Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফুটপাথ দখলের নেপথ্যে শক্তিশালী সিন্ডিকেট

রাজধানীর মগবাজার কারওয়ানবাজার ও ফার্মগেট

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ১১ মার্চ, ২০২২, ১২:১৯ এএম

ফুটপাথ তুমি কার? পথচারীর। এটাই সত্য ও স্বাভাবিক। তবে সর্বত্র নয়। ঢাকার ফুটপাথ পথচারীর নয়, হকারের। ফুটপাথ হকারমুক্ত করার তাগিদ নিত্যদিন অব্যাহত থাকলেও বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কেউ যেন কেউ নেই। রাজধানীর ফুটপাথগুলো এখন শক্তিশালী সিন্ডিকেটের সোনার ডিম দেওয়া হাঁসে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য ফুটপাথ সব ধরনের দখলমুক্ত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত তিন এলাকা মগবাজার, কারওয়ানবাজার ও ফার্মগেট। প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অসংখ্য মানুষের পদচারণা থাকে ওই এলাকাগুলোতে। এত পথচারী অথচ সেখানে ফুটপাথ ধরে হেঁটে চলাচল করার সুব্যবস্থা নেই। পুরো ফুটপাথজুড়েই গিজগিজ করছে দোকান।
পথচারীদের হাঁটার জায়গা দখল করে নানা রকমের বাজার সাজিয়ে রেখেছে অবৈধ দখলদার। তাই বাধ্য হয়ে পথচারীরা নেমে এসেছেন মূল সড়কে। অনেক রাস্তায় আবার গড়ে উঠেছে অবৈধ গাড়ি পার্কিং। যে কারণে যানচলাচলে বিঘœ ঘটছে, সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। সেই সঙ্গে থাকছে পথচারীদের দুর্ঘটনার আশঙ্কাও। গত মঙ্গলবার ও বুধবার এসব এলাকা সরেজিমন ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তারা ইনকিলাবকে বলেন, ফুটপাথ দখল করে দোকান বসানো এবং রাস্তায় অবৈধ পার্কিং বন্ধে একাধিকবার অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু বরাবরই এ ধরনের অভিযানের সুফল দু’এক দিনের বেশি থাকে না। প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে আবারো আগের মতোই দখল হয়ে যায় ফুটপাথ ও রাস্তার কিছু অংশ। এ জন্য সিটি কর্পোরেশন বা সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া না হলে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না বলে কর্মকর্তারা মন্তব্য করেন।

মগবাজার : হাতিরঝিলের মগবাজার অংশ থেকে মগবাজার মোড় পর্যন্ত ফুটপাথ বিভিন্ন ওয়ার্কশপ আর নানা রকম দোকানপাটের দখলে। পথচারীদের মূল সড়কে নেমে চলতে হয়। ভারি যন্ত্রপাতি, রড ফুটপাথেই রাখা হয়। গাড়ি ধোয়ার পরে পানিতে কাদা হয়ে যায়। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সরণির (টঙ্গী ডাইভারশন রোড) মগবাজার অংশের ফুটপাথ পথচারীরা ব্যবহার করতে পারে না। গত মঙ্গলবার গিয়ে দেখা যায়, উড়ালসড়কের নিচে সড়কের দুইপাশেই ফুটপাথের ওপর সারি সারি মোটরসাইকেল রাখা। সবই মেরামতের জন্য। কোনোটা ধোয়া হচ্ছে, আবার কোনোটার যন্ত্রাংশ খুলে মেরামত করা হচ্ছে। সবই হচ্ছে ফুটপাথে। মেরামতের তালিকায় আরও আছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যক্তিগত গাড়ি, পিকআপ-ভ্যানসহ বিভিন্ন মোটরযান। স্টিলের আলমারি, ওয়ার্ডরোবের মতো বিভিন্ন আসবাবও ফুটপাথে রেখে তৈরি করা হচ্ছে। মগবাজার চৌরাস্তা থেকে রেলগেট পর্যন্ত রাস্তার ফুটপাথে গাড়ির অবৈধ পার্কিং চোখে পড়ার মতো। এই ফুটপাথের উপর বেশ কিছু এলাকাজুড়ে লোহার রড ফেলে রাখতেও দেখা গেছে।

