Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চুক্তির দু’মাস : একজন কর্মীও পাঠাতে পারেনি বাংলাদেশ

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কর্মীর জন্য চলছে হাহাকার দালাল চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে পাসপোর্ট

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০০ এএম

মালয়েশিয়ার সাথে জনশক্তি রফতানি সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের (চুক্তি) দু’মাস অতিক্রম হলেও একজন কর্মীও দেশটিতে পাঠাতে পারেনি বাংলাদেশ। যথাযথ কূটনৈতিক তৎপরতার অভাবে দেশটির টেকনিক্যাল কমিটির বাংলাদেশে আগমনের তারিখ নির্ধারিত হয়নি। মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু হাজার হাজার কর্মী দেশটিতে যাওয়ার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মালয়েশিয়ায় চাকরি দেয়ার আশ্বাস দিয়ে দালাল চক্র গ্রামাঞ্চলের যুবকদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও অগ্রিম টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠছে। ইতোপূর্বে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়ায় চাকরির নামে কাউকে টাকা পয়সা ও পাসপোর্ট না দেয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সর্তক করেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা মহামারির পর মালয়েশিয়ার বিভিন্ন খাতে প্রচুর অভিবাসী কর্মীর সঙ্কট দেখা দিয়েছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে মালয়েশিয়ার কেডিএন (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) অভিবাসী কর্মী নিয়োগের জন্য অনুমতি চেয়ে লক্ষাধিক চাহিদাপত্র জমা দিয়েছে দেশটির নিয়োগকর্তারা। মালয়েশিয়া থেকে একাধিক সূত্র এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বিদেশি কর্মীনির্ভর মালয়েশিয়া কতটা কর্মী সঙ্কটে আছে তা গত এক সপ্তাহে মালিকপক্ষের আবেদনে এ চিত্র ফুটে উঠেছে। মালয়েশিয়ায় বিদেশিকর্মী নিয়োগে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ১১ হাজার ৮০৭টি আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৭৭ হাজার ৮৪৮টি উৎপাদন (শ্রমিক) খাতে। বৃক্ষরোপণ ১৩ হাজার ১১৯, পরিষেবা ১০ হাজার ৬১১, নির্মাণ ৮ হাজার ৫৩০ ও কৃষিতে ১ হাজার ৬৯৯টি আবেদন এসেছে। চলতি মাসের ১৫-২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসব আবেদন করা হয়। দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানের এক বিবৃতিতে রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বার্নামা বরাত দিয়ে তথ্য নিশ্চিত করা হয়।

এম সাভারানান জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে যখন আবেদন নেয়া শুরু হয়েছিল তখন কিছু নিয়োগকর্তার অনলাইন আবেদনে সমস্যা হয়েছিল। করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রথম মুভমেন্ট কন্ট্রোল অর্ডার (এমসিও) বাস্তবায়নের পর ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে বিদেশি কর্মীদের আবেদন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। কর্মী সঙ্কট মোকাবিলায় ১৫ ফেব্রুয়ারি পুনরায় চালু করার পর এত সংখ্যক আবেদন এসেছে যাহা চাহিদার চেয়েও বেশি। এম সারাভানান জানান, নিয়োগকর্তাদেরও বেসরকারি খাতের কর্মসংস্থান সংস্থার (এপিএস) মাধ্যমে আবেদন করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল, যা আগে শুধুমাত্র গৃহকর্মীর জন্য অনুমোদিত ছিল। সম্প্রতি নিয়োগকর্তা ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোর সঙ্গে একটি বৈঠকের সময়, সমস্যার বিষয়ে অবহিত করা হয়েছিল। তারা এই উদ্দেশে এপিএস-এর পরিষেবাগুলো ব্যবহার করেছে। এপিএস নিয়োগকর্তাদের পক্ষ থেকে আবেদন করতে পারেন এই শর্তে যে আবেদনগুলো সংশ্লিষ্ট নিয়োগকর্তাদের অনুমতি নিয়ে জমা দেয়া হবে বলেও জানিয়েছেন মানব সম্পদমন্ত্রী।

