বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
আল ফাতাহ মামুন
জনমত জরিপের পূর্বাভাস ছিল- হিলারিই হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। সংবাদ মাধ্যমের সমর্থনও ছিল ডেমোক্রেটদের পক্ষে। রিপাবলিকান দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই ট্রাম্পকে লালকার্ড দেখিয়ে জানিয়ে দেন, তারা একজন অসহিষ্ণু ব্যক্তিকে দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান না। কিন্তু সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ উভয় ক্ষেত্রেই একচ্ছত্র আধিপত্য দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্টের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনী প্রচারাভিযান জুড়ে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী ঘৃণা কুড়ানো ট্রাম্পকে বলা হচ্ছিল ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। এমন ‘পাগলাটে’ ব্যক্তিকে যে যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবেন এমনটা ভাবতেই পারেননি ঝানু নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরাও। সব জরিপ ও বিশ্লেণ উল্টে দিয়ে ট্রাম্পের এ চমকপূর্ণ জয়ে তাই বিস্মিত বিশ্বের খ্যাতনামা রাজনীতিকরাও। বিবিসি বলছে, নির্বাচনে জয়ী হতে ট্রাম্প পাঁচটি কৌশল নিয়েছিলেন। এ কৌশলগুলো অনেকের কাছেই অনাকাক্সিক্ষত ও দুর্বোধ্য ছিল। এগুলো হলো ট্রাম্পের ‘শ্বেতাঙ্গ জোয়ার’, বিতর্ক ও কেলেঙ্কারির অভিযোগের মুখেও অবিচল থাকা, রাজনীতিতে ‘বহিরাগত’ হয়েও কাউকে পাত্তা না দেওয়া, হিলারির ই-মেইল নিয়ে এফবিআই পরিচালক জেমস কোমির তৎপরতা ও নিজের ধারণার ওপর ট্রাম্পের আস্থা। আবার কোনো কোনো বিশ্লেষক বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময়ের অনেক কর্মকা-ে হিলারির ওপর যেসব মানুষ ক্ষুব্ধ ছিল, তারাই হিলারিকে ঠেকাতে ট্রাম্পকে জয়ী করেছেন।
মার্কিন নির্বাচনী সংস্থার তথ্যমতে, আগামী চার বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে প্রায় ২২ কোটি নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে ৫৪ শতাংশ ভোটার নিজেদের ভোট প্রদান করেছেন। প্রেসিডেন্ট পদ নিশ্চিত করতে এ নির্বাচনে ৫০ রাজ্যে ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের মধ্যে প্রয়োজন ছিল ২৭০ ভোট। সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত ঘোষিত ফলাফলে ট্রাম্প পেয়েছেন ২৯০টি ইলেকটোরাল ভোট। আর হিলারি পেয়েছেন ২১৮টি ইলেকটোরাল ভোট। পপুলার ভোটও বেশি পড়েছে ট্রাম্পের পক্ষে। তিনি পেয়েছেন পাঁচ কোটি ৮২ লাখ ১০ হাজার ৬৯৭ ভোট। আর হিলারি পেয়েছেন পাঁচ কোটি ৭৭ লাখ ৫৫ হাজার ৪৬৮ ভোট। মোট ভোটের ৪৭.৮ শতাংশ পেয়েছেন ট্রাম্প এবং ৪৭.৪ শতাংশ পেয়েছেন হিলারি।
ট্রাম্পের ঐতিহাসিক বিজয়ের ফলে শুধু হোয়াইট হাউস নয় যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের দুই কক্ষেরই নিয়ন্ত্রণ পেতে যাচ্ছে রিপাবলিকান পার্টি। নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ আগেই তাদের হাতে ছিল, নতুন করে সিনেটও তাদের দখলে যাচ্ছে। প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ আসনের মধ্যে সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রিপাবলিকানরা পেয়েছে ২৩৬ আসন, আর ডেমোক্রেটরা পেয়েছে ১৯১ আসন। অন্যদিকে সিনেটের ১০০ আসনের মধ্যে ভোট হয়েছে ৩৪ আসনে। এই নির্বাচনের ফল মিলিয়ে এখন ৫১ আসন রিপাবলিকানদের হাতে আর ৪৭ আসন গেল ডেমোক্রেটদের হাতে। প্রেসিডেন্ট পদ, কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট, নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদসহ সবই এখন রিপাবলিকানদের দখলে।
