দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মারিয়া বিনতে শামউন কিবতিয়া (রা.)। প্রিয়নবীর দাসী। নবীপুত্র ইবরাহিমের (রা.) মা। তিনি মূলত মিশরের অধিবাসী। মিশরের হাফান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.) তাঁর খেলাফতকালে এ মহিয়সী নারীর সম্মানার্থে ওই গ্রাম থেকে কর মাফ করে দিয়েছিলেন। তিনি প্রথমে খ্রিস্টান ছিলেন। ইস্কান্দারিয়ার স¤্রাট মুকাওকিস তাকে নবীজির কাছে উপঢৌকন হিসেবে পাঠিয়েছিল। সময়টি ছিল ৭ম হিজরির ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির পর।
সম্রাট মুকাওকিস নবীজির কাছে মারিয়া কিবতিয়ার (রা.) সঙ্গে আরও কিছু মূল্যবান জিনিসও হাদিয়া করেছিল। তার মধ্যে ছিল মারিয়ার বোন শিরিন, একহাজার মিসকাল স্বর্ণ, ২০টি মোলায়েম কাপড়, তার নিজস্ব খচ্চর দুলদুল এবং উফাইর নামে তার একটি গাধা। এ সবকিছু স¤্রাট পাঠিয়েছে সাহাবি হাতেব ইবনে বালতাআ (রা.)-এর সঙ্গে করে। তিনিই মূলত মারিয়াকে (রা.) ইসলাম গ্রহণ করার জন্য উৎসাহিত করেন। এতে করে তিনি ও তাঁর বোন ইসলাম গ্রহণ করেন। (আল ইসাবাহ, ইবনে হাজারকৃত : ৮/৩১০)। মারিয়াকে নবীজি নিজের জন্য নির্বাচন করেন আর তাঁর বোন শিরিনকে কবি সাহাবি হাসসান বিন সাবেত (রা.)-এর জন্য দিয়ে দেন। মারিয়া ছিলেন খুবই সুদর্শনা। চুলগুলো ছিল কোঁকড়ানো। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ বলেছেন, সে সময়ে আরবদের মধ্যে তাঁর মতো গুণবতী নারী চোখে পড়ত না। মহানবী (সা.) তাকে খুবই মর্যাদা দিতেন। তাকে কুবায় রেখেছিলেন। মাঝে-মধ্যে তাঁর কাছে তাশরিফ নিয়ে যেতেন। দাসী হিসেবে অন্তরঙ্গ হতেন। এজন্য তার ওপর পর্দার বিধান আরোপ করেন। ৮ম হিজরির জিলহজ মাসে তাঁর গর্ভে আসে নবীপুত্র ইবরাহিম। নবীপতœীরা তার সঙ্গে বরাবরই ঈর্ষা করতেন, তখন এটার মধ্যে আরও মাত্রা বৃদ্ধি পায়। (আততবাকাতুল কুবরা : ৮/২১২, ১/১৩৫; আসসিরাতুন নববিয়্যাহ : ৪/৬০১)। নবীপতœী আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি কোনো নারীর ওপর এতটুকু ঈর্ষা করতাম না, যতটুকু ঈর্ষা করতাম মারিয়ার ওপর। কারণ, তিনি ছিলেন খুবই সুদর্শনা। রাসুলও ছিলেন তাঁর প্রতি মুগ্ধ।
মদিনায় এক বছর না কাটতেই মারিয়া গর্ভবতী হলে নবীজি এ সংবাদ শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। নবীজির বয়স ছিল তখন ৬০ এর কাছাকাছি। কন্যা ফাতেমা (রা.) ছাড়া আর কোনো সন্তান তখন জীবিত ছিল না। তাঁর সন্তান ইবরাহিম দেখতে পুরো রাসুলের মতো ছিল। নবীজি জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর নামানুসারে নাম রাখলেন ইবরাহিম। ইবরাহিম জন্মের মাধ্যমে মারিয়া স্বাধীনা হন। মুফাসসির স¤্রাট ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মারিয়া সন্তান জন্ম দিলে রাসুল (সা.) বললেন, তাঁর সন্তান তাকে স্বাধীন করে দিয়েছ। পুত্র ইবরাহিম একবছর কয়েক মাস মহানবী (সা.)-এর কোমল তত্ত¡াবধানের সৌভাগ্য অর্জন করে। কিন্তু দুই বছরে পা দেওয়ার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তাঁর অসুস্থতা বেড়ে যায় এবং দশম হিজরির রবিউল আওয়াল মাসের ১০ তারিখ মঙ্গলবার ইন্তেকাল করে। মোটে ১৬ মাস বয়স হয়েছিল তাঁর। পুত্রের ইন্তেকালে মা মারিয়া অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। (নিসাউর রাসুল ওয়া আওলাদুহু, পৃষ্ঠা : ৭৫)।
মর্যাদা : মারিয়া ছিলেন একজন মর্যাদাশীল নারী। পবিত্র কোরআন ও সিরাতের বিভিন্ন পর্বে তাঁর মর্যাদা দেদীপ্যমান। তাঁর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে মহান আল্লাহ সুরা তাহরিমের শুরুর কয়েকটি আয়াত নাজিল করেন। নবীজি তাকে হারাম করতে চাইলে আল্লাহ তাকে নিষেধ করেন। আলেম, ফকিহ, হাদিসবিশারদ ও তাফসিরকাররা তাদের হাদিস ও রচনাবলিতে তাঁর আলোচনা করেছেন। ইন্তেকালের সময়ও মহানবী (সা.) তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন।
মৃত্যু : তিনি ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালে ১৬ হিজরির মুহাররম মাসে ইন্তেকাল করেন। ওমর (রা.) জানাজায় অংশগ্রহণের জন্য মানুষজন জমা করেন। মুহাজির ও আনসার সাহাবিদের বড় একটি জামাত তাঁর জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। ওমর (রা.) বাকি‘ নামক স্থানে তাঁর জানাজার নামাজ পড়ান। পুত্র ইবরাহিম ও নবীপতœীদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। ইবনে মুনদা (রহ.) বলেন, মারিয়া মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পাঁচ বছর পর ইহলোগ ত্যাগ করেন। (আল ইসাবাহ, ইবনে হাজারকৃত : ৮/৩১১)।
তিনি কি উম্মাহাতুল মোমিনিনদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন?