উল্লেখ্য, গত ১০ ডিসেম্বর সারাভানান বলেছিলেন, ‘দেশটি কিছু ছিু সেক্টরে নোংরা, বিপজ্জনক, কঠিন সেক্টরগুলোতে তীব্র কর্মী সঙ্কটের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যেমন, বৃক্ষরোপণ, উৎপাদন, উন্নয়ন, কৃষি। সরকার পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী অবশ্যই মালয়েশিয়া প্রবেশের ক্ষেত্রে কর্মীদের প্রবেশের জন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি (এসওপি) মেনে চলতে হবে যা গত ১৪ ডিসেম্বর কোভিড-১৯ কোয়ার্টেট মিনিস্টার মিটিং দ্বারা অনুমোদিত হয়েছিল।
হাজরে আসওয়াদ ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের ওভারসীজ ডিরেক্টর মো. দেলোয়ার হোসেন গতকাল বুধবার ইনকিলাবকে জানান, মালয়েশিয়ায় অভিবাসী কর্মীর সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করছে। দেশটির বিভিন্ন খাতে অভিবাসী কর্মীর জন্য চলছে হাহাকার। তিনি জানান, গত ৭ ফেব্রুয়ারি দেশটির শ্রী পোমা প্লান্টিব ইন্ডাস্ট্রিজ এসডিএনবিএইচ ডি, পেপার বেইজ কনভার্টিং এসডিএন বিএইচডি, এম কে এম ইলেক্ট্রনিক্স এসডিএন বিএইচডি, লোটস প্লানটেশন এসডিএন বিএইচডি ও গামা উড এসডি এন বিএইচডি কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার জন্য চাহিদাপত্র অনুমোদনের জন্য কেডিএন (স্বারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে) এ কাগজপত্র জমা দিয়েছে। তিনি বলেন, আল আরাফা এভিয়েশন ও হাজরে আসওয়াদ ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস ইতোমধ্যে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের প্রায় ৯ হাজার ডিমান্ড লেটার পেয়েছে। কর্মী সঙ্কট মোকাবিলায় আরো অনেক আবেদন জমা হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এক প্রশ্নের জবাবে জনশক্তি রফতানিকারক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, দীর্ঘ দিন পর মালয়েশিয়ায় কর্র্মী নিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তির দু’মাস পরেও কর্মী প্রেরণে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কোনো তাৎপরতা চোখে পড়ছে না। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার নিযোগকর্তারা বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। তিনি অনতিবিলম্বে দেশটিতে কলিং ভিসায় কর্মী প্রেরণ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করার জোর দাবি জানান।

গত ১৯ ডিসেম্বরে কুয়ালালামপুরে দুই দেশের মধ্যে এক সমঝোতা সইয়ের মাধ্যমে মালেশিয়ায় কর্মী পাঠানোর পথ উন্মুক্ত হয়। কথা ছিল জানুয়ারি থেকেই মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো শুরু হবে। কিন্তু জানুয়ারি শেষ হয়ে ফেব্রুয়ারিও বিদায় নিতে চলেছে। তারপরও দেশটিতে কর্মী পাঠাতে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
উল্লেখ্য, সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে বিমানভাড়াসহ মালয়েশিয়া অংশের সব খরচ নিয়োগদাতার বহন করার কথা। আর বাংলাদেশের অংশে পাসপোর্ট তৈরি, কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, কল্যাণবোর্ড সদস্য ফিসহ আনুষাঙ্গিক খরচ কর্মীর বহন করার কথা রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে এখনো কারিগরি বিষয়ই চূড়ান্ত করা যায়নি। যদিও কর্মকর্তাদের দাবি এ নিয়ে কাজ করছেন তারা।
সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর নতুন বছরের শুরুতেই কর্মী পাঠানোর কথা বলেছিলেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। ওই সময় তিনি বলেন, ‘যে সিন্ডিকেটের কারণে ২০১৮ সালে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে সিন্ডিকেট এবার সুযোগ পাবে না। দেশের সব নিবন্ধিত রিক্রুটিং এজেন্সিই মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে পারবে।’ সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে প্রবাসীমন্ত্রী বলেন, আমি সিন্ডিকেটের পক্ষেও না বিপক্ষেও না। আমি চাই আমাদের গরিব দেশের মানুষগুলো বাঁচুক। তারা যাতে কম টাকায় দেশটিতে যেতে পারে সে দিকেই নজর রাখছি।

