দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯৭৪ ইং অনুযায়ী প্রতিটি বিবাহ নিবন্ধন করা আবশ্যক। উক্ত আইনে বিবাহ নিবন্ধন না করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই সরকার কর্তৃক নির্ধারিত কাজীর মাধ্যমে নির্ধারিত ফরমে বিবাহের নিবন্ধন করতে হয়। যে ফরমে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন করা হয়, তাকে ‘নিকাহনামা’ বলা হয়। যা ‘কাবিননামা’ নামেই সমধিক পরিচিত।
উক্ত নিবন্ধন ফরমে মোট ২৪টি ধারা রয়েছে। এসব ধারায় মৌলিকভাবে যে বিষয়গুলো রয়েছে, তা হলো- বিবাহের ও নিবন্ধনের স্থান ও তারিখ, স্বামী-স্ত্রীর নাম, পরিচয় ও বয়স, স্বাক্ষী ও উকিলদের নাম ও পরিচয়, দেনমোহরের পরিমাণ এবং তা নগদ ও বাকির হিসাব, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের অধিকার প্রদান ও শর্তসমূহের বিবরণ, কাজীর স্বাক্ষর ও সিলমোহর ইত্যাদি। বর-কনের ইজাব-কবুলের মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর বিবাহ রেজিস্টার বা কাজী উপরিউক্ত তথ্যগুলো দিয়ে কাবিননামার ফরম পূরণ করেন। ফরম পূরণ শেষে বর ও কনে তাতে স্বাক্ষর করেন।
তবে কাবিননামার এসব ধারার মধ্যে স্ত্রীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো ১৮ নং ধারাটি। এতে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়। আর এটি স্ত্রীর জন্য প্রয়োজনের ক্ষেত্রে খুবই কাজে দেয়। কেননা স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কের যখন এতোটা অবনতি ঘটে যে, তাদের পক্ষে একত্রে বসবাস করা কোনোভাবে সম্ভব হয় না, সেক্ষেত্রে ওই কষ্টের বেড়াজাল থেকে বের হওয়ার জন্য শরিয়ত স্বামীকে তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর বিধান দিয়েছে।
কিন্তু কোনো স্বামী এ পর্যায়েও যেনো তালাকের পথ অবলম্বন না করে, স্ত্রীকে আটকে রেখে তার ওপর জুলুম-নির্যাতন করতে না পারে, সেজন্য শরিয়ত ‘তালাকে তাফঈয’-এর নিয়ম প্রবর্তন করেছে। অর্থাৎ স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের পূর্বানুমতি প্রদান করা; যেনো প্রয়োজনবোধে স্ত্রী নিজেই তালাক গ্রহণ করতে পারে। সুতরাং স্ত্রী বা স্ত্রীপক্ষের জন্য বিয়ের কাবিননামা পূরণের সময় স্বামীর কাছ থেকে সেই অধিকার নেওয়ার সুযোগ শরিয়তে রয়েছে। ইসলামি আইনের ভাষায় এরই নাম ‘তালাকে তাফঈয’। অতএব, মুসলিম পারিবারিক আইনে কাবিননামার মধ্যে ‘তালাকে তাফঈয’-এর ধারাটি একটি কার্যকর সংযোজন। তবে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এই ধারাটি পূরণ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে অনেক সময়ই বিভিন্ন ধরনের ভুল ও শরিয়ত পরিপন্থী কার্য সংগঠিত হয়ে থাকে। যার ফলে দেখা যায়, বিয়ের পর স্ত্রীরা অহরহ তালাক গ্রহণ করে থাকে। সামান্য কারণে হুট করে স্বামীকে তালাকের নোটিশ বা ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়। রাগের মাথায় স্বামীকে বলে দেয়, ‘আমি আপনার থেকে তালাক!’ রাগ শেষ হলে আবার একসঙ্গে ঘর-সংসার করতে চায়। কিন্তু তখন আর কোনো উপায় থাকে না। তখন নিজেরা আফসোস করে সম্পর্ক চিরতরে ছিন্ন করতে হয়। আবার অনেক মেয়ে পরকীয়া আসক্ত হয়ে স্বামীর ওপর মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়। যেটা স্বামী বেচারার ওপর সীমাহীন জুলুম। জরিপে দেখা যায়, গ্রামের তুলনায় শহরে স্ত্রীদের পক্ষ থেকে তালাক গ্রহণ বা ডিভোর্স প্রদানের ঘটনা বেশি ঘটে। এর থেকে বাঁচার উপায় হলো, সঠিকভাবে এ ধারাটি পূরণ করা এবং এ সংক্রান্ত যেসব ভুল-ভ্রান্তি রয়েছে, তা থেকে বেঁচে থাকা।