তিনি উম্মাহাতুল মুমিনিনদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন কি না, যদি উম্মাহাতুল মুমিনিন না হয়ে থাকেন, তাহলে মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর কি অন্য কারও জন্য তাকে বিয়ে করা বৈধ ছিল? কিংবা রাসুলের পরে অন্য কারও দাসী হওয়া বৈধ ছিল? এ ব্যাপারে গবেষকদের মত হলো, উম্মুল মুমিনিন ওই নারীর জন্যই ব্যবহার হবে যার সঙ্গে রাসুলের বিয়েবন্ধন হয়েছে, অতঃপর তিনি তার সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। ‘আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ’ এ এসেছে, ফকিহদের বিভিন্ন বক্তব্যে পাওয়া যায় যে, তারা উম্মুল মুমিনিন ওই নারীর জন্যই ব্যবহার করেন যার সঙ্গে মহানবীর বিয়েবন্ধন হয়েছে, অতঃপর দৈহিক মিলন হয়েছে, যদিও অগ্রগণ্য মতানুসারে এর পরে তিনি তাদের তালাক দিয়ে দেন না কেন। এ হিসেবে মহানবী যার সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু মিলিত হননি তার জন্য উম্মুল মুমিনিন শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। আর যার সঙ্গে রাসুল বিয়ে ছাড়া কেবল বাদী হিসেবে মিলিত হয়েছেন তাকেও উম্মুল মুমিনিন বলার অবকাশ নেই। যেমন মারিয়া কিবতিয়া। বিষয়টির সত্যায়ন মিলে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতে। আল্লাহ বলেন, ‘তাঁর (মহানবীর) স্ত্রীরা তাদের মা।’ [সুরা আহজাব : ৬] (আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ আল কুয়েতিয়্যাহ : ৬/২৬৪-২৬৫)।
বুঝা গেল, মারিয়া কিবতিয়া উম্মাহাতুল মুমিনিনদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। কেননা মহানবী (সা.) তাঁর সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হননি। বাদী হিসেবে তাকে ব্যবহার করেছেন। ফলে তাঁর গর্ভে ইবরাহিম জন্ম হওয়ার পরও তিনি উম্মাহাতুল মোমিনিনদের অন্তর্ভুক্ত হননি। তবে মহানবীর ইন্তেকালের পর তাকে অন্য কেউ বিয়ে করা বৈধ ছিল না। ‘শরহুল খারাশি লি মুখতাসারি খলিলিল মালেকি’ গ্রন্থে এসেছে, নবীজির বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, নবীজি যার সঙ্গে দৈহিক মিলন করেছেন এবং তাকে রেখে ইন্তেকাল করেছেন, তালাক দেননি অন্য কারও জন্য তাকে গ্রহণ করা হারাম বলে বিবেচিত হবে। এমনিভাবে নবীজির বাদী এবং উম্মে ওলাদ যাকে রেখে তিনি ইন্তেকাল করেছেন, যাকে স্বাধীন করেছেন, বিক্রি করে দিয়েছেন তাদেরও অন্য কেউ গ্রহণ করতে পারবে না। অন্যভাবে বললে, বিষয়টি এমন দাড়ায়, নবীজির সহবাসকৃতা নারী চাই তিনি স্বাধীনা হোক কিংবা বাদী তাকে অন্য কারও বিয়ে করা বৈধ নয়। (শরহু মুখতাসারি খলিল : ৩/১৬১)।
হাত্তাব রুআইনি বলেন, নবীপুত্র ইবরাহিম জন্মের পরও মহানবী (সা.) মারিয়া কিবতিয়ার সঙ্গে দৈহিক মিলন করতেন। মহানবীর ইন্তেকালের পর তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়নি। তিনি তাকে সদকা করেও যাননি। মহানবীর পরে তিনি স্বাধীনা হয়ে যান। (মাওয়াহিবুল জালিল ফি শরহি মুখতাসারি খলিল : ৩/৩৯৮)। মহানবীর কয়জন বাদী ছিল? মহানবী (সা.)-এর চারজন বাদী ছিল। তাদের একজন হলেন মারিয়া কিবতিয়া। আবু ওবায়দা (রহ.)-এর বর্ণনামতে অপর তিনজন বাদী হলেন, ১. রাইহানা, ২. আরেকটি বাদী যাকে নবীজি লাভ করেন কিছু বন্দিদের মধ্যে। ৩. আরও একটি বাদী নবীজিকে দান করেন জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.)। (যাদুল মাআদ : ১/১১৪)।
লেখক : শিক্ষক, হাদিস ও ফতোয়া বিভাগ, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।