আসমা ট্রেডিং কর্পোরেশনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল একটি দোকানের কর্মী হালিম। তিনি বলেন, আমরা না রাখলেও জায়গা খালি থাকে না। হুন্ডা (মোটরসাইকেল) চলে ফুটপাথ দিয়ে, পুলিশ মাঝেমধ্যে এসে সরিয়ে দেয়। তবে সমস্যা হয় না। মগবাজারের এ অংশ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) অঞ্চল-১ এর অধীন। এই অঞ্চলের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রায় সময়েই উচ্ছেদ হচ্ছে। সরিয়ে দেয়ার পর আবারও তারা বসে যায়।
কারওয়ানবাজার : কারওয়ানবাজার এলাকায় বিভিন্ন সড়কে গাড়ি পার্কিং করে রাখা হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই সবগুলো রাস্তায় এ পার্কিং করা হয়। অভিযোগ রয়েছে ইজারাদাররা পার্কিং বাণিজ্য করছেন। রাস্তায় যত্রতত্র পার্কিং করায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন পথচারীরা। সড়কগুলোতে এমন খারাপ অবস্থা থাকলেও নজর নেই ট্রাফিক পুলিশ ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি)। কারওয়ানবাজারকে আরেক নামে বলা হয় অফিসপাড়া। কেননা, এ এলাকায় রয়েছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক, সরকারি অধিদফতর, বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়, অফিস, বেসরকারি বিভিন্ন অফিস, প্রতিষ্ঠানসহ কিছু মিডিয়া অফিসও রয়েছে। এমনকি পাঁচ তারকা হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও কারওয়ানবাজারে। তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের নেই পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। অল্প কিছু থাকলেও সেটা পর্যাপ্ত নয় বলে অভিযোগ এসব প্রতিষ্ঠানের গাড়ি চালকদের। পেট্রোবাংলা থেকে এরশাদ বিল্ডিং ও টিসিবি মোড় থেকে কয়লা পট্টি পর্যন্ত বাজারের প্রধান সড়কসহ সবকটি রাস্তা ও ফুটপাথ দখল করে চলছে পার্কিং। এতে এ এলাকা দিয়ে চলাচলকারীদের নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে।

নিয়মিত কারওয়ানবাজারে বাজার করতে আসেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা হালিম মিয়া। তিনি বলেন, রাস্তার ওপর গাড়ি রাখায় যানজটের সৃষ্টি হয়। তবে বাজারের জন্য কোনো পার্কিং ব্যবস্থা না থাকায় সড়কের ওপর রাখি। এখানে গাড়ি রাখার জন্য ৩০ টাকা দিতে হয়। বেশি টাকার নেয়ার ব্যাপারে কিছু বলাও যায় না। ডিএনসিসি আঞ্চলিক কার্যালয়ের সামনে থেকে পেট্রোবাংলা মোড় পর্যন্ত সড়কটির প্রায় ১০০ ফিটের বেশি থাকলেও বেশিরভাগ পার্কিংয়ের দখলে। মাত্র ২০ ফিট দিয়ে চলছে যানবাহন।

