Inqilab Logo

সোমবার ১১ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ কার্তিক ১৪৩১, ০৯ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শায়খুল ইসলাম হযরত আল্লামা মাওলানা হাবীবুল্লাহ (রহ)

আউলিয়াদের জীবন

প্রকাশের সময় : ৩ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ আবদুর রহীম ইসলামাবাদী
বাংলাদেশে প্রথম ও প্রধান কওমী মাদ্রাসা দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। হাটহাজারী মাদ্রাসা নামে এটি বহুলভাবে পরিচিত। হাটহাজারী মাদ্রাসা বাংলাদেশের প্রথম দাওরায়ে হাদীস (টাইটেল-হাদীস) মাদ্রাসা। বিখ্যাত মাদ্রাসাই আলীয়া কলিকাতার এক বছর আগে অর্থাৎ ১৯০৮ সনে হাটহাজারী মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদীস (টাইটেল) খোলা হয়। হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম হলেন শায়খুল ইসলাম হযরত আল্লামা মাওলানা হাবীবুল্লাহ কুরাইশী (রহ)। বড় মৌলভী সাহেব (রহ) নামে তিনি পরিচিত ছিলেন। বৃটিশ আমলে টাইটেল পাস আলেম ছিলেন খুবই কম। চট্টগ্রাম মুহসেনিয়া মাদ্রাসা ও কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় জামাতে উলা পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চালুছিল। ভারতের দিল্লী, দেওবন্দ ও যাহারানপুর মাদ্রাসায় টাইটেল হাদীস শিক্ষা দানের ব্যবস্থা ছিল। বাংলার আলেমরা জামাতে উলা পর্যন্ত শিক্ষা সমাপন করে দিল্লী, দেওবন্দ, যাহারানপুর চলে যেতেন। সেখান থেকে সিহাহ সিত্তার হাদীস (অন্যান্য হাদীস গ্রন্থসহ) শিক্ষা সমাপন শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন করতেন। এই আলেমগণের মধ্যে ছিলেন শায়খুল হাবত আল্লামা শাহ আবদুল ওয়াহেদ বাঙ্গালী (রহ), কুতবে আলম শায়খুল মাশায়েখ হযরত আল্লামা মাওলানা শাহ জমির উদ্দীন (রহ), শায়খুল ইসলাম হযরত আল্লামা মাওলানা হাবীবুল্লাহ (রহ), মুহাদ্দিছ হযরত আল্লামা মোহাম্মদ হাসান রায়পুরী (রহ) প্রমুখ। আল্লামা আবদুল ওয়াহেদ (রহ) বাংলায় প্রত্যাবতন করে দেওবন্দ পদ্ধতির শিক্ষা ও সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। তার প্রধান সহযোগী ও সহকর্মী ছিলেন হযরত মাওলানা ছুফী আজিজুর রহমান (রহ). হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ (রহ), হযরত মাওলানা আবদুল হামিদ (রহ) প্রমুখ। আনুমানিক ১৮৮০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লাহ, হাটহাজারীর খন্দকিয়া মাদ্রাসা, হাটহাজারী বাজারের দক্ষিণ ও উত্তর পার্শ্বে কয়েকটি কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০২ সনে একটি কেন্দ্রীয় কওমী মাদ্রাসা হিসেবে হাটহাজারী দারুলউলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম নির্ধারিত হন শায়খুল ইসলাম হযরত আল্লামা মাওলানা হাবীবুল্লাহ সাহেব কুরাইশী (রহ)।
১৯০১-১৯৪৩ পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৪২ বছর তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বে বাংলা, আসাম ও বার্মায় বহু মাদ্রাসা, মসজিদ, মক্তব প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি আজীবন এ মাদ্রাসাগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করেন। জন্ম ঃ হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ ১২৭১ বাংলা সনের ৮ বৈশাখ, ১২৮৩ হিজরী / ১৮৬৫ সনে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজিলার মির্জাপুর ইউনিয়নের চারিয়া গ্রামের কাজী পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৌলভী মতিউল্লাহ মিয়াজী (রহ)। তিনি মির্জাপুর নিবাসী মৌলভী ইমাম উদ্দীন মিয়াজী (রহ)-এর কাছে পবিত্র কুরআন শিক্ষা লাভ করেন। নিজ ইউনিয়নের বিশিষ্ট আলেম হযরত মাওলানা মসীহুল্লাহ (রহ)-এর নিকট আরবী ক্লাসের নাহুম হাপ্তুম পর্যন্ত উর্দু, আরবী, ফার্সী কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করার নিমিত্তে চট্টগ্রামের একমাত্র ইসলামী আরবী শিক্ষা কেন্দ্র চট্টগ্রাম মুহসেনিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং সেখানে জামাতে ছুয়াম পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেন। উচ্চ শিক্ষা ঃ আরবী ইসলামী বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তিনি ভারতবর্ষের প্রসিদ্ধ ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র দারুলউলুম দেওবন্দ গমন করেন। কিছুদিন