Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

লোহার শিকলবন্দি ভাইবোন

এম. এ. কুদ্দুছ, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ) থেকে | প্রকাশের সময় : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৩ এএম

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার আচমিতা ইউনিয়নের গনেরগাঁও গ্রামে মানষিক ভারসাম্য হারিয়ে আছমা আক্তার (৩৩) ও তারই আপন ছোট ভাই জাহাঙ্গীর (২৬) তিন বছর যাবত লোহার শিকলে বন্দি। একই পরিবারের ২ ভাইবোনকে দু’চালা বসতঘরের আঙ্গিনায় গাছের সাথে ভাই জাহাঙ্গীর ও সিমেন্টের খুঁটির সঙ্গে বোন আছমাকে পশুর মতো বেঁধে রাখা হয়েছে। রাতদিন, রোদ বৃষ্টি, শীত ও গরম সবসময়ই ঘরের বাহিরে শিকলবন্দি থাকেন তারা। ঘরের ভিতরে তাদেরকে শিকলবন্দি করে রাখলে ঘরের বেড়া, দরজা ও জিনিসপত্র ভেঙে ফেলে। ফলে তাদেরকে পরিবারের লোকজন বাহিরে রাখতে বাধ্য হয়েছে।
নির্মম এ দৃশ্যটি যে কাউকেই ব্যথিত করবে। কিন্তু জাহাঙ্গীর ও আছমার হতদরিদ্র পরিবারের পক্ষে এ ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। টাকার অভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন সন্তান দু’টির চিকিৎসা করাতে পারেননি দরিদ্র দিনমজুর পিতা ফজলু মিয়া (৭২)। সন্তান দুটি যাতে হারিয়ে না যায়, সে কারণে শিকল দিয়ে তাদের বেঁধে রাখার চেষ্টা।
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার আচমিতা ইউনিয়নের গনেরগাঁও গ্রামে দিনমজুর ফজলু মিয়ার চার মেয়ে ও এক ছেলে। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ফজলু মিয়া। বয়সের ভারে এখন মজুরির কাজও করতে পারছেন না। প্রতিদিন কাজের জন্য বেরিয়ে যাওয়ার পর কখনো বাড়িতে ফিরে আসেন, নয়তো কখনো অন্যের ঘরে রাত কাটান ফজলু মিয়া।
জানা যায়, সংসারের দারিদ্র্যতা ঘোচাতে ১৫ বছর বয়সে আছমা ঢাকায় এক পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। সংসারে মা বাবাকে টাকা পাঠানোর পাশাপাশি নিজের ভবিষ্যতের জন্য কিছু টাকা জমাও রাখতেন একজনের কাছে। দীর্ঘ পাঁচ বছরে বেশ টাকা জমা হয়। হঠাৎ করেই জমানো টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায় লোকটি। এরপর আছমা চাকরি ছেড়ে দেয়। হারিয়ে ফেলে মানসিক ভারসাম্য। একমাত্র ছেলে জাহাঙ্গীর শ্রমিকের কাজ ও ঝালমুড়ি বিক্রি করতেন। মানষিক ভারসাম্যহীন বড় বোন আছমা আক্তার ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর, মা ফজিলা বেগমকে ইট দিয়ে মাথায় আঘাত ও ছোট ভাই জাহাঙ্গীরকে মারপিট করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে জাহাঙ্গীর একসময় বোন আছমা আক্তারকে মারপিট করে। এ ঘটনার পর থেকে জাহাঙ্গীর ও আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। বয়সের ভারে মা ফজিলা খাতুন ঠিকমত চোখে দেখেন না।
দরিদ্র দিনমজুর বাবা ফজলু মিয়ার পক্ষে মানুষিক প্রতিবন্ধী ছেলে মেয়েও স্ত্রীর চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। তাদের পাগলামির মাত্রা বেড়ে গেলে পায়ে শিকল পেঁচিয়ে তালা মেরে বেঁধে রাখেন। এভাবেই চলছে তাদের রাতদিন ও বছরের পর বছর।
দিনমজুর ফজলু মিয়ার অভাবের সংসার। ছোট্ট একটি ভাঙা ঘরে একটি চৌকি ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। বাড়িতে ঢুকতেই দেখা যাবে গাছের সঙ্গে জাহাঙ্গীরকে আর আছমাকে সিমেন্টের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। মানুষ দেখলেই তারা শিকল দেখিয়ে খুলে দেয়ার ইশারা করে।
জাহাঙ্গীর ও আছমা খাতুনের মা ফজিলা খাতুন জানান, তারা ঘরের মালপত্র, খাবার ও অন্যের বাড়ির মালামাল নষ্ট করে ফেলে। তাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে এবং হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে শিকল দিয়ে তাদের বেঁধে রেখেছি। টাকার অভাবে তাদের মুখে খাবারই দিতে পারি না, চিকিৎসা করাবো কিভাবে।
আচমিতা ইউনিয়নের সমাজকর্মী রাজিব সরকার পলাশ জানান, আছমা ও জাহাঙ্গীর নামে দুই অসহায় প্রতিবন্ধী ভাই বোনের চিকিৎসার জন্য আমরা আশ্রয় সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে ফেসবুকে সহযোগীতা চাইলে প্রবাসী ও এলাকার লোকজনের সহযোগীতায় তাদের চিকিৎসা ও খাবারের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। প্রতি সপ্তাহে দুই তিন বার আমরা খোঁজ খবর নিতে তাদের বাড়িতে যাই। চিকিৎসার জন্য সরকারের সহযোগীতা একান্ত প্রয়োজন। উন্নত চিকিৎসা না হলে দুইটি প্রাণ অকালে ঝরে যেতে পারে
উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা মইনুর রহমান মনির জানান, উপজেলার আচমিতা ইউনিয়নের গনেরগাঁও গ্রামে দিনমজুর ফজলু মিয়ার প্রতিবন্ধী মেয়ে আছমা আক্তার ও ছেলে জাহাঙ্গীরকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দেয়া হয়েছে। অন্যকোনভাবে সরকারি সহযোগীতা করা যায় কিনা এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নেব।
কটিয়াদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাকুর রহমান জানান, অর্থের অভাবে তাদের চিকিৎসা হচ্ছে না। তাই ভাই-বোন শিকলে বাঁধা অবস্থায় রয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক। আমি উপজেলা পরিষদ ও ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করব।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