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ টাকা। স্বাধীনের পূর্বে দেখেছি গ্রামগঞ্জে চাষিরা ফেনের সাতের বেগুন কেটে গরুকে খাওয়াত। সেই বেগুনের কেজি ৮০ টাকা। গণতন্ত্র বাস্তবায়ন করতে হলে বেতন বৃদ্ধি না করে বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করুন, যেটা আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র ভারতে চলমান আছে। ওয়ান ইলেভেন ইমার্জেন্সি মিলিটারি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হঠাৎ আলুর কেজি ১২ টাকা হলো। গণতন্ত্রের দরদীরা হৈচৈ আরম্ভ করে দিলÑ কেন এত আলুর দাম বাড়লো। নিশ্চয়ই মিলিটারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার আলু সিন্ডিকেট করেছে। এখন সেই আলু ৩০ টাকা কেজি দরে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এত দাম কেনÑ উত্তর বেশি দামে কেনা। সরকার সমর্থক লোকদের সরল উক্তিÑ চাচা বেতন তো বাড়ছে। তার কথা বেতন বাড়লে পণ্যমূল্য বাড়বে। আমি ২০০৬ সালে বিদ্যুৎ বিল দিতাম ঊর্ধ্বে সাড়ে তিনশত টাকা। সেই একই বাসায় এখন বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছি প্রায় চার হাজার টাকা। মনে হয় সবাই সরকারি চাকরী করেন! তাই সবার বেতন বেড়েছে! এ ধরনের উক্তিতেই গণতন্ত্র জিন্দালাশ হয়।
এবার একজন শাসকের কথা বলবÑ তিনি জীবিত আছেন। তার নাম হোসে মুজিকা। উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট। তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র প্রেসিডেন্ট হিসেবে। সুশাসক হিসেবে দেশের মানুষের কাছে পরিচিত। মাসে বেতন পেতেন মাত্র ১২ হাজার ৫০০ ডলার। যার বেশির ভাগই তিনি দান করে দিতেন। সর্বদাই তার মুখে মুচকি হাসি, প্রাণ খুলে সবার সাথে হাসেন। টিনের চালের ছোট একটি শোবার ঘর পাশে একিট রান্না ঘর। জীর্ণ এই খামারবাড়িতে থাকেন। পুরো জীবনটা উৎসর্গ করে দিয়েছেন মানুষের কল্যাণে। প্রথম জীবনে বেকারির ডেলিভারি বয় ও ফুল বিক্রতা- এ দিয়ে তার সংসার চলত। মাত্র ৫ বছর বয়সেই বাবাকে হারিয়ে চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি হতে হয় তাকে। নিজ দেশে বামপন্থি রাজনীতিতে তার উত্থান। ১ মার্চ ২০১০ থেকে ১ মার্চ ২০১৫-এই ৫ বছর উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যা বেতন পেতেন তার মধ্যে ১ হাজার ২৫০ ডলার রেখে বাকি টাকা দুস্থদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। এই অল্প টাকায় তার সংসার চলে কিনা এক স্প্যানিশ টিভি চ্যানেলকে প্রশ্নের জবাবে মুজিকার বলেছিলেন, এই টাকায় বেশ ভালো আছি। তার নামে কোনো ঋণ নেই। তার কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টও নেই। নিজেকে তিনি পরিচয় দেন একজন কৃষক হিসেবে। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তার জন্য নির্ধারিত সরকারি বাড়ি-গাড়ি কোনোটাই ব্যবহার করেননি মুজিকা। রাজধানী মন্টিভিডিওর পাশে স্ত্রীর মালিকানাধীন ভাঙা এক খামার বাড়িতে থাকেন তিনি। ১৪ বছর জেলে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন মানুষের কথা বলতে গিয়ে। জেল জীবনে এক বছর গোছল করতে পারেননি। অত্যন্ত সাদামাটা জীবন সবচেয়ে গরিব প্রেসিডেন্ট যিনি গণতন্ত্রাতিকভাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে। এ ধরনের নেতা বাংলাদেশে আশা করা যায় কি? যারা এখন রাজনীতি নিয়ে খেল-তামাশা করেন, তাদের অতীত এবং বর্তমান জীবন বৃত্তান্ত কি হোসে মুজিকার সাথে একটুও মিল খায়? নেপালেও এরকম একজন নেতা খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। তার সম্পত্তির মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল দুটো পুরনো মোবাইল সেট। তাও পার্টি অফিস থেকে দেওয়া হয়েছিল।
এমন নেতা আমাদের দেশে আশা করে হয়তো সুফল পাওয়া যাবে না। কিন্তু তাই বলে কাক্সিক্ষত গণতন্ত্র তো আমরা প্রত্যাশা করতেই পারি। আর বড় দুটি দলের কাউন্সিলের পর আমরা তাদের কাছে এটাও প্রত্যাশা করি যে, এবার অন্তত তারা গণতন্ত্রের পথকে সুগম করবেন।
লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামিস্ট
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।