বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
আল ফাতাহ মামুন
আমার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় দীর্ঘদিন ধরে কিডনির অসুখের ভুগছেন। মাস দুয়েক আগে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অস্ত্রোপচার হয়। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় তিনি এখন সুস্থ আছেন। হাসপাতাল থাকাকালীন একবার তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। সে থেকেই একটি ‘অমানবিক কাঁটা’ আমার বিবেকে বিদ্ধ হয়ে আছে। গলার কাঁটা যেমন অনবরত অস্বস্তি দেয়, তেমনি এ কাঁটাও প্রতিনিয়ত অশান্তি দিচ্ছে। ‘জরুরি ভিত্তিতে একটি ‘বি’ পজিটিভ কিডনি বিক্রি করা হবে। আগ্রহী ক্রেতা নিচের নম্বরে যোগাযোগ করুন।’ কিডনি রোগ বিভাগের দেয়ালে সেঁটে দেওয়া এমন কিছু বিজ্ঞাপনই ‘অমানবিক কাঁটা’ হয়ে বিবেকে বারবার বিদ্ধ হচ্ছে এবং যন্ত্রণা দিচ্ছে।
কিডনির মতো অমূল্য সম্পদ মানুষ কেন এত অল্প দামে বিক্রি করে দেওয়া হবে- এ প্রশ্নের উত্তরও দেওয়া আছে ওই বিজ্ঞাপনের পাশেই সেঁটে দেওয়া আরেকটি বিজ্ঞাপনে। যোগাযোগের ঠিকানা ছাড়া বিজ্ঞাপনটি হুবহু তুলে ধরা হল- ‘একজন অসহায় মেয়ে আর্থিক কারণে তার কিডনি বিক্রি করবে। তার রক্তের গ্রুপ ‘বি’ পজিটিভ। বয়স ১৯ থেকে ২০ বছর।’ অর্থের প্রয়োজনে কিডনি বিক্রির এমন আবেদন সভ্য সমাজের জন্য যেমন বেমানান, তেমনি একটি স্বাধীন দেশের জন্যও চরম লজ্জাজনক। তা সত্ত্বেও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে, অনলাইনে, এমনকি বেশ কিছু জাতীয় পত্রিকায়ও এ ধরনের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। মূলত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়েই কিডনি বিকিকিনর এসব বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে। ১৯৯৯ সালের ১৩ এপ্রিল মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন প্রণয়ন করা হয়। তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘মানবদেহে সংযোজনযোগ্য যে কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ (যেমন- কিডনি, হৃৎপি-, যকৃত, অগ্ন্যাশয়, অস্থি, অস্থিমজ্জা, চর্ম ও টিস্যু ইত্যাদি) ক্রয়-বিক্রয় বা এর বিনিময়ে কোনো ধরনের সুবিধা লাভ এবং সেই উদ্দেশ্যে কোনো প্রকার বিজ্ঞাপন প্রদান বা অন্য কোনোরূপ প্রচারণা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কোনো ব্যক্তি এই আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অথবা লঙ্ঘনে সহায়তা করলে তিনি অনূর্ধ্ব সাত বছর এবং অন্যূন তিন বছর মেয়াদি সশ্রম কারাদ- অথবা অন্যূন ৩ লাখ টাকা অর্থদ-ে অথবা উভয় প্রকার দ-ে দ-িত হবেন।’
আইন আছে প্রয়োগ নেই। তাই তো কিডনি বিকিকিনির স্বর্গরাজ্য বা কালোবাজার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে লাল-সবুজের প্রিয় বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসা বিষয়ক প্রভাবশালী দৈনিক ‘পালস’ বাংলাদেশের অবৈধ কিডনি বাজার সম্পর্কে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এদেশে অর্থের বিনিময় কিডনিও কিনতে পাওয়া যায়। একশ্রেণির দরিদ্র অশিক্ষত মানুষ দালালের খপ্পড়ে পড়ে কিডনি পর্যন্ত বিক্রি করে দেয়। দালালরা তাদেরকে মোটা অংকের টাকার লোভ দেখিয়ে এ ধরনের কাজে রাজি করায়।’ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ১ লাখ ২৩ হাজারেরও বেশি রোগী কিডনি প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় রয়েছেন। তাদের জন্য ডোনার আছেন মাত্র ৫ হাজার। ডোনারদের উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশি নাগরিক। অর্থের বিনিময় কালোবাজারির মাধ্যমে বাংলাদেশের ‘কিডনি’ যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাষ্ট্র হয়ে অন্যান্য দেশে পাচার হচ্ছে। মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল ‘ভাইস নিউজ’ এক সচিত্র প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে কিডনি বিক্রির ‘বড় কালোবাজার’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশে কালোবাজারে একটি কিডনি বিক্রি করে পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার টাকা পান ডোনার। এ কিডনি স্থানান্তরের জন্য আছে কিছু নির্দিষ্ট হাসপাতাল। যারা কিডনি বিক্রি করেছেন, তারা একটি কিডনি নিয়ে নানান শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। তাদের একজন জানান, ‘মেয়ের বিয়ের জন্য কিডনি বিক্রি করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না’। আরেক যুবক বলছেন, ‘আমি, আমার স্ত্রী, মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই কিডনি বিক্রি করে দিয়েছি। আমার স্ত্রী কিডনি বিক্রির পর মারা গেছে’। ওই যুবকের মা বলেছেন, ‘পরিবারেরর সবার কিডনি বিক্রির পর আর কোনো উপায় না থাকায় আমারও একটি কিডনি বিক্রি করে দিই’।”
কিডনি সংগ্রহের জন্য দালালরা বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পাতেন। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উপার্জনের প্রলোভনে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সহজ-সরল ও দরিদ্র লোকদের ফুসলিয়ে ঢাকায় আনা হয়। এরপর আগেই ঠিক করে রাখা হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নিয়ে অচেতন করে দেহ থেকে কিডনি কেটে নেয়া হয় তাদের। পরে ওই অবস্থায় হত্যা করে লাশ বুড়িগঙ্গা বা অন্য কোনো নদীতে ফেলে দেয়া হয়। এমন ভয়াবহ তথ্য পাওয়া গেছে গত বছরের ২৯ আগস্ট ঢাকায় গ্রেপ্তার হওয়া কিডনি পাচারকারী চক্রের পাঁচ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের সময়। তারা বলেন, কিডনি সংগ্রহের জন্য কৌশলে মানুষকে অপহরণও করত তারা। গেল গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ‘বিদেশে কিডনি পাচার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, অবৈধভাবে সংগ্রহীত কিডনির বাণিজ্যিক কেন্দ্র ঢাকা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ব্যক্তির কিডনি সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠানো হয়। ঢাকা থেকে সংগ্রহীত কিডনি ভারত ও শ্রীলংকা হয়ে অন্যান্য দেশে যাচ্ছে। রাজধানীর আশপাশে নারায়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জের কয়েকটি ক্লিনিক এবং সাভারের একটি হাসপাতালে রক্ত পরিসঞ্চালনের নামে এর আগে কয়েকজনের কিডনি নেয়া হয়।
চিকিৎসা বিজ্ঞান ক্রমেই এগোচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশেই এখন কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। কিন্তু তা করা হয় সুনির্দিষ্ট আইন ও নীতিমালার ভিত্তিতে। বাংলাদেশেও ১৯৮৮ সাল থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কেনাবেচা বা বলপ্রয়োগের আশঙ্কা থাকায় কিডনি প্রতিস্থাপন আইনও করা হয়। কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় প্রায় দেড় দশক ধরে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের কিডনি দেদার বিকিকিনি চলছে। কখনো কখনো রক্তদানের নামে অজ্ঞান করে কিংবা অপহরণের পর জোরপূর্বকও চুরি করা হচ্ছে মানব দেহের মূল্যবান অঙ্গ কিডনি। আইনের কঠোরতা না থাকার সুযোগে কিডনির অবাধ কেনাবেচা কারোই কাম্য নয়। এতে শুধু যে ব্যক্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তা নয়, দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণœ হচ্ছে বহির্বিশ্বে। লাল-সবুজের পতাকায় কালো বাজারের ‘কালি’ মুছার দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই। কঠোরভাবে দমন করতে হবে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে অমানবিক ও নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো তৎপর হওয়া প্রয়োজন। এ ধরনের হীনকাজে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমেই কালো বাজারের ‘কালি’ ধুয়ে লাল সবুজে ¯œাত হবে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ধষভধঃধযসধসঁহ@মসধরষ.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।