এদিকে, গত জানুয়ারিতে ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে ২৫০ এজেন্ট সম্বলিত একটি গ্রুপের নাম আসে সামনে। আর সেটা পাঠানো হয় মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকেই। এরপর থেকে রিক্রুটিং এজেন্সি ব্যবসায়ীরা নানাভাবে এর প্রতিবাদ করে আসছে। তাদের দাবি, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে গুটি কয়েক এজেন্সির সুযোগ থাকলে আগের মতো বাজার শুরু করাই মুশকিল হয়ে পড়বে। বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারকরা এরই মধ্যে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে কয়েক দফা দাবি জানিয়েছেন সরকারের কাছে।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ সম্প্রতি গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘নিজেদের কর্মীদের স্বার্থে যতটা সম্ভব দেনÑ দরবার অব্যাহত রাখব।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘অভিবাসন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ রাখাই এবার অন্যতম লক্ষ্য।’ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে কারিগরি বিষয় নিয়ে কাজ চলছে। মালয়েশিয়া কর্মী যেতে মাথাপিছু অভিবাসন ব্যয় কত হবে, ডাটা ব্যাংকে কীভাবে নিবন্ধন করতে হবে এসব ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় কোনো কার্যকরী উদ্যোগ নিতে পারেনি। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সূত্র জানায়, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএমইটির ডাটা ব্যাংক থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো হবে।

মালয়েশিয়া থেকে প্রবাসী সাংবাদিক এম এ আবির জানিয়েছেন, দেশটির নিয়োগকর্তারা বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগ দিতে বেশি আগ্রহী। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশটি নিয়োগ দাতাদের কাছ থেকে কর্মী চাহিদার আবেদন গ্রহণ করছে। ইতোমধ্যে প্রায় দেড় লাখ কর্মীর চাহিদা জানিয়ে নিয়োগদাতারা আবেদন করেছেন। এর মধ্য থেকে ৩০ হাজারের বেশি কর্মীর চাহিদাপত্রে অনুমোদনও দিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য মেয়াদোত্তীর্ণ পুরনো চাহিদাপত্র নতুন করে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে মালয়েশিয়া অংশে কর্মী নিয়োগের কাজ শেষ পর্যায়ে থাকলেও সমঝোতা স্মারক সইয়ের দুই মাস পার করেও কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে কবে নাগাদ মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি কার্যক্রম শুরু হবে তা নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছে না।

(৮ই জানুয়ারি) সকালে মালয়েশিয়ার গণমাধ্যম দ্য ফ্রি মালয়েশিয়া টুডে তে দেয়া এক বিবৃতিতে দেশটির নিয়োগকর্তাদের অ্যাসোসিয়েশন এসএমই এর সেক্রেটারি জেনারেল মিস্টার চিন চি চিওং বলছেন, বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার ক্ষেত্রে সব খরচ মালিককে যে বহন করতে হবে সেটা বাধ্যতামূলক নয়, সেটা ঐচ্ছিক হিসেবে বিবেচিত হবে যদিও এমওইউ এর চুক্তিতে সেটা বাধ্যতামূলক বলা হয়েছে। বিমান ভাড়া, কোয়ারেন্টিন, অভিবাসনসহ যে খরচ হবে এটা মালিকদের জন্য বাড়তি বোঝা। তবে যাদের কর্মী জরুরি প্রয়োজন তারা সব খরচ বহন করে কর্মী আনতে পারবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মালয়েশিয়া

৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