সেখানে শিক্ষা গ্রহণের পর সেখানকার আবহাওয়া শরীরের জন্য অনুকূল নাহওয়ায় কানপুর জামেউল উলুম মাদ্রাসায় গমন করেন। যেখানে ৭ বছরকাল উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা সমাপন করেন। হাদীস তাফসীর ও ফনুনাতে আলীয়ার শিক্ষা সমাপন শেষে দাওরায়ে হাদীস পাস করেন। সেখানে তাঁর প্রধান উস্তাদ ছিলেন হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা শাহ আশরাফ আলী থানবী (রহ), শায়খুল হাদীস হযরত আল্লামা মো. ইসহাক বর্ধমানী (রহ) প্রমুখ। আল্লামা বর্ধমানী (রহ) পরবর্তী সময়ে মাদ্রাসা ই আলীয়া কলকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাদীস শিক্ষা দেন। হযরত থানবী (রহ) ও হযরত মাওলানা ইসহাক বর্ধমানী (রহ) ছাড়াও তিনি শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী (রহ)-এর কাছ থেকে হাদীসের সনদ লাভ করেন। হযরত শায়খুল হিন্দ (রহ) হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা মো. কাসেমী লানুতুবী (রহ)-এর প্রধান শাগরিদ। হযরত থানবী (রহ)-এর প্রধান উস্তাদ হযরত আল্লামা ইয়াকুব নালুতুবী (রহ)। হযরত কাসেম নালুতুবী, হযরত ইয়াকুব নালুতুবী এবং ফকীহুন উম্মত হযরত মাওলানা রশিদ আহমদ গংগুহী (রহ) হযরত মাওলানা আবদুল গনী মোজাদ্দেদী (রহ)-এর কাছে হাদীস শিক্ষা লাভ করেন দিল্লীতে। শাহ্ ইসহাক (রহ) ও শাহ আবদুল আজিজ (রহ) হয়ে এসনদ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহ) পর্যন্ত পৌঁছেছে। কানপুর মাদ্রাসা থেকে যাহেরী এলম শিক্ষা সমাপনের পর তিনি হযরত থানবী (রহ)-এর হাতে বয়াত গ্রহণ করেন এবং আধ্যাত্মিক (মারেফাতের) শিক্ষা অর্জন করেন। অর্ধশতাব্দীকাল তিনি ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে অনন্য সাধারণ অবদান রাখেন। তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মাধ্যমে অখ- বাংলা, আসাম ও বার্মায় হাজার হাজার ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। ইন্তেকাল ঃ ১৩৬১ হিঃ/১৯৪৩ /১৩৪৯ বাংলা সনের কোন এক মঙ্গলবার বাদ আছর তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ... রাজিউন। পরের দিন বুধবার তার জানাযা নামায ও দাফন হয়। তার বাড়ির সামনে অবস্থিত মাকবারায়ে হাবীবী কবরস্থানে (নুর মসজিদ সংলগ্ন) তাকে দাফন করা হয়। জানাযায় হাজার হাজার আলেম সমাজসহ বহু মানুষের সমাগমন হয়। নামাযে জানাজায় ইমামতি করেন হাটহাজারী মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস ও সদরুল মুদাররেসীন হযরত আল্লামা ছাঈদ আহমদ সন্দ্বিপী (রহ)। হযরত আল্লামা হাবীবুল্লাহ সাহেব (রহ)-এর জীবনের বড় কীর্তি সমূহের মধ্যে অন্যতম হলো সারা দেশে হাজার হাজার মাদ্রাসা-মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে দ্বীনি শিক্ষার পথ সুগম করা ইবাদত বন্দেগীর সুযোগ সহজলভ্য করে দেয়া। অপরটি হলো হাদীসে রাসূল (সাঃ)-এর শিক্ষার ব্যবস্থা করা। এক বহুবছর আগে চট্টগ্রামে একমাত্র মাদ্রাসা ছিল চট্টগ্রাম মুহসেনিয়া মাদ্রাসা। গোটা বাংলায় সিহাহসিত্তার হাদীস তথা ছহীহ বুখারী শরীফ, ছহীহ মুসলিম শরীফ, সুনানে ইবনে সাজা, আবু দাউদ শরীফ নেছারী শরীফ, তাহাভী শরীফ ও ইবনে মাজা শরীফ, মোয়াত্তা মালেক, মোয়াত্তা মোহাম্মদ, শামায়েলে তিরমিযী প্রভৃতি কিতাব শিক্ষা দান ও শিক্ষা লাভের কোন ব্যবস্থা ছিল না। কোন প্রতিষ্ঠান এমন ছিল না যাতে বাংলায় এগুলো শিক্ষা দেয়া বা নেয়া যায়। হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ সাহেব ১৯০৮ সনে এ অভাব দূর করানার্থে হাটহাজারী মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদীসের ক্লাস খোলেন এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্লাস চলতে থাকে। প্রায় ১শ বছর পর্যন্ত হাদীস শিক্ষার সিলসিলা চলছে। বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে হাদীস শিক্ষার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান দারুলউলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা। বর্তমানে দাওরায়ে হাদীসে প্রায় আড়াই হাজার ছাত্র ভর্তি হয়ে শিক্ষা লাভ করছে।



 

Show all comments
  • Yousuf ৮ আগস্ট, ২০২০, ৬:২৪ পিএম says : 0
    আল্লহ তাআলা ওনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শায়খুল ইসলাম হযরত আল্লামা মাওলানা হাবীবুল্লাহ (রহ)
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