দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
রজবের পরিচয়: রজব ইসলামি বর্ষপঞ্জির ৭ম মাস। রজব শব্দের অর্থ সম্মান করা। ইসলামে চারটি পবিত্র মাসের একটি রজব। যে মাসে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ। নবুয়্যতের পূর্ব থেকে এবং প্রাক ইসলামি যুগে আরবদের মাঝেও এই চার মাস সময় যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিলো একপ্রকার, যদিও তা ধর্মীয় কোনো বিধিনিষেধের অর্ন্তভূক্ত কোনো বিধান নয়, বরং মানবরচিতই ছিলো। বিশ^মানবতার মুক্তির দূত বিশ^নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দিনাতিপাত করতেন সুন্দর জীবনাচারের খুঁজে ও শান্তির সাগরে মণিমুক্তা আহরণ করে। এক হাদিসে আবু বাকরাহ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সময় আবার ঘুরে তার নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ফিরে এসেছে। যে পদ্ধতিতে আল্লাহ আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন সেদিনের মতো। মাসের সংখ্যা ১২টি। তার মধ্যে চারটি হচ্ছে হারাম মাস। তিনটি পর পর জিলকদ, জিলহজ ও মহররম। আরেকটি হলো রজব মাস, যা জমাদিউস-সানি ও শাবান মাসের মাঝখানে থাকে।’ (বুখারি, হাদিস: ৪৬৬২, মুসলিম, হাদিস: ১৬৭৯)
রজবে ভিত্তিহীন প্রচলিত আমল: অন্যান্য আরবি মাসের মতো এই রজব মাসেও বিভিন্ন প্রকার আমল, রেওয়াজি বেদআত বা ধর্মের নামে কুসংস্কার প্রচলিত আছে। কুরআন, হাদিস ও ইসলামিক স্কলারগণ যেগুলোর বিষয়ে অপসংস্কৃতি বলে মত প্রকাশ করেছেন। এবার আমরা এমন কিছু আমলের কথা উল্লেখ করছি।
নামায: এই মাসে এক শ্রেণির তথাকথিত আলেম নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নামায, নির্দিষ্ট সংখ্যার রোজা সহ আরও বিভিন্ন মানবরচিত আমলের কথা বলে সাধারণ মানুষকে দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। অষ্টম শতকের বিখ্যাত হাদিস বিশারদ হাফেয ইবনে রজব রাহ. বলেন, রজব মাসের নির্দিষ্ট কোনো নামায প্রমাণিত নয়। (লাতায়েফুল মাআরেফ প্র. ২২৮)
রজব মাসের নামায বিষয়ে কিছু ভিত্তিহীন বর্ণনা: মাসিক আলকাউসারে রজব মাসের নামায বিষয়ে কিছু ভিত্তিহীন বর্ণনা এনে বলা হয়, বার চাঁদের আমল শিরোনামের কিছু কিছু পুস্তিকায় রজব মাসের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভিত্তিহীন বর্ণনার সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। একটি বইয়ে লেখা হয়েছে-
১. রজব মাসের প্রথম তারিখে মাগরিবের নামায ও ইশার নামাযের মাঝখানে বিশ রাকাত নফল নামায পড়বে। প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাস ৩ বার, সূরা কাফিরূন ৩ বার পড়বে। তাহলে আল্লাহ পাক হাশরের দিন তাকে শহীদের দলের সহিত উঠাবেন এবং আল্লাহ পাকের নিকট সে বড় আবেদ বলে গণ্য হবে।
২. রজব মাসের প্রত্যেক জুমার দিন জুমার পর আসরের নামাযের আগে চার রাকাত নামায এক সালামে পড়বে। প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহার পর ৭ বার আয়াতুল কুরসি ও পাঁচবার সূরা ইখলাস পড়বে...।
৩. এই মাসের ১৫ তারিখকে শবে ইস্তেফতাহ বলা হয়। যে ব্যক্তি এই রাত্রিতে ৭০ রাকাত নফল নামায দুই রাকাত করে পড়বে...।