কাপড় দোকানদার আব্দুল মুনশি ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের যাওয়ার জায়গা নেই। অনেক বছর ধরে এখানে অন্যান্যদের মতো আমিও ব্যবসা করছি। স্থানীয় সরকারি দলের নেতাদের লাইনম্যানকে প্রতিদিন ৫০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। ওই লাইনম্যানই পুলিশকে ম্যানেজ করে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তবে এক চা দোকানদার জানিয়েছেন, তিনি ওই লাইনম্যানকে প্রতিদিন ২০ টাকা করে চাঁদা দেন। এতে কোনো সমস্যা হয় না।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে সামনের রাস্তায় পার্কিং করে থাকা গাড়ির এক চালক বলেন, আমার স্যার এখানে চাকরি করেন। ভেতরে গাড়ি রাখার জায়গা নেই। গাড়ি রাখার জন্য সিটি কর্পোরেশন থেকে রাস্তা নির্ধারণ করা হয়েছে। টাকা দেই রাস্তায় রাখি, পুলিশের কোনো ঝামেলা নেই। এভাবে ইত্তেফাক গলি, ওয়াসা রোড, প্রথম আলো অফিস রোড, চকিগলি, কামাড় রোডসহ কারওয়ানবাজারের সব রাস্তা দখল করে চলছে অবাধে পার্কিং। এসব রাস্তায় প্রতিদিন শত শত গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাঁচ তারকা হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও-এর একজন কর্মকর্তা বলেন, এ হোটেলটি দেশের ঐতিহ্যের অংশ। কিন্তু বিদেশি অতিথিদের হোটেলে প্রবেশ ও হোটেল থেকে বের হতে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। তাছাড়া হোটেলের সামনের ফুটপাথ দখল হয়ে থাকায় হেঁটে চলাচল করার কোনো সুযোগও নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, হোটেলের পূর্বপাশের ফুটপাথ দখর করে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ টুরস রেন্ট-এ কার অ্যাসোসিয়শনের অফিস। রাস্তা ও ফুটপাথ দখলের নামে একটি শাক্তিশালী সিন্ডিকেট বাণিজ্য করছে বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।

কারওয়ান বাজারে কথা হয় ট্রাফিক পুলিশের এএসআই রমজানের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাস্তা সঙ্কুচিত হওয়ায় ট্রাফিক কন্ট্রোলে অনেক ব্যাঘাত ঘটছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম সড়ক থেকে স্থায়ীভাবে অবৈধ দখল ও হকারমুক্ত রাখা জরুরি। তবে পুলিশের কথা অনেকেই শুনতে চায় না বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ফার্মগেট : এদিকে নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষের চলাচল রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেটে। গুলিস্তানের পরই সবচেয়ে বেশি মানুষের পদচারণা থাকে সেখানে। দিন রাতের সবসময়ই গিজগিজ করে মানুষ। যে ফার্মগেটে এত পথচারী অথচ সেখানে ফুটপাথ ধরে হেঁটে চলাচল করার কোনো সুব্যবস্থা নেই। ফার্মগেট এলাকাজুড়ে ফুটপাথগুলো হকাররা দখল করে ব্যবসা করলেও এর নেপথ্যে আছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। রাজধানীর হকাররাও এসব সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি। প্রতিদিনই চলছে মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি। কোন এক অদৃশ্য শক্তির কারণে তাদের এ আধিপত্য। যে কারণে বারবার উচ্ছেদ করার পরও দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না ফুটপাথগুলো। ফুটপাথ দখল করা হকারদের কোনোভাবেই ঠেকাতে পারছে না ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন।
কথা হয় পথচারী রাহিলা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, পুরো ফার্মগেটেই ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার কোনো পরিস্থিতি নেই। সবগুলো ফুটপাথে অতিরিক্ত দোকান, তার মধ্যে মানুষের হেঁটে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এত ভিড় থাকে যেখানে পুরুষ মানুষই হাঁটতে পারে না, আর আমরা মেয়ে মানুষ কীভাবে হাঁটব?

পথচারীদের চলাচলের জন্য থাকা ফুটপাথে কেন আপনাদের দোকান এমন প্রশ্নের জবাবে ফার্মগেটের ফুটপাথের দোকানদার কামরুল হাসান বলেন, টাকা দিয়ে দোকান বসাইছি, আবার প্রতিদিন চাঁদাও দিতে হয়। মানুষও হাঁটুক আমাদেরও ব্যবসা হোক। ফুটপাথে দোকান না বসালে কই যামু, বাজারে দোকানঘর নেয়ার মতো তো পুঁজি নাই। তাই প্রতিদিন লাইনম্যানকে টাকা দিয়ে দোকান চালাই।

হকার সূত্রে জানা গেছে, শার্ট, প্যান্টের ছোট দোকানের জন্য প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত আর জুতা ও আরেকটু বড় দোকানের জন্য ২০০ থেকে ২৫০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয় তাদের। কিন্তু এসব টাকা মূলত কাদের হাতে যাচ্ছে এর উত্তর দিতে নারাজ তারা। তাদের ভাষায়, শুধু লাইনম্যানকেই চেনে, তারা এসে প্রতিদিন টাকা নিয়ে যায়।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