ট্রাম্পের এই বিজয় শুধু হিলারির পরাজয় নয়, প্রেসিডেন্ট ওবামারও পরাজয়। নিজের উত্তরসূরি হিসেবে ওবামা হিলারির সমর্থনে সরাসরি নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেন। ট্রাম্পকে পরাজিত করা তাঁর জন্য ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ ট্রাম্প তাঁর জন্মস্থান প্রশ্নে সন্দেহ প্রকাশ করে এক গভীর বর্ণবাদী রাজনীতিকে উসকে দেন। ওবামার শাসনামলে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আইনগত বিজয় হলো- স্বাস্থ্যবিমা আইন। যা ওবামাকেয়ার নামে পরিচিত, সেটি বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নে যে আন্তর্জাতিক চুক্তির পক্ষে ওবামা দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন, তা বাতিলের কথাও বলেছেন ট্রাম্প। সুপ্রিম কোর্টে আরও একজন উদারনৈতিক বিচারক নিয়োগের অপেক্ষায় ছিলেন ওবামা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্টের সব অর্জন এখন বাতিল করার সুযোগ পাবেন এমন একজন, যিনি নিজেকে খোলামেলাভাবে শ্বেত শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি তাঁর আনুগত্যের কথা প্রকাশ করেছিলেন। ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার অযোগ্য বলে ঘোষণা করেছিলেন ওবামা। সেই ট্রাম্পকেই হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানাতে হচ্ছে তাঁকে।
ট্রাম্পের বিজয় বাংলাদেশিসহ অধিকাংশ অভিবাসীর জন্য এক বড় ধাক্কা। কারণ তিনি সোয়া কোটি অবৈধ অভিবাসীকে দেশ থেকে বহিষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্রে আগমনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও বলেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি ভুগবে সিরিয়ার মানুষ। সিরিয়ার সম্ভাব্য শরণার্থীদের মুখের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের দরজা দড়াম করে বন্ধ হতে পারে। সিরিয়া থেকে শরণার্থীদের আগমন ঠেকাতে ট্রাম্পের পরামর্শ হলো ওই দেশটির মধ্যেই ‘নিরাপদ অঞ্চল’ সৃষ্টি করা, যাতে সিরীয় উদ্বাস্তুদের শরণার্থী হিসেবে দেশের বাইরে যেতে না দিয়ে ওই এলাকার মধ্যে জড়ো করা যায়। দম্ভের সঙ্গে তিনি বলেছিলেন, এর খরচ তিনি উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে আদায় করবেন। একই রকমভাবে মেক্সিকো আর আমেরিকার মধ্যে দেয়াল তৈরির খরচও মেক্সিকোর কাছ থেকেই নিয়ে ছাড়বেন বলে জানিয়েছিলেন। এসব প্রতিশ্রুতি পূরণের সুযোগ এখন তাঁর সামনে। প্রকৃত অর্থেই এ প্রস্তাবগুলো বাস্তবসম্মত নয়। তাই ট্রাম্পের জয়ের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত জেরার্ড আরাউড টুইটারে লিখেছেন, ‘ব্রেক্সিট ও সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর এখন সবই সম্ভব। আমাদের চোখ বুজে আসার আগেই যে এই পৃথিবী ধ্বংস হচ্ছে তা নিশ্চিত’। সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কার্ল বিল্ড লিখেছেন, ‘এই বছর হলো পশ্চিমাদের দ্বিতীয় দফায় ধ্বংসের বছর।’ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর পর জার্মান পত্রিকা দে ওয়েল্ট, ‘একটি পুরনো পোস্টারে ট্রাম্পের মাথা বসিয়ে পুনরায় প্রকাশ করে।’ জাপানের এনএইচকে বলেছে, ‘ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে জাপানসহ অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।’