এ সংক্রান্ত বহুল প্রচলিত ভুলসমূহ তিন তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণ : কাজী বা বিবাহ রেজিস্টাররা অনেক ক্ষেত্রেই এ ধারার ঘরে ‘তিন তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে’ বলে লিখে দেয়। এটি অনেক বড় ভুল। কারণ এক তালাকে বায়েন গ্রহণের ক্ষমতা অপর্ণ করা হলেই এ ধারার উদ্দেশ্য পরিপূর্ণরূপে হাসিল হয়ে যায়। কিন্তু বিবাহ রেজিস্টার এ দিকটি বিবেচনা না করেই তিন তালাকের অধিকারের কথা ড্রাফট করে ফেলে। ফলে এ ক্ষমতাবলে পরবর্তীতে স্ত্রী যখন সামান্য কারণেই তিন তালাক গ্রহণ করে বসে এবং এরপর আবার ঐ স্বামীর সঙ্গে ঘর-সংসার করতে চায়; কিন্তু তখন আর হিলা বিবাহ দেওয়া ছাড়া সেই সুযোগ থাকে না।
অতএব, ধারাটি এমনভাবে লেখা উচিত, যেনো সহজে আসল উদ্দেশ্য হাসিল হয়; আবার অতিরিক্ত ক্ষমতা পাওয়ার কারণে কারোর ক্ষতি কিংবা কারোর ওপর জুলুম না হয়। এজন্য এক্ষেত্রে কেবল ‘এক তালাকে বায়েন’ গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণ করা উচিত। এতে এ ধারার উদ্দেশ্যও হাসিল হবে, আবার বিবাহ বিচ্ছেদের পর পুনরায় ঘর-সংসার করতে চাইলে সে সুযোগও বাকি থাকবে। কারণ এক তালাকে বায়েন গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হলে দু’দিকেরই সুযোগ থাকে। স্ত্রী চাইলে ইদ্দতের পর অন্যত্র বিবাহ বসতে পারে। আবার পূর্বের স্বামীর সঙ্গে পুনরায় ঘর-সংসার করতে চাইলে হিলা বিবাহ ছাড়াই নতুনভাবে আকদ করে একত্রে থাকাও সম্ভব। অতএব, তিন তালাকের অধিকার না দিয়ে এক তালাকে বায়েন গ্রহণের অধিকার দেওয়াই যুক্তিযুক্ত এবং তা এ সম্পর্কিত শরঈ নির্দেশনারও মুয়াফিক। স্ত্রী কর্তৃক তালাক গ্রহণের শর্তসমূহ গৎবাঁধা লিখে দেওয়া : উক্ত ধারায় লেখা আছে, কী কী শর্তে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অপর্ণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে যে সকল শর্তসাপেক্ষে স্ত্রীকে তালাকের ক্ষমতা প্রদান করা হয়ে থাকে, সাধারণত সেগুলো কাজীরা গৎবাঁধাভাবে লিখে দেয়। এ ব্যাপারে ছেলে বা মেয়েপক্ষের মতামত নেওয়া বা শর্তগুলো সুচিন্তিতভাবে লেখার চেষ্টা করা হয় না। এ ধারায় সাধারণত যে শর্তগুলো লেখা হয়, তন্মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি শর্ত হলো, ‘বনিবনা না হলে স্ত্রী তালাক গ্রহণ করতে পারবে’।
একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায়, শর্তটি খুবই হালকা। অনেকটা বিনা শর্তে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণের নামান্তর। কেননা প্রতিটি বৈবাহিক সম্পর্কেই কিছু না কিছু মনোমালিন্য হয়েই থাকে। মাঝেমধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তরকারিতে লবণ কমবেশি বা ঝাল-ঝোল কমবেশি হওয়া নিয়েও মতের অমিল হয়ে থাকে। এসব অমিল বা মনোমালিন্য অস্থায়ী। কিছুক্ষণ পর আবার সব ঠিক হয়ে যায়। তাই বনিবনা না হলেই যদি স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া থাকে, তাহলে ব্যাপারটি বেশ ঠুনকো এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। আর এমনিতেই মেয়েদের রাগ বা আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পুরুষের তুলনায় কম। এজন্য সামান্য কোনো ব্যাপারে সাময়িক মনোমালিন্য হলেও ‘বনিবনা না হলে’ এ শর্তটি পাওয়া যায় এবং তালাক গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে স্ত্রী বলতে পারে, ‘এতোটুকুতেই স্বামীর সঙ্গে আমার বনিবনা হয়নি, তাই তালাক নিয়েছি।’ অথচ হালকা মনোমালিন্যে স্ত্রীর তালাক গ্রহণের ক্ষমতা সৃষ্টি হওয়া অনাকাক্সিক্ষত, অনভিপ্রেত। কেউ চায় না অল্পতেই তাদের সংসার ভেঙ্গে যাক। কিন্তু উক্ত গৎবাঁধা শর্তের কারণে দেখা যায়, অল্পতেই সংসার চিরতরে ভেঙ্গে যায়। স্ত্রী তিন তালাক গ্রহণ করে বসে। ফলে এরপর একসঙ্গে থাকার আর কোনো সুযোগ থাকে না।
মনে রাখতে হবে, তালাক গ্রহণ ও প্রদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি এ ধরনের হালকা শর্তে শর্তযুক্ত হওয়া কখনোই কাম্য নয়। এক্ষেত্রে শর্তগুলো ভালোভাবে চিন্তা করে লেখা উচিত। এমন কিছু ভারসাম্যপূর্ণ শর্তারোপ করা উচিত, যেনো স্ত্রী প্রয়োজন ছাড়া সামান্য রাগ হলেই বা পরকীয়ার কারণে তালাক গ্রহণ না করতে পারে। আবার স্বামী যেনো তাকে জুলুম-অত্যাচার করেও আটকে রাখতে না পারে।
তালাক গ্রহণের ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে স্ত্রীর এখতিয়ারে দেওয়া : আলোচ্য ধারায় সাধারণত তালাক গ্রহণের ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে স্ত্রীর এখতিয়ারে দেওয়া হয়। তালাক গ্রহণের আগে নিজ অভিভাবকের সঙ্গে পরামর্শ করার কথা বলা হয় না। এটিও ঠিক নয়। কারণ স্ত্রী একাকী তালাকের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তাতে তাড়াহুড়ো বা বাড়াবাড়ির প্রবল আশঙ্কা থাকে। তাই তালাক গ্রহণের ক্ষমতাকে অভিভাবকের অনুমতি ও সম্মতির সঙ্গে শর্তযুক্ত করে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। কেননা তালাক গ্রহণের আগে স্ত্রী যদি নিজ অভিভাবকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করে, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাবে, অভিভাবকদের হস্তক্ষেপে আপোস-মীমাংসায় বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে গেছে; তালাক গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। এতে পূর্বাপর চিন্তাভাবনা ছাড়াই হুট করে তালাক গ্রহণের পথও বন্ধ হবে, ইনশাআল্লাহ।
কোরআনে কারিমের সুরা আহজাবের ‘আয়াতে তাখঈর’ (স্ত্রীকে বিবাহ বিচ্ছেদের এখতিয়ার দেওয়ার আয়াত) নাজিল হওয়ার পর রাসুল (সা.) হজরত আয়েশা (রা.)-কে ‘দুনিয়ার অর্থ-বিত্ত চাও নাকি আমাকে চাও?’ এ প্রস্তাব দেওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তুমি তাড়াহুড়ো কোরো না। তুমি তোমার আব্বু-আম্মুর সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিও।’ (বোখারি : ২৪৬৮, মুসলিম : ১৪৭৫)।
উক্ত হাদিসে রাসুল (সা.) বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিজ অভিভাবকের সঙ্গে পরামর্শ করার কথা বলেছেন। এর থেকে প্রমাণিত হয়, স্ত্রীদেরকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণের সময় ‘অভিভাবকদের সঙ্গে পরামর্শ সাপেক্ষে’ শর্তটি জুড়ে দেওয়া উচিত। যেনো তালাকের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীরা তাড়াহুড়ো না করে, ভুল না করে।
লেখক : সিনিয়র মুহাদ্দিস : জামিআ তাযকিয়াতুল উম্মাহ, ২৪/৮, পল্লবী, মিরপুর, ঢাকা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।