মটর সাইকেল: নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে (নতুন বাস্তবতায়)
মটরসাইকেল নিরাপদ, অধিক সুবিধাজনক, খরচ এবং সময় বাঁচায়। গণপরিবহনে একে অন্যের গা ঘেঁষে চলাচলে প্রতিদিন
এমএইচ খান মঞ্জু
বিদেশে চাকরি পাওয়ার জন্য মানুষ যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে তার বেশিরভাগ অংশই জনশক্তি রফতানিতে নিয়োজিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সেগুলোর দালালরা লুটে নেয়। এর ফলে কোনোভাবে চাকরি পেয়ে বিদেশে যেতে পারলেও যারা যায় তারা লাভবান হতে পারে না। অধিকাংশের পক্ষে এমনকি তিন-চার বছরেও খরচের টাকা ওঠানো সম্ভব হয় না। অথচ একটি চাকরি পাওয়ার খরচ যোগানোর জন্য মানুষ ধার-দেনা তো করেই, অনেকে জমি-জমা এবং পৈতৃক ভিটা পর্যন্ত বিক্রি করে ফেলে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং তাদের নিয়োজিত দালালদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। এসব প্রতিষ্ঠান বা দালালদের কাছেও তারা সরাসরি আসতে বা পৌঁছাতে পারে না। কারণ, মাঝখানে রয়েছে নানা নাম ও পরিচয়ের বিভিন্নজন। নগদ টাকার বিনিময়ে সকলকে সন্তুষ্ট করে মূল প্রতিষ্ঠান বা দালালদের কাছে পৌঁছানোর আগেই একজন চাকরি প্রত্যাশীকে পাঁচ-ছয়টি ধাপ পার হতে হয়। আর প্রতিটি ধাপের জন্যই গুনতে হয় প্রচুর টাকা।
গবেষকরা বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে নিরাপদ অভিবাসন বা বিদেশে চাকরি পাওয়ার ব্যাপারে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশগামীদের ৫২ শতাংশ যায় দালালদের মাধ্যমে। ২১ শতাংশ যায় আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে বা তাদের সাহায্য নিয়ে। এরপর রয়েছে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত প্রায় দেড় হাজার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সাধারণ মানুষের মধ্যে যাদের পরিচিতি ‘আদম ব্যাপারী’ হিসেবে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চাকরি নিয়ে বিদেশে যায় ১৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া ১৮ থেকে ৩১ বছর বয়সীদের ৯৮ শতাংশের বেশি পুরুষ এবং তাদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ গেছে জমি বিক্রি করে।
একই ধরনের কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে দুটি বিদেশি সংস্থার গবেষণাতেও। সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন এবং রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট-এর ‘ইমপ্যাক্ট অব মাইগ্রেশন অন পোভার্টি অ্যান্ড লোকাল ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক এক সাম্প্রতিক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, শ্রমিক হিসেবে বিদেশে চাকরি নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারি সনদপ্রাপ্ত বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কাছে সরাসরি আসে মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ চাকরিপ্রত্যাশী। বাকি ৯৫ দশমিক ৪ শতাংশ বিদেশে যায় আত্মীয়স্বজনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। তবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যকই ‘আদম ব্যাপারী’ নামের প্রতিষ্ঠান ও তাদের দালালদের শরণাপন্ন হয়। আর তখন থেকেই শুরু হয় শোষণ ও লুণ্ঠনের কর্মকা-। উল্লেখ্য, বিদেশি সংস্থা দুটির যৌথ গবেষণা রিপোর্টেও সরকারের ভূমিকা না থাকার কথাটা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকারি উদ্যোগে যদি পাঠানো যেত কিংবা চাকরি পাওয়ার ও বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে সরকার যদি ভূমিকা রাখতো তাহলে বাংলাদেশের অভিবাসন ব্যয় অর্ধেকে নেমে আসতো। চাকরি-প্রত্যাশীদেরও দালালদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হতে হতো না।
উল্লেখিত গবেষণা রিপোর্ট দুটিতে বিদেশে চাকরি নিয়ে যাওয়াদের সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য-পরিসংখ্যান এবং বিশ্লেষণ ও মন্তব্য রয়েছে। কিন্তু বেশি গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্যে এসেছে সরকারের ভূমিকা না থাকার এবং মধ্যস্বত্বভোগী দালালদের অনিয়ন্ত্রিত দৌরাত্ম্যের প্রসঙ্গ। আমরা মনে করি, মাসের পর মাস ধরে এমনিতেই যেখানে জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে ক্রমাগত পতন ঘটে চলেছে সেখানে মধ্যস্বত্বভোগী দালালদের দৌরাত্ম্য অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাস্তবে এই দৌরাত্ম্য বরং নেতিবাচক কুফলের কারণ হয়ে উঠেছে। এর ফলে রফতানি বাড়ার তথা বিদেশে আরো বেশি বাংলাদেশীর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থা অবশ্যই চলতে দেয়া যায় না। কারণ, গার্মেন্টের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্সই বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় প্রধান উৎস হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রেখে আসছে। অন্যদিকে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে আদম ব্যাপারী প্রতিষ্ঠান ও সেগুলোর দালালদের দৌরাত্ম্যের ফলে জনশক্তি রফতানিই শুধু কমে যাচ্ছে না, ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ।
আমরা মনে করি, সরকারের উচিত বিষয়টিতে অনতিবিলম্বে নজর দেয়া এবং ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া। মালয়েশিয়ার সঙ্গে জি-টু-জি তথা সরকারি পর্যায়ে চাকরি নিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত চুক্তির ফল নেতিবাচক হয়েছে বলেই আমরা সকল বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করি। নিজে পাঠানোর পরিবর্তে সরকারকে এমন আয়োজন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ‘আদম ব্যাপারী’ নামে পরিচিত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে কঠোর নজরদারির মধ্যে থাকতে হয় এবং যাতে তারা বা তাদের দালালরা চাকরি প্রত্যাশীদের সর্বস্বান্ত করতে না পারে। একথা বুঝতে হবে যে, সৌদি আরবসহ চাকরির প্রধান উৎসগুলো এরই মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাপারে কঠিন অবস্থান নিয়েছে এবং এসব দেশে বাংলাদেশীদের জন্য চাকরির দরজা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এমন অবস্থা আরো বেশিদিন চলতে থাকলে রেমিট্যান্স আয় আশংকাজনকভাবে কমে যাবে, যার অশুভ প্রভাব সরাসরি পড়বে জাতীয় অর্থনীতির ওপর।
ষ লেখক : প্রিন্সিপাল, এমএইচ খান ডিগ্রি কলেজ গোপালগঞ্জ, সাবেক সংসদ সদস্য ও গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।