পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
১৯৮৯ সাল থেকে বইমেলায় আমার যাতায়াত। বিগত শতকের ৯০ দশকে প্রতিদিনই বইমেলায় আড্ডায় মেতেছি। ১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর আমার একটি করে রাজনৈতিক ধারার বই প্রকাশ হয়েছে। তরুণ সাংবাদিক হিসেবে তখনই বইমেলার প্রতি অন্যরকম আকর্ষণ শুরু হয়। পরবর্তীতে পেশাগত ব্যস্ততায় কয়েক বছর বইমেলায় কম যাওয়া হলেও গত তিন-চার বছর ধরে যাচ্ছি। এতদিনে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত হয়েছে। বইয়ের বেচাকেনা এবং মেলার আকর্ষণ কার্যত এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরেই। গুগলের বদৌলতে সব তথ্য পাওয়া গেলেও পাঠকের মধ্যে ছাপা বইয়ের আকষর্ণ-গুরুত্ব কমেনি।
বাংলা একাডেমির বইমেলা মানেই জ্ঞানের আসর। মেলা ঘিরে নানান মত-পথের লেখকদের বইয়ের সমাহার ঘটত। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ও মত পথের লেখক-পাঠকের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠত মেলা প্রাঙ্গণ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলা একাডেমির বইমেলা ছিল দেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্প-সংস্কৃতিমনা মানুষের সার্বজনীন উৎসব। কিন্তু সেই বইমেলা কি এখন সার্বজনীনতা হারাচ্ছে? স্টলে স্টলে বইয়ের সমাহার এবং লেখক-পাঠক-দর্শকদের পদচারণা দেখে মনে হচ্ছে মেলা কার্যত একশ্রেণির লেখক-প্রকাশক-পাঠকের মিলনকেন্দ্রে রূপান্তর ঘটেছে। বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীর লেখা বই এবং দর্শক অনুপস্থিত। গত দু’দিন বইমেলায় ঘুরে সেটাই মনে হলো।
ম্ক্তুধারার চিত্তরঞ্জন সাহা ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমিতে বইয়ের পশরা নিয়ে প্রথম বসা শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক ড. আশরাফ সিদ্দিকীর উদ্যোগে বিভিন্ন প্রকাশক বইমেলায় স্টল দেন। এইচ এম এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৩ সালে কবি মঞ্জুরে মওলা স্থায়ীভাবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ‘অমর একুশে বইমেলা’ শুরু করেন। তখন থেকেই বাংলা একাডেমির বইমেলা ধীরে ধীরে দেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পমনা মানুষের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। দেশের প্রকাশক-লেখক-বইপ্রেমী মানুষ মুখিয়ে থাকেন ফেব্রুয়ারি মাসের বইমেলার জন্য। কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, শিশু সাতিহ্য, ভূতের গল্প, ভ্রমণ কাহিনী, অনুবাদ সাহিত্য, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, আত্মজীবনী, বিজ্ঞান চিন্তা, চিকিৎসাসহ হাজারো বিষয়ের বই বের হয় বইমেলায়। বইমেলাকে কেন্দ্র করে বিপুল কর্মযজ্ঞ হয়। হাজার হাজার মানুষ আয়-রোজগার করেন। বই ছাপানো, বই বাঁধানো, কম্পোজ, প্রচ্ছদ আঁকা, স্টলে বই বিক্রির কাজ অনেকেই করছেন। বইমেলার অর্থনৈতিক মূল্যও অনেক। বইমেলা ঘিরে হয়ে থাকে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার বাণিজ্য। বইমেলা কেন্দ্রও করে বাংলা একাডেমি, টিএসসি, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও দোয়েল চত্বর এলাকা লোকে লোকারণ্য। নানান ব্যবসা হচ্ছে মেলা ঘিরেই। ফলে বইমেলা শুধু শিল্প সাহিত্য নয়; অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলা একাডেমির বইমেলায় সব মত ও পথের লেখকদের মিলনমেলা ঘটে। এ বইমেলা প্রকাশকদের বই বিক্রি আর ক্রেতাদের বই কেনা শুধু নয়; আনন্দ স্ফূর্তি, হৈহুল্লোড়, উৎসব-উল্লাসের পাশাপাশি সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, শিল্পকলার বিকাশে জ্ঞানের চর্চায় উন্মেষ ঘটায়। এ বইমেলা লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে আত্মিক যোগাযোগ ঘটায়। বইমেলায় তৈরি হয় এক আনন্দঘন পরিবেশ। মেলায় শুধু বিক্রয়ই নয়; সেই সঙ্গে ঘটে পাঠক-লেখকের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ। লেখক-পাঠকের পারস্পরিক মতবিনিময়, চিন্তার আদান-প্রদান এবং একে অপরের কাছাকাছি আসার সুযোগ পান। কিন্তু রাজনৈতিক বিভাজন যেন বইমেলায় সার্বজনীনতা হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই পরিবর্তন!