৪. ১৫ তারিখ রাতে তাহাজ্জুদের নামাযের সময়ে ৫০ রাকাত নফল নামায দুই রাকাত করে পড়বে...তার সমস্ত দুআ কবুল করা হবে, কবর আলোকিত হবে এবং শহীদদের সাথে তার হাশর হবে এবং পয়গাম্বারদের সঙ্গে সে বেহেশতে যেতে পারবে।
৫. ১৫ তারিখ দ্বিপ্রহরের পর গোসল করে আট রাকাত নফল নামায পড়বে; দুই রাকাত করে। প্রত্যেক রাকাতে...।
রোজা: রজব মাসে রোজা রাখার ফযিলত নিয়ে শাফেয়ী মাযহাবের ফকিহ এবং মুসলিম ব্যক্তিত্ব নবম হিজরির বিশ^বিখ্যাত হাদিস গবেষক বুখারী শরীফের প্রসিদ্ধতম ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফতহুল বারীর ব্যাখ্যাকার আহমদ বিন আলী বিন মুহাম্মদ, হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন, রজব মাসের ফযিলত, রজব মাসে রোযা রাখার ফযিলত বা রজব মাসের নির্দিষ্ট কোনো দিন রোযা রাখার ফযিলত অথবা রজব মাসের নির্দিষ্ট কোনো রাতে নামায-ইবাদত করার ফযিলত সম্পর্কে প্রমাণ হওয়ার উপযুক্ত কোনো হাদিস নেই। (তাবয়ীনুল আজাব বিমা ওয়ারাদা ফী শাহরি রাজাব, পৃ. ১১) পাশাপাশি রজব মাসকে ঘিরে কিছু কুসংস্কারও আছে, যেমন রজব মাসে হাজারি রোজা বলতে কোনো রোজা নেই। এটি বানোয়াট। (কিতাবুল মাওদুয়াত, ইবনুল জাওজি : ২/২০৮, তালখিসুল মাওদুয়াত, পৃ. ২০৯)
শিরকি রেওয়াজ: ইসলাম পূর্ব জাহেলী যুগে রজব মাসে মুশরিকদের মধ্যে স্বীয় দেবতা/প্রতীমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু যবাই করার একটি রেওয়াজ ছিল। একে ‘আতীরা’ বলা হত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই শিরকি রেওয়াজের মূলোৎপাটন করেছেন। স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘ইসলামে ‘ফারা’ (উট বা বকরির প্রথম বাচ্চা প্রতীমার উদ্দেশ্যে) জবাই করার কোনো প্রথা নেই এবং ‘আতীরা’ও নেই। অর্থাৎ রজব মাসে প্রতীমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু জবাই করার প্রথাও নেই।’ (সহীহ বুখারী ২/৮২২)
রজব মাসের মৌলিক শিক্ষা: রজবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা: রজব মাসে সমস্ত প্রকার জুলুম ও নির্যাতন এবং অত্যাচার ও অনাচার থেকে নিজেকে দূরে রেখে এই মাসের প্রতি সম্মান দেখানোর কথা বলা হয়েছে হাদিস শরিফে। তাই রজব একটি সম্মানিত মাস। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, বারো মাসে বছর। তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি ধারাবাহিক: যিলকদ, যিলহজ্ব, মহররম আর চতুর্থটি হল রজব, যা জুমাদাল উখরা ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী মাস।’ (সহীহ বুখারী ২/৬৭২)
অত্যাচার করা যাবে না: রজবের শিক্ষা বলতেই শান্তির বাণী। এই পবিত্র মাসসহ জিলকদ, জিলহজ ও মহররম মাসে অশান্তির সব উপকরণের অগ্রভাগ নিম্নদিক করে রাখার আদেশ দেওয়া হয়। মুর্খতা ও বর্বতার যুগে কেনো ইসলামি যুগেও তার ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও তা ইসলামি শরিয়তে সম্পূর্ণ নিরাপত্তার বিধান জারি করে বলা হয়, তোমরা এই মাসসমূহে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।’ (সূরা তাওবা: ৩)