এন এইচের কথা সত্য প্রমাণিত হয়েছে বুধবার সকালেই। ট্রাম্পের এগিয়ে থাকার খবরে বুধবার সকাল থেকে এশিয়ার বিভিন্ন শেয়ার মার্কেটে কম লেনদেন লক্ষ করা গেছে। টোকিও, হংকংসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শেয়ার বাজারে ২ শতাংশের বেশি দরপতন দেখা গেছে। ওয়াল স্ট্রিটের স্টক মার্কেটও নেতিবাচক প্রভাবের বাইরে ছিল না। ডো জোনস ইনডেক্স বলছে, লেনদেন প্রায় ২.৫ শতাংশ কমে গেছে। বুধবার দিনশেষে টোকিও সূচক কমেছে ৫.৩৬ শতাংশ, সাংহাই সূচক কমেছে ০.৬১ শতাংশ, হংকং সূচক কমেছে ২.৪৪ শতাংশ, সেনসেক্স সূচকে ১.২৩ শতাংশ কমেছে। বিশ্ববাজারের সঙ্গে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ও শেয়ারবাজারেও। এক মাস ধরে ডিএসইর লেনদেন স্বাভাবিক গতিতে হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ দিনই ছিল ঊর্ধ্বমুখী। বুধবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-ডিএসইর সূচক প্রায় ২০ পয়েন্ট কমেছে। দিন শেষে শেয়ারবাজারের সূচক ২০ পয়েন্ট কমে ৪৬৭১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে কমেছে ডিএস-৩০ মূল্যসূচক। লেনদেন শেষে ডিএসই-৩০ সূচক প্রায় ৮ পয়েন্ট কমে ১৭৫৬ পয়েন্ট হয়েছে। লেনদেনকৃত বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ার দর হারিয়েছে। যা রীতিমত উদ্বেগজনক।
ট্রাম্প যেহেতু ইরানের সঙ্গে ওবামা প্রশাসনের করা পরমাণু সমঝোতা চুক্তির বিপক্ষে, তাই ইরানের বিপক্ষে তিনি সৌদি আরবকে উসকে দেবেন। চাইবেন তুরস্ক, কায়রো ও রিয়াদকে নিয়ে সুন্নি ত্রিভুজ সৃষ্টি করতে। আর এর পৃষ্ঠপোষকতা করবে ওয়াশিংটন। আর এখানেই নিহিত আছে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গির অসংগতি। (বৈশ্বিক স্তরে এই অসংগতির আরেকটা উদাহরণ হলো চীনের ব্যাপারে তাঁর বিদ্বেষ।) মধ্যপ্রাচ্যকে ইরানবিরোধী করে তোলার আগে তাঁকে তো রাশিয়া ও সিরিয়াকে তেহরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থেকে সরাতে হবে! তবে চিত্র উল্টেও যেতে পারে। এমনও হতে পারে, ট্রাম্প হয়তো যা ইচ্ছা তা বলবেনও না এরপর। নির্বাচনে জেতার বক্তব্য আর নির্বাচিত হওয়ার পরের বক্তব্য পৃথিবীতে বহু দেশেই এক রকম হয় না। তিনি ইতিমধ্যে আমেরিকাকে বরং এক হওয়ার ডাক দিয়েছেন। অভিবাসী, মুসলিম ও হিস্পানিকদের প্রতি সদয় কথাবার্তাও হয়তো তিনি একসময় বলবেন। তবে তিনি যে অতি বুর্জোয়া, অতি ডান ও হোয়াইট সুপ্রিমেসির রাজনীতি ধারণ করেন, তাতে তাঁর ভোটারদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হলে কিছু নতুন পদক্ষেপ তাকে নিতেই হবে। মনে হয় না আমেরিকা বা বাদবাকি বিশ্বের জন্য তা সার্বিকভাবে কল্যাণকর হবে! এমনিতেই বিশ্বজুড়ে বিরাজ করছে নানা উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তা। এবার ‘পাগলাটে’ ট্রাম্প কী করবেন তা নিয়ে দেখা দিয়েছে নয়া উদ্বেগ। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্টকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ার আহ্বানর রইল আমাদেও পক্ষ থেকে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন এ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।