বাঙালির ইতিহাস হাজার বছরের। গণতান্ত্রিক দেশে সরকার আসবে যাবে। কিন্তু জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য ধারণ করে বইমেলা রয়ে যাবে। অথচ বাংলা একাডেমির দায়িত্বরতরা বইমেলার এ কি হাল করেছেন? তারা শুধুই এক শ্রেণি ও আদর্শের লেখক-পাঠক-দর্শকদের জন্য মেলায় পরিণত করেছেন।
স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র সারাদেশে বই সরবরাহ করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি দেশে-বিদেশে বইমেলার আয়োজন করে। বইমেলায় দেখা গেল স্টলটিতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত কিছু বই এবং আওয়ামী লীগের কিছু নেতার বই ছাড়া অন্য বই নেই। বিক্রেতাদের একজন জানালেন আগে সব ধরনের বই বিক্রি করা হতো। বিশেষ করে ইসলামী ধারার বই বেশি বিক্রি হতো। এখন ইসলামী ধারার বই তাদের স্টলে বিক্রি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অথচ বইমেলায় ইস্কন স্টল দিয়ে বই বিক্রি করছে। বই মেলা ঘুরে দেখা গেল ইসলামী ধারার বইয়ের স্টল খুবই কম। একটি স্টলের বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন, ইসলামী ধারার বই বেশি বিক্রি হয়। কিন্তু নানান ঝক্কিঝামেলার কারণে প্রকাশকরা বই মেলায় আনেন না। তাছাড়া তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে ইসলামী বই বিক্রির জন্য বায়তুল মোকাররমে বইমেলার আয়োজন করা হয়।
এবার করোনার কারণে পয়লা ফেব্রুয়ারির বদলে ১৫ ফেব্রুয়ারি মেলা শুরু হয়েছে। দর্শকদের স্বাস্থ্যবিধির কথা মাথায় রেখে বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে অনেক জায়গা ফাঁকা রেখে স্টল বসানো হয়েছে। এতে দর্শকদের চলাচলে সুবিধা হয়েছে। পাশে অস্থায়ীভাবে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। আজান হলেই শত শত তরুণ নামাজ আদায়ে মসজিদে ছুটে যান। মসজিদে মুসল্লিদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় লেখক-পাঠকদের জন্য বিশেষ নির্মিত পাশের প্যান্ডেলে মুসল্লিদের নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়। বিভিন্ন স্টলে কর্মরত তরুণ-তরুণী বিক্রেতারা জানালেন, আছর, মাগরিব ও এশার নামাজের আজান হলেই গান-বাজনা-আনন্দ-আড্ডা ছেড়ে শত শত মানুষ নামাজ পড়তে মসজিদের দিকে ছুটে যান। মুসল্লিদের বেশির ভাগ আধুনিক সংস্কৃতিমনা তরুণ।
বইমেলা ঘুরে বিভিন্ন স্টলে বইয়ের সমাহার দেখে মনে হলো সবকিছু ক্ষমতাসীন দলকেন্দ্রিক। প্রকাশিত বই, লেখক, পাঠক, শিল্পী-সাহিত্যিক, আড্ডা সবই যেন একটি দলের আদর্শের লোকজন ঘিরে। স্টলগুলোতে যে বই সাজিয়ে রাখা হয়েছে তাও একটি আদর্শের ব্যক্তিদের। মনে হচ্ছে বইমেলায় নতুন- পুরাতন মিলে যে বইয়ের সমাহার তার এক-তৃতীয়াংশ বই লেখা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবন নিয়ে যার সামান্য ধারণা নেই তিনিও তাকে নিয়ে লিখেছেন বই।
বই লেখা ও বই পড়া দুটোই মহৎ কাজ। আবার সব বইয়ের সাহিত্যমান উন্নত-সমৃদ্ধ হবে সেটাও নয়। কিন্তু বইমেলা ঘিরে যে হাজার বই প্রকাশ হচ্ছে সেগুলোর কতগুলো বই পাঠযোগ্য? অধিকাংশ বই কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক দলকে খুশি করতেই যেন রচিত করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলকে খুশি করে কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ-নিবন্ধের বই লেখা যেন ফ্যাশনে পরিণত হয়ে গেছে। বই মানবজীবনকে উন্নত করে, মানুষকে রুচিশীল করে তোলে জ্ঞানের পরিধি বাড়ায়। যতই অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক মিডিয়া, অনলাইন পত্র-পত্রিকা পাঠ করি; ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডুবে থাকি না কেন বই পড়ার মতো মজা কিছুতেই পাওয়া যায় না। জ্ঞান অর্জনে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। এটা গুণীজনদের কথা। কিন্তু বাংলা একাডেমির বইমেলায় যে বইয়ের সমাহার তার কতটা ‘বই’ হয়ে উঠেছে আর কতটা ‘আবর্জনা’ তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। কারণ হাইব্রিড লেখক টাকা খরচ করে বই প্রকাশ করতে পারে কিন্তু সে বইয়ে সাহিত্যমান খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশ্বখ্যাত রাজনীতিক ফিদেল কাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি/কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি’। সেই বঙ্গবন্ধুকে জাতির কাছে তুলে ধরতে হাইব্রিড লেখকদের বই কতটুকু গুরুত্ব রাখবে তা অবশ্য বিতর্কের বিষয় হতে পারে।
দেশের কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিক, শিক্ষক, গবেষক, স্থপতি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিকরা নিজের মেধা কর্মযজ্ঞের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বই লিখবেন; শিল্প-সংস্কৃতিতে অবদান রেখে দেশকে সামনে এগিয়ে নেবেন। দেশের মহান ব্যক্তিদের সংগ্রামী ও কর্মময় জীবন চিত্র তুলে ধরে বই লিখবেন; সেটাই স্বাভাবিক। বইমেলায় বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখা গেল প্রচুর নতুন বই প্রকাশ করা হয়েছে। কবি-সাহিত্যিকদের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাজীবী এবং তরুণ-তরুণী এসব বইয়ের লেখক। ছাপার মান উন্নত হলেও বইগুলো হাতে নিয়ে গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-নিবন্ধ তথা রচনা দেখে মনে হয় দেশের শিল্প-সাহিত্যের সমৃদ্ধির জন্য নয়; মূলত বইগুলোর অধিকাংশই লেখা হয়েছে কোনো ব্যক্তি গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দর্শনধারীদের খুশি করতে; বাহবা পেতে। ২৫ ফেব্রুয়ারি বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কফিতে চুমুক দিতে দিতে একজন বইমেলা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু অবিসংবাদিত নেতা। তার অবদান অপরীসিম। কিন্তু যাকে নিয়ে যে শত শত বই প্রকাশ হচ্ছে তার কয়টা মানসম্পন্ন? অনেক বইয়ে বানান ভুল, অনেক বই শুধু বন্দনা। এসব বই কি বঙ্গবন্ধুকে সম্মানিত করছে? বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যারা বই লিখছেন, তারা যদি ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মর্মান্তিক হত্যকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নামতেন তাহলে দেশের ইতিহাস অন্যরকম হতো।’
দু’দিন বইমেলা ঘুরে দেখা গেল, ১৫ ফেব্রুয়ারি মেলা শুরু হলেও অনেক স্টলে একটি বইও বিক্রি হয়নি। হুমায়ূন আহমেদের বই বেশি বিক্রি হচ্ছে। শিশুদের কিছু বই বিক্রি হচ্ছে। কেউ কেউ অবশ্য জানালেন, তারা বই বিক্রির জন্য নয়; স্টল দিয়ে প্রচারণার জন্য মেলায় এসেছেন। তবে মেলার দুই অংশে ঘুরে দেখা গেল কেউ বই কিনছেন, স্টলে স্টলে ঘুরে ঘুরে কেউ বই দেখছেন। কম বয়সী অনেক ছেলেমেয়ে জুটি বেঁধে এসেছেন। খাবারের মূল্য বেশি তারপরও ভিড়। আলোচনা সভা, সঙ্গীতানুষ্ঠান হচ্ছে। অথচ দর্শকদের মধ্যে আগের মতো নেই প্রাণচাঞ্চল্য, উচ্ছ্বাস-উল্লাস। বাংলা একাডেমির বইমেলা যেন সার্বজনীনতা হারিয়ে ফেলছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।