ইবাদতের প্রতি যত্নবান: রজব মাসের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে ইসলামিক স্কলারগণ রমজানের প্রস্তুতিমূলক রজব মাস থেকে ইবাদতের প্রতি যত্নবান হওয়ার কথা বলেছেন। গবেষণায় পাওয়া যায়, রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মহররম মাসে আমলের প্রতি যত্নবান হলে বাকি আট মাসে আমল করা সহজ হয়। তার অন্যতম কারণ হলো, রজব ও শাবানে রমজান মাসের প্রস্তুতি নিয়ে রমজান মাসে গুরুত্বসহকারে আমল করে তখন বাকি মাসগুলোতে সময় মতো আমল করা যায়। আহকামুল কুরআন গ্রন্থে বলা হয়, আশহুরে হুরুমে ইবাদতের প্রতি যত্নবান হলে বাকি মাসগুলোতে ইবাদতের তাওফীক হয়। আর আশহুরে হুরুমে কষ্ট করে গুনাহ থেকে বিরত থাকতে পারলে অন্যান্য মাসেও গুনাহ পরিহার করা সহজ হয়। (আহকামুল কুরআন, জাসসাস ৩/১১১; মাআরিফুল কুরআন ৪/৩৭২) গবেষণাময় ধর্মীয় পত্রিকা মাসিক আলকাউসারে বলা হয়, আশহুরে হুরুমের অন্তর্গত রজব মাসের মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট হওয়া উচিত। তবে স্মরণ রাখা উচিত যে, শরীয়তের পক্ষ থেকে এ মাসের জন্য বিশেষ কোনো নামায, বিশেষ কোনো রোযা বা বিশেষ পদ্ধতির কোনো আমলের হুকুম দেওয়া হয়নি। রজব মাসের বরকত ও ফযিলত হাসিল করার জন্য অন্যান্য মাসে পালনীয় ফরয ইবাদতগুলো যথাযথভাবে পালন করতে হবে এবং নফল ইবাদত বেশি বেশি করতে হবে।
নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না: এই মাসে নিজেদের প্রতি জুলুম, অবিচার না করার জন্য আল্লাহ তাআলা বারো মাসের মধ্যে চারটি মাসকে ‘আশহুরে হুরম’ তথা সম্মানিত ঘোষণা করেছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারোটি আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকে। সুতরাং তোমরা এই মাসসমূহে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। (সূরা তাওবা: ৩)
দু’আর প্রতি যত্নবান হওয়া: দু’আ ও মুনাজাত হলো মুমিনের প্রশান্তির বাতিঘর। হাদিসের ভাষায় দু’আকে সতন্ত্র ইবাদত বলে ঘোষণা করা হয়। অন্য এক হাদিসে এসেছে, “দু’আ হলো ইবাদতের মূল।” তবে এই মাসে র্নিভরযোগ্য দু’আ কোনো না থাকলেও সুন্দর অর্থ সম্বলিত যেকোনো দু’আ আমরা পড়তে পারি। সেই হিসাবে অর্নিভরযোগ্য যে দু’আটি আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে সেই দু’আর অর্থ সুন্দর তাই পড়তে পারি। তবে দু’আর হাদিসে যিয়াদুন নুমাইরিয়্যু নামে একজন বর্ণনাকারী আছেন, যিনি মিথ্যুক। তাই তার বর্ণিত হাদিসের নির্ভরতা নিয়ে হাদিস বিশারদগণ তার ব্যাপারে বলেছেন, তিনি মিথ্যুক।
ক্ষণস্থায়ী ও নশ^র দুনিয়ার মোহে পড়ে আমরা যেনো স্থায়ী জগতের কথা মোটেই ভুলে না যাই। ভুলে না যাই আমাদের প্রতিপালক মহান আল্লাহকেও, যিনি আমাদের সর্বশেষ আশ্রয় হিসাবে প্রতি মুহূর্তে আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন। আল্লাহর নিয়ামতের মধ্যে আমাদের অন্যতম পাথেয় হলো সময়। হাদিসের ভাষায় ইহজগতকে পরজগতের ফসল-ক্ষেত্র। তাই, আসুন, আমরা আমাদের ব্যস্ততায় আমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে দৈনিক পাঁচবার ও সকাল-বিকাল মময় দিই, যাতে তিনি আরও বেশি মুহব্বত করে আমাদের কুরআন-হাদিস মতো আমল করার তাওফিক দান। আমিন।
লেখক, সাবেক শিক্ষাসচিব, আশরাফুল উলুম মাদরাসা, ডেমরা, ঢাকা